সুরিয়া-মাল আন্দোলন

সুরিয়ামাল আন্দেলন (সুরিয়া-মল আন্দোলন) হল ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সিলনে যুদ্ধবিরতি দিবসে তথা 'পপি ডে' প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সিলনের প্রাক্তন সেনাদের সুবিধার্থে সংগঠিত হয়ে পরবর্তীতে যা শুধুমাত্র বামপন্থীদের কারণে চরিত্রগতভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামে পরিণত হয়। []

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিহত সেনাদের স্মরণে এবং সিলনের প্রাক্তন সেনাদের সুবিধার প্রদানের উদ্দেশ্য সুরিয়া ফুল বিক্রির মাধ্যমে সূত্রপাত, ক্রমে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রূপ নিয়ে পরে ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে মহামারি ও বন্যার সময় ত্রাণ কাজেও যুক্ত হয়। []

পটভূমি

[সম্পাদনা]

সুরিয়া-মাল আন্দোলন ছিল সিলনের প্রাক্তন সেনা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এলিয়ান পেরেরার মস্তিষ্কপ্রসূত এবং এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির স্মরণে আয়োজিত জিঙ্গোইস্টিক পপি ডে সংগ্রহের বিরোধিতায় সংগঠিত হয়। []

আর্মিস্টিস ডেতে তথা যুদ্ধবিরতি দিবসে (১১ নভেম্বর) ব্রিটিশ সিলনে পপি ফুল (পোর্টিয়া ফুল) বিক্রি করে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্রিটিশ প্রাক্তন সেনাদের জন্য যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হত, অথচ স্থানীয় প্রবীণরা ( যাদের অনেককে "সিলন প্রতিরক্ষা বাহিনী"-তে নিয়োগের পর ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয় এবং তাদেরও অনেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ে নিহত হয়) দুঃখজনকভাবে অবহেলিত হন। জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগও করেন শ্রীলঙ্কা হতে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের সামান্য বেতন দেওয়া হত। [] এলিয়ান পেরেরা এবং প্রাক্তন সেনাসদস্যরা এর বৃহত্তর, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী প্রভাবগুলি উপলব্ধি করার পরে তাৎক্ষণিকভাবে শ্রীলঙ্কান মহিলাদের সহযোগিতায় শ্রীলঙ্কার প্রবীণ সেনাদের সাহায্যার্থে একই দিনে কাগজের সুরিয়া ফুল বিক্রি শুরু করেন।[]

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষিকা, আনন্দ বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা ডোরিন ইয়ং (এসএ বিক্রমাসিংহের স্ত্রী) সিলনের ডেইলি নিউজে দ্য ব্যাটল অফ ফ্লাওয়ারস্ শীর্ষক এক নিবন্ধে লেখেন শ্রীলঙ্কার স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ব্রিটিশ প্রাক্তন সেনাদের সাহায্যের জন্য পপি ফুল কিনতে বাধ্য করা অযৌক্তিক ছিল। [] আনন্দ বালিকা বিদ্যালয়ের ডোরিন ইয়াং-এর সহকর্মী- হেলেন ডি'আলউইস, শিরানি গামাগে, ইভা ডি মেল, উইনিফ্রেড ডি সিলভা, অ্যাডলিন ডি সারাম, মাউড পেরেরা, এভ্রিল প্রমুখের নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল উল্লেখযোগ্য। সুরিয়া-মাল অ্যাক্টিভিস্ট এলিলিন উইরাসেকেরা এবং হেলেন ডি'আলউইস বার্তা সহ প্রচার পত্রিকায় লেখেন- “ ১১ নভেম্বর সুরিয়া ফুল পরিধান করুন এবং আপনার আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য তা প্রদর্শন করুন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য আপনার প্রত্যাখ্যান নিবন্ধন করুন। প্রতিটি সুরিয়া মালা সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি আঘাত। স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য সুরিয়া মালা পরিধান করুন।"

পরের বছর দক্ষিণ কলম্বোর বামপন্থী যুব লীগ এই উদ্যোগে যোগ দেয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর তারা শান্তি ও মুক্তির জন্য নতুন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করে। প্রতি বছর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির আগে পর্যন্ত যুবক-যুবতীরা পোস্ত বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুদ্ধবিরতি দিবসে রাস্তায় রাস্তায় সুরিয়া ফুল বিক্রি করত। [] সুরিয়া-মাল খরিদ্দাররা সাধারণত সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর ছিলেন, সেকারণে সংগৃহীত অর্থ বেশি হত না। কিন্তু এই আন্দোলন তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতার যুবকদের সমাবেশের এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার 'স্ট্রিট কালেকশন রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স' নামে আইন প্রণয়ন করে আন্দোলনের কার্যকারিতা রোধ করার চেষ্টা করেছিল।

হোরানায় প্রখ্যাত জনহিতৈষী উইলমট আব্রাহাম পেরেরা অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এই আন্দোলনে। সেলিনা পেরেরার মত মহিলারাও আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নেন। উইলমট আব্রাহাম পেরেরার বাসভবনে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভায় ডোরিন ইয়াংকে সুরিয়ামাল আন্দোলনের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। যুগ্ম সচিব হন টেরেন্স ডি জিলভা এবং রবিন রত্নম। রয় ডি মেল হল কোষাধ্যক্ষ।

ম্যালেরিয়া মহামারি এবং বন্যা

[সম্পাদনা]

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সিলন দ্বীপে এক প্রবল খরা দেখা দেয়। চাষবাস না হওয়ার অন্নের অভাবে পীড়িত সিলনের মানুষ। আবার পরের বছর অক্টোবর থেকে অতি ভারী বৃষ্টির কারণে অধিকাংশ স্থানে দেখা দেয় বন্যা আর সেই সঙ্গে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। দুই মাসে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান[] এবং দশ লক্ষের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুরিয়া-মাল আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক ত্রাণের কাজে লিপ্ত ছিলেন। যথেষ্ট খাদ্যের অভাবে মানুষ ব্যাপক অপুষ্টিতে ছিল, তাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস হয়ে যায়। তারা মারমাইট ইস্টের নির্যাসের বড়ি তৈরি করে অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করেছিল। গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ওষুধ ও খাদ্যসামগ্রীর জোগান দিত।[] এন এম পেরেরা মহামারির দিনগুলোতে শুকনো রেশন হিসাবে মসুর ডাল বিতরণ করেন। তিনি পরিপ্পু মহাথমায়া (মিস্টার ডাল) নামে পরিচিত হন।

এছাড়াও দেখুন

[সম্পাদনা]
  • শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা আন্দোলন
  • লঙ্কা সম সমাজ পার্টি

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "75 Years of Independence and the Tamils of Sri Lanka"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১০ 
  2. "Selina Perera – The relentless revolutionary"। Archived from the original on ২০১৫-০২-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১০ 
  3. "The anti-imperialist movement by women in Sri Lanka"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১০ 
  4. "A short story of the Lanka Sama Samaja Party" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১০ 
  5. "George Jan Lerski Origins Of Trotskyism In Ceylon"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১০  line feed character in |শিরোনাম= at position 18 (সাহায্য)