সৈয়দ আহমাদ বেরলভি | |
---|---|
জন্ম | ১৭৮৬ |
মৃত্যু | ৬মে, ১৮৩১ইং |
পরিচিতির কারণ | শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ আন্দোলন |
সৈয়দ আহমাদ বেরলভি (১৭৮৬–১৮৩১)[১][২] রায় বেরিলি, ভারতের একজন মুসলিম সংস্কারক এবং "নবী মুহাম্মদের পথ" (তারিকাহ মুহাম্মাদিয়াহ),নামে একটি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।[৩] ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী এক সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সৈয়দ আহমদ। তার আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভারতে একটি অখণ্ড ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।[৪] তিনি মুসলমানদের কাছে আমিরুল মোমেনীন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।[৫] তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শুরু করে মর্দান পর্যন্ত এ বিশাল অঞ্চলে তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু করেন।[৬][৭]
সৈয়দ আহমদ বেরলভি জন্মগ্রহণ করেন ২৯ই নভেম্বর ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের অযোধ্যা জেলায়। তার বংশতালিকা চতুর্থ খলীফা আলী -এর সাথে মিলিত হয়েছে। বংশীয় রীতি অনুযায়ী চার বৎসর বয়সেই তাকে মক্তবে পাঠানো হয়। কিন্তু বাল্যকাল হতেই তার মধ্যে শিক্ষার চাইতে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ অত্যধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। তার নিকটে কপাটি তথা সৈনিকদের বীরত্বমূলক খেলা ছিল খুবই প্রিয়। তার খেলাধূলার মধ্যে ব্যায়াম ও শরীরচর্চার বিষয়টি মুখ্য ছিল। সৈয়দ সাহেবের ভাগিনা নওয়াব ওয়াযীরুদ্দৌলার সেনাপতি সৈয়দ আব্দুর রহমান বলেন, সূর্যোদয়ের পর এক ঘণ্টা পর্যন্ত সৈয়দ সাহেব ব্যায়াম-কুস্তিতে কাটাতেন। ফলে তিনি অত্যধিক শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। সৈয়দ সাহেবের জীবনের প্রারম্ভ থেকেই যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। দ্বীনের স্বার্থে যুদ্ধ করার প্রবল মানসিকতা তখন থেকেই তার মাঝে বিরাজ করছিল। একদা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। সৈয়দ সাহেব তাতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলে তার ধাত্রী মাতা তাকে কোন মতেই যেতে দিলেন না। আর তার মা তখন ছালাতরত ছিলেন। সৈয়দ সাহেব মাতার সালাম ফেরানোর অপেক্ষায় ছিলেন। মা সালাম ফিরিয়ে ধাত্রীকে বললেন, শোনো বিবি, আহমদকে তুমি অবশ্যই স্নেহ কর, কিন্তু তা কখনো আমার স্নেহের সমান হতে পারে না। এটা বাঁধা দেয়ার সময় নয়। যাও বৎস, আল্লাহ নাম স্মরণ করে এগিয়ে যাও। কিন্তু সাবধান পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর না। অন্যথায় তোমার চেহারা দেখব না। যদি শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরে তাহলে তাদের রাস্তা ছেড়ে দিও। সৈয়দ সাহেব যখন সংঘর্ষস্থলে গিয়ে পৌঁছলেন তখন শত্রুরা বলতে লাগল, আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিন আমরা চলে যাব। আপনাদের সাথে কোনো বিবাদ নেই। তখনই তিনি সাথীদের বললেন, এদের যেতে দাও কোন প্রকার বাধা দিও না।[৮]
সৈয়দ আহমদ বেরলভি যৌবনে পদার্পণ করতেই তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। সংসারের দাবী ছিল যেন তিনি জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করেন। সঙ্গত কারণে কয়েকজন বন্ধুর সাথে তিনি রায়বেরেলী হতে লক্ষ্মৌ যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে অন্য বন্ধুরা চাকরি খুঁজলেও তিনি তা থেকে বিরত থাকেন। আসলে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উদগ্র বাসনা তার চোখের তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সেজন্য তিনি দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করতে মনস্থ করেন। কেননা তৎকালীন উপমহাদেশের খ্যাতিমান মুহা্িদ্দছ হিসেবে খ্যাত শাহ আব্দুল আযীয দিল্লীতে বসবাস করতেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও বন্ধুর পথ উপেক্ষা করে তিনি সেখানে পৌঁছেন। কেননা তিনি যখন দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন তখন তার পরনের কাপড় ব্যতীত অন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। দিল্লী পৌঁছে শাহ আব্দুল আযীযের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। তিনি তার নিকটে অবস্থান করে বিভিন্ন বিষয় দীক্ষাা নেন ও তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নতুনভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তার জীবনে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পড়াশোনার পর হঠাৎ করে একদা তিনি লক্ষ্য করলেন, তার দৃষ্টি থেকে অক্ষরগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি এটাকে চক্ষুরোগ মনে করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ঘটনাটি শাহ আব্দুল আযীয জানতে পেরে তাকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বলেন। এরপর তার লেখাপড়ার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। তাকওয়া ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে আরো কিছু সময় দিল্লীতে অবস্থান করে তিনি নিজ জন্মভূমি রায়বেরেলীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং একাধারে কয়েক বছর বাড়ীতে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি স্বীয় বংশীয় সৈয়দ মুহাম্মাদ রওশন সাহেবের বিদূষী কন্যা বিবি জোহরার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তিনি দ্বিতীয়বার দিল্লী ভ্রমণ করেন এবং নওয়াব আমীর খান (পরবর্তীতে যিনি বিশ্বাঘাতক হিসাবে প্রতিভাত হন)-এর সাহচর্য লাভ করেন। সেখানে তিনি তার সৈন্যদলে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, নওয়াব আমীর খানের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ হতে ইংরেজদের বিতাড়ন করা। আর এই লক্ষ্যকে স্বাগত জানিয়ে সৈয়দ আহমদ তার সৈন্যদলে যোগদান করেন। কিন্তু যখন নওয়াব আমীর সাহেব লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ইংরেজদের সাথে আপোষকামিতার মত কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন সৈয়দ আহমদ তার সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সন্ধির বিরোধিতা করে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেন।
দিল্লী পৌঁছে শাহ আব্দুল আযীযের স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি দিল্লীর আকবরাবাদী মসজিদে অবস্থান করতে থাকেন, তখন লোকেরা চতুর্দিক থেকে তার কাছে আসতে থাকে। আসলে শাহ আব্দুল আযীযের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র মুসলিম ভারতীয়কে ছিরাতে মুস্তাকীমের উপর পরিচালিত করা। আর সেই কাজটির দায়িত্ব অর্পিত হয় সৈয়দ আহমদের উপর। সুতরাং দলে দলে মানুষেরা তার হাতে বায়আত গ্রহণ করতে থাকে। এমনকি ভারতের বিখ্যাত আলিম-ওলামাও তার হাতে বায়আত গ্রহণ থেকে বাদ যাননি। শাহ ইসমাঈল শহীদ, শাহ কারামত আলী জৌনপুরী ও মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখ বিখ্যাত আলিম তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্থান হতে দাওয়াতপত্র আসতে থাকে, যার প্রেক্ষিতে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বায়আত গ্রহণ করতে থাকেন ও দ্বীনী দীক্ষা দিতে থাকেন। মুসলমান ছাড়া হিন্দুরাও সৈয়দ সাহেবের প্রতি সুধারণা পোষণ করত। এমনকি তারা তাকে দাওয়াত দিয়েও আপ্যায়ন করত। একদা তহসিলদার ধকল সিং তাকে দাওয়াত দেয় এবং দুইশত কর্মচারীসহ নিজে উপস্থিত হয়ে তাকে বাড়ীতে নিয়ে দুপুর ও রাত্রিতে আপ্যায়ন করায়। ধকল সিং-এর অধিকাংশ কর্মচারী ছিল মুসলমান। সেখানে তার সকল মুসলমান কর্মচারীরা সৈয়দ সাহেবের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। নাসিরাবাদে শীআ এবং সুন্নীদের মাঝে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা হাঙ্গমার পুনরাবৃত্তির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিলে সুন্নী নাসিরাবাদীরা সৈয়দ সাহেবকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করলে তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রায় ৭০/৭৫ জন সঙ্গী নিয়ে তথায় উপস্থিত হন। এ অভিযানে শাহ ইসমাঈলের মাতা ২৫ টাকা হাদিয়া দেন। নাসিরাবাদে পৌঁছে শীআ নেতাদের নিকটে খবর পাঠান যে, তোমাদের কোন লোকজন যেন আমাদের কোন লোকের সাথে ঝগড়া করতে না আসে। আর নিজের লোকজনকেও সতর্ক করে দিলেন যাতে তারা তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়। পরে বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়। নাসিরাবাদে চেহলাম উপলক্ষে পুনরায় বিবাদ হওয়ার সমূহ সম্ভবনা দেখা দিলে সৈয়দ সাহেবকে পুনরায় খবর দেওয়া হয় এবং তিনি সেখানে সদলবলে উপস্থিত হন। পরে নবাব মুতাসিমুদ্দৌলা, যিনি সরকারীভাবে ৫০০ অশ্বারোহীসহ পদাধিক বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন, তিনিসহ একশজন সৈন্য তার হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এ সময় লোকেরা সৈয়দ সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা, সংযম এবং সামরিক শৃঙ্খলা ও দক্ষতার স্পষ্ট নমুনা দেখতে পায়। নাসিরাবাদে পৌঁছে তিনি শহরে আত্মরক্ষাব্যুহ রচনা করেন এবং শহরে সামরিক নিয়ম-শৃঙ্খলা কায়েম করেন। যা কেবলমাত্র একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাই করতে পারে।[৮]
ইতিমধ্যে সৈয়দ সাহেব হজ্জ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন এবং তার সাথে সম্পৃক্ত সকলকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। তিনি তার বংশের লোকজনসহ ভক্তদেরকে হজ্জের সাথী হওয়ার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা দিতে থাকলেন। সারা ভারত থেকে পাথেয়সামগ্রী এবং সঙ্গী সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভারতের উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহ সফর করেন। ১২৩৬ হিজরীর শাওয়াল মাসের শেষদিন সোমবার ৪০০ লোক সঙ্গে নিয়ে সৈয়দ আহমদ বেরলভি স্বীয় বাসভবন থেকে রওয়ানা হন এবং তার লোকসংখ্যা পালকী বাহক ৮০ জন বেয়ারা বাদ দিয়ে সর্বমোট ৪০৭ জন ছিল। উক্ত হজ্জ কাফেলার সাথে মহিলাগণও ছিলেন। ৩ যিলকাদ বৃহস্পতিবার মাল-সামান ও আসবাব-পত্র জাহাজে তোলা হল। শুক্রবার সকালে সাইয়িদ সাহেব কাফেলার সব লোকদেরকে একত্রিত করে এক এক দল লোকের জন্য একজন করে আমীর, একজন দায়িত্বশীল ও একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করলেন এবং পুরো সফরের জন্য দলের নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলা বিধান করলেন।
হজ্জে যাত্রার পথে তিনি বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করে হাজার হাজার মানুষের বায়আত গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ওয়ায-নছীহত করেন। আর অসংখ্য মানুষের দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং তাদের নযরানা গ্রহণ করেন। অবশেষে কলকাতা থেকে মক্কা মুয়ায্যামা অভিমুখে যাত্রা করেন। তার এ অভিযানে বেশ কয়েকটি জাহাজ ছিল। কাফেলায় সর্বমোট যাত্রী ছিল ছয়শত তিরানব্বই জন।। কলকাতা থেকে জাহাজ বন্দর নগরী আলপ্সী ও কালিকট অতঃপর তথা হতে আদন, অতঃপর ইয়ালামলাম পৌঁছে সেখান হতে জেদ্দায় পৌঁছায়। পথিমধ্যে সৈয়দ সাহেব হুদায়বিয়ায় যাত্রা বিরতি দিয়ে দোআ করেন ও সাথীদের নিকট হতে জিহাদের বায়‘আত নেন। ২৯ শা‘বান ১২৩৭ হিঃ মক্কা মুয়ায্যামায় পৌঁছান। ওমরা ও হজ্জ আদায়ের পর তিনি তার সফরসঙ্গীদের বিরাট দল নিয়ে মক্কা মুআযযামায় দীর্ঘ দিন অবস্থান করেন এবং ওয়ায-নছীহত এবং দ্বীনী তা‘লীম-এর মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন। অবশেষে ১২৩৮ হিঃ ১৫ শাওয়াল মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করেন ও পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে ভারতে ফিরে আসেন। ১২৩৮ হিজরী রামাযান থেকে ১২৪১ হিজরীর ৭ জমাদিউস ছানী পর্যন্ত পূর্ণ এক বৎসরকাল রায়বেরেলীতে অবস্থান করে নিজ বাড়ী-ঘর ও বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ করেন এবং জিহাদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
সৈয়দ আহমদ সাহেব তৎকালীন সময়ে ভারতের অভ্যন্তরে তার যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করেননি। বরং তিনি তার জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারসহ বিভিন্ন স্থানে সফর করে এবং যুদ্ধকেন্দ্র হিসাবে আফগানিস্তানকে মনোনীত করে অবশেষে সেখানে পৌঁছে যান। কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে খেশগীতে উপস্থিত হন এবং সেখান থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৮২৬ নওশহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি অত্যাচারী শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রথমে কর বা জিজিয়া প্রদানের প্রস্তাব দেন। এরপরই একজন সংবাদবাহক এসে খবর দেয় যে, বুখ্য সিং সৈন্য নিয়ে আকুড়ায় প্রবেশ করেছে। একথা শুনে সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। মুসলিম বাহিনীর নৈশকালীন অতর্কিত হামলায় সাতশত শিখ সেনা নিহত হয় এবং মুসলমানদের পক্ষে ৩৬ জন ভারতীয় ও ৪৫ জন কান্দাহারী যোদ্ধা নিহত হন এবং আরও ৩০/৪০ জন আহত হন। এই যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের সাহস, আগ্রহ-উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়। যার পরিণতিতে বালাকোট যুদ্ধের সূচনা হয়।
১৮৩১ সালের ৬ই মে মোতাবেক ২৪ জ্বিলকদ, ১২৪৬ হিজরিতে জুম‘আর দিনে সৈয়দ আহমদ বেরলভির মুজাহিদ বাহিনী মানসেহরা জেলার পর্বতময় উপত্যকা বালাকোট ময়দানে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। উল্লেখ্য যে, মুজাহিদ বাহিনীতে সর্বমোট যোদ্ধা ছিল ৭০০ জন এবং শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট টিলা হতে বালাকোট ময়দানে অবতরণ করতে আরম্ভ করল। আর সৈয়দ আহমদ বেরলভি এবং অধিকাংশ মুজাহিদ মসজিদে-ই বালা ও তার আশপাশে অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, ৭০০ জনের মুজাহিদ বাহিনীকে সাতবানে ঝরনা বরাবর বহুদুর পর্যন্ত শিবির স্থাপন করানো হয়েছিল। সায়্যিদ আহমদ বেরলভি হঠাৎ শিখদের আক্রমণ করার জন্য মসজিদ-ই বালা হতে বের হয়ে মসজিদে যেরিনে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মেটিকোটের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হলেন। মেটিকোটের পাদদেশে অবতরণরত শিখসেনাদের অধিকাংশ নিহত হল। কিন্তু ইতিমধ্যে মেটিকোটে টিলার প্রতিটি ইঞ্চি পর্যন্ত সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তারা প্রত্যেক স্থান দিয়ে নেমে এসে মুজাহিদদের উপর প্রচণ্ড হামলা শুরু করে। সৈয়দ আহমদ বেরলভি মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তার সাথে ছিলেন একান্ত সহযোগী শাহ ইসমাঈল। হঠাৎ করে সৈয়দ আহমদ বেরলভি মেটিকোটের ঝরনার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন এবং শাহ ইসমাঈলও মৃত্যুবরণ করলেন। মুজাহিদগণের একটি বড় দল সৈয়দ আহমদ বেরলভির মৃত্যুবরণের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারায় তার সন্ধানে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুবরণ করলেন। এছাড়া মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। অতঃপর গোজার গোষ্ঠির লোকজন বিভিন্ন দলে উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করতে থাকল যে, সৈয়দ আহমদকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা সকলে পাহাড়ের উপরের দিকে আস। ফলে মুজাহিদগণ উত্তর দিকে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে গমন করেন। আর এইভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। গোজার গোষ্ঠির লোকদের এরূপ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হয় তারা শিখদের প্ররোচনায় তা করেছিল। কেননা মুজাহিদগণ মেটিকোটে যুদ্ধরত থাকলে আরও বহু শিখ যোদ্ধার প্রাণনাশ হত। অথবা অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে হিজরতের উদ্দেশ্যে উক্ত কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। মুজাহিদ বাহিনীর আমীর ও প্রধান সেনাপতি সৈয়দ আহমদ বেরলভির নিহত হওয়া সম্পর্কে অন্য একটি কথা ছড়িয়ে আছে তা হল তিনি মুজাহিদগণের অগ্রভাগে ছিলেন এবং শিখদের একদল সৈন্যের মধ্যে ঢুকে পড়েন। শিখরা তাকে ঘেরাও করে ফেলে যা তার অনুসারীরা লক্ষ্য করেননি। এভাবে তিনি নিহত হন এবং তার লাশও মুজাহিদগণ শনাক্ত করতে পারেননি। এ কারণে অনেককাল পরেও অবশিষ্ট মুজাহিদগণ সৈয়দ আহমদ বেরলভির মৃত্যুর বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেননি।