সুবর্ণ শৃঙ্গ অথবা গোল্ডেন হর্ন (তুর্কি: Altın Boynuz or Haliç; প্রাচীন গ্রিক: Χρυσόκερας, Chrysókeras; লাতিন: Sinus Ceratinus) হলো তুরস্কের ইস্তাম্বুলের একটি প্রধান শহুরে জলপথ ও বসফরাসের প্রাথমিক খাঁড়ি। একটি প্রাকৃতিক মোহনা হিসেবে সুবর্ণ শৃঙ্গ বসফরাস প্রণালীর সাথে সংযোগ স্থাপন করে যেখানে প্রণালীটি মধ্যে সারায়বুরনু বা সেরাগিলো পয়েন্টের শৈলান্তরীপ মার্মারা সাগরের সাথে মিলিত হয়, এটির পানি "পুরোনো ইস্তাম্বুল" (প্রাচীন বাইজেন্টিয়াম ও কনস্টান্টিনোপল) দ্বারা গঠিত উপদ্বীপের উত্তর সীমানা নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। এই মোহনার প্রবেশপথটি ভৌগোলিকভাবে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক কেন্দ্রকে শহরের বাকি অংশ থেকে আলাদা করে এবং একটি শিং আকৃতির, আশ্রয়যুক্ত পোতাশ্রয় তৈরি করে যা ইতিহাসের পরিক্রমায় গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইন, উসমানীয় ও অন্যান্য সামুদ্রিক বাণিজ্য জাহাজকে হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা করেছে।[২]
পুরো ইতিহাস জুড়ে সুবর্ণ শৃঙ্গ অনেক অশান্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে ও অসংখ্য শিল্পকর্মে চিত্রিত হয়েছে।
এক ঘন্টাব্যাপী সুবর্ণ শৃঙ্গ ফেরি পরিষেবা উসুকদার ও কারাকোয়কে মোহনা বরাবর বেশিরভাগ শহরতলির সাথে সংযুক্ত করে। ২০২১ সালে টি৫ ট্রামপথ সুবর্ণ শৃঙ্গের পশ্চিম তীরে চালু হয়। এটি আলিবেইকোয় বাস স্টেশন থেকে আতাতুর্ক সেতুর পাশ ঘেঁষে জিবালি পর্যন্ত চলে এবং ইতিমধ্যে তৈরি করা একটি বর্ধিত অংশ এটিকে এমিনুনে চলে যাবে যেখানে এটি টি১ ট্রামলাইন ও বেশ কয়েকটি ফেরি পরিষেবার সাথে সংযোগ স্থাপন করবে।[৩]
সুবর্ণ শৃঙ্গ হলো আলিবে ও কাওয়াথানে নদীর একটি মোহনা। এটি ৭.৫ কিলোমিটার (৪.৭ মাইল) দীর্ঘ ও ৭৫০ মিটার (২,৪৬০ ফুট) প্রস্থ জুড়ে বিস্তৃত। যেখানে এটি বসফরাসে প্রবাহিত হয় সেখানে এটির সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট)। একটি "শৃঙ্গ" বুঝাতে খাঁড়ির বায়বীয় সিলুয়েট অর্থে নির্দেশ করা হলেও "সুবর্ণ" উপাধিটির তাৎপর্য আরও অস্পষ্ট রয়ে গেছে, ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে হয় এটি এর উপকূল বরাবর অবস্থিত ঐতিহাসিক বন্দর দিয়ে নগরীতে আনা ধন-সম্পদকে অথবা শহরের উপর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে মোহনার জলের উপর জ্বলন্ত হলুদ আলোর কল্পিত শৈল্পিক ব্যাখ্যা বোঝানো হয়। এর গ্রিক ও ইংরেজি নামের অর্থ একই, অন্যদিকে এর তুর্কি নাম, হালিচ-এর সহজ অর্থ "মোহনা" যা আরবি শব্দ খালিজ থেকে এসেছে, যার অর্থ "উপসাগর"। নিম্নোক্ত জেলাগুলো সুবর্ণ শৃঙ্গের পশ্চিম তীরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত: জিবালি, ফেনের, বালাত, আয়ভানসারায়, এয়ুপ, সিলাহতারায়া, সাকারিয়া ও আলিবেইকোয়। নিম্নোক্ত জেলাগুলো সুবর্ণ শৃঙ্গের পূর্ব তীরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত: কাসমপাশা, হাসকোয়, বেয়োওলু ও সুতলুজে।
বর্তমানে সুবর্ণ শৃঙ্গ জড়িত এলাকাগুলো চারটি সেতু দ্বারা সংযুক্ত। উজান থেকে ভাটি (অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে) পর্যন্ত সেগুলো নিম্নরূপ:
বর্তমানে বিলুপ্ত এসকি গালাতা সেতু (আক্ষরিক অর্থে, পুরোনো গালাতা সেতু) কারাকোয় ও এমিনোনুর নিম্নধারার আশেপাশের এলাকাগুলো সংযুক্ত করতে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু ১৯৯২ সালে সেতুর নীচের স্তরে অবস্থিত রেস্তোরাঁগুলোর একটির রান্নাঘরে অগ্নিকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক ক্ষতির পরে এটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং আয়ভানসারায় ও কেচেজি পিরির মধ্যে উজানে স্থানান্তরিত করা হয়। মূলত ১৯১২ সালে তৈরি সেতুটি এখন অবসরপ্রাপ্ত কাঠামোটি, এটি আর যানবাহন বা পথচারীদের ট্র্যাফিকের জন্য ব্যবহৃত হয় না। তবে এটি হালিচ উদ্যানের সাথে সংযুক্ত একটি মৌসুমী বহিরঙ্গন প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান স্থল হিসেবে কাজ করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নথিসমূহ সুবর্ণ শৃঙ্গের উপর ও আশেপাশে কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর মধ্যে বিদ্যমান একটি উল্লেখযোগ্য শহুরে উপস্থিতি দেখায় যেখানে ইয়েনিকাপি সাবওয়ে স্টেশন ও মার্মারায় সুড়ঙ্গ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের সময় আবিষ্কৃত প্রাচীন বন্দর, গুদাম সুবিধা ও বাণিজ্যিক জাহাজের বহরগুলোর সাম্প্রতিক আবিষ্কার দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে যে ছোট বসতিগুলোর তারিখ ৬৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত নির্ণয় করা গেছে।[২][৪][৫]
প্রকৃতপক্ষে, সুবর্ণ শৃঙ্গ দ্বারা প্রদত্ত গভীর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় সর্বদা এই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য একটি প্রধান অর্থনৈতিক আকর্ষণ ও কৌশলগত সামরিক সুবিধা ছিলো। সম্রাট মহান কনস্টান্টিন একই সুবিধাগুলোকে পুঁজি করার জন্য বাইজান্টিয়ামের বিদ্যমান শহরের উপরে নোভা রোমা (পরবর্তীতে কনস্টান্টিনোপল) স্থাপন করেছিলেন, যেমনটি পূর্ববর্তী বন্দোবস্তের প্রতিষ্ঠাতা ও এর আধুনিক উত্তরসূরি ইস্তাম্বুল করেছিলেন।
সেখানে পূর্ব রোমক সাম্রাজ্যের তার নৌ সদর দপ্তর ছিলো ও কনস্টান্টিনোপল শহরকে নৌ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য উপকূল বরাবর প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিলো। উত্তর দিকের শৃঙ্গের প্রবেশপথে অবাঞ্ছিত জাহাজগুলোকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য কনস্টান্টিনোপল থেকে গালাতার পুরোনো মিনার পর্যন্ত একটি বড় শিকল টানা হয়েছিলো। বাইজেন্টাইনদের মধ্যে মেগালোস পিরগোস (গ্রিক ভাষায় যার অর্থ "মহা মিনার") নামে পরিচিত মিনারটি ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় লাতিন ক্রুসেডারদের দ্বারা মূলত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। ১৩৪৮ সালে জেনোইসেরা কাছাকাছি একটি নতুন মিনার তৈরি করে যাকে তারা ক্রিস্টিয়া তুরিস (খ্রিস্টের মিনার) নামে অভিহিত করে, এটি এখন গালাতা মিনার নামে পরিচিত।
তিনটি উল্লেখযোগ্য সময় ছিলো যখন শৃঙ্গ জুড়ে থাকা শৃঙ্খলটি হয় ভাঙা হয়েছিলো বা কেটে গিয়েছিলো। দশম শতাব্দীতে কিভান রুশ তাদের লংশিপগুলোকে বসফরাস থেকে গালাতার আশেপাশে টেনে নিয়ে যায় ও শৃঙ্গে পুনরায় চালু করে; বাইজেন্টাইনরা গ্রিক আগুন দিয়ে তাদের পরাজিত করেছিলো। ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময়, ভেনিসীয় জাহাজগুলো একটি র্যাম দিয়ে শৃঙ্খলটি ভাঙতে সক্ষম হয়। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ জোরালো শক্তি নিয়ে শিকল ভাঙ্গার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরিবর্তে রসদের মতো একই কৌশল ব্যবহার করেন; তার জাহাজগুলোকে তৈলজ পদার্থ যুক্ত কাঠের উপর গালাতা জুড়ে ও মোহনায় টেনে নিয়ে যায়।
১৪৫৩ সালে উসমানীয়দের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর, দ্বিতীয় মেহমেদ ফানারে (আজকের ফেনের) শৃঙ্গ বরাবর গ্রিক জাতিকে পুনর্বাসিত করেন। অনেক ইহুদি শহরটি দখল করার পরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বাইজান্টাইন যুগের মতো বালাতে ইহুদিদের বসবাস অব্যাহত ছিলো। দ্বিতীয় বায়েজীদ যখন স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের বালাতে পুনর্বাসনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তখন এই অঞ্চলটি পুনরায় জনবহুল হয়েছিলো।[৬]
১৫০২ সালে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের একটি পুরাকৌশলীয় প্রকল্পের অংশ হিসেবে সুবর্ণ শৃঙ্গের উপর একটি ২৪০-মিটার (৭৯০ ফু) বিশিষ্ট একক স্প্যান সেতুর একটি অঙ্কন তৈরি করেছিলেন। এই সেতু সংক্রান্ত লিওনার্দোর অঙ্কন ও টীকা বর্তমানে ইতালির মিলানের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে। মূল নকশাটি কখনই কার্যকর না করা হলেও লিওনার্দোর সুবর্ণ শৃঙ্গ সেতুর দর্শন ২০০১ সালে পুনরুত্থিত হয়েছিলো যখন ভেবিয়ন সান দ্বারা নরওয়ের অসের কাছে লিওনার্দোর নকশার উপর ভিত্তি করে একটি ছোট পদচারী সেতু নির্মাণ করা হয়।
১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত শৃঙ্গটি এর তীর বরাবর কারখানা, গুদাম ও শিপইয়ার্ড থেকে শিল্প বর্জ্য দ্বারা দূষিত ছিলো। তারপর থেকে এটি পরিষ্কার এবং স্থানীয় মাছ, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা হয়।[৭] [৮] ১৯৮০-এর দশকে মেয়র বেদরেত্তিন দালান ও ১৯৯০-এর দশকে মেয়র রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের অধীনে দুটি প্রধান ধাপে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চালানো হয়।[৯]
আজকাল, সুবর্ণ শৃঙ্গের উভয় পাশে বসতি স্থাপন করা হয়েছে ও প্রতিটি তীরে উদ্যান রয়েছে। এখানে যেমন ইস্তাম্বুল চেম্বার অফ কমার্সও এর তীরে অবস্থিত আবার বেশ কয়েকটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান কবরস্থান রয়েছে। শৃঙ্গের তীরে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাদুঘর, কংগ্রেস ও সাংস্কৃতিক হল, তুর্কি নৌবাহিনীর সহায়ক সুবিধা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে।
বর্তমানে শৃঙ্গের ইতিহাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এটিকে ইস্তাম্বুলের একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ করে তুলেছে, বার্ষিক ১ কোটি আন্তর্জাতিক অবকাশযাপনকারী এটি পরিদর্শন করেন।[১০]
কখনও কখনও বিশ্বের প্রাচীনতম শিপইয়ার্ড হিসেবে দাবিকৃত হালিচ শিপইয়ার্ড (তুর্কি ভাষায় হালিক তেরসানেসি ) ১৪৫৫ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এটি ১৯৬০-এর দশকে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত উভয়ের জন্যই চালু ছিলো কিন্তু তারপরে এটি অকেজো হয়ে পড়ে। স্থানটি এখন দৈত্যাকার তেরসানে ইস্তাম্বুল প্রকল্প হিসেবে পুনঃবিকাশ করা হচ্ছে যা হোটেল, জাদুঘর, শিল্প চিত্রশালা দোকান ও রেস্তোঁরাগুলোকে খুব জীর্ণ এলাকায় নিয়ে আসবে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান এই প্রকল্প শুরুর ঘোষণা দেন[১১] ও অক্টোবর ২০২১ সালে যখন সেখানে সমসাময়িক ইস্তাম্বুল শিল্প মেলা অনুষ্ঠিত হয় তখন এটি চালু শুরু হয়।[১২] এটা উদ্দেশ্য ছিলো যে সাদবার্ক হানম জাদুঘর প্রকল্পের অংশ হিসেবে সেটি সারয়ের থেকে তেরসানে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরিত হবে।
সুবর্ণ শৃঙ্গ ধ্রুপদী বিষয় নিয়ে কাজ করা সাহিত্যের অনেক কাজগুলোয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, জি কে চেস্টারটনের কবিতা লেপান্টো-এ "ফ্রম ইভনিং আইলস ফ্যান্টাস্টিক্যাল রিংস ফেইন্ট দ্য স্প্যানিশ গান, / এবং লর্ড অন দ্য গোল্ডেন হর্ন ইস লাফিং ইন দ্য সান" এই স্মরণীয় শ্লোক রয়েছে।