সৈয়দ শামসুল হক | |
---|---|
![]() সৈয়দ শামসুল হক | |
জন্ম | সৈয়দ শামসুল হক ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ কুড়িগ্রাম, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত |
মৃত্যু | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৮০)
সমাধিস্থল | কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ |
পেশা | কবি, গীতিকার, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, অনুবাদক |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
শিক্ষা | ইংরেজি |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধরন | কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, অনুবাদ, গান |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি |
|
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার,-১৯৬৬ একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার,জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, ১৯৮২, ১৯৮৩ |
দাম্পত্যসঙ্গী | আনোয়ারা সৈয়দ হক |
সন্তান | বিদিতা সৈয়দ হক (মেয়ে) দ্বিতীয় সৈয়দ হক (ছেলে) |
সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত।[১] সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন।[২] এছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।[৩]
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।[৪] তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম।[৫]
সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিল তাকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীতে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সনে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয়।[৬]
সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভাল লোক ছিল, পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।[৭] ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৮] তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।
সৈয়দ হক প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী তার রচিত প্রথম পদ তিনি লিখেছিলেন এগারো-বারো বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ "আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে" রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত 'অগত্যা' পত্রিকায়। সেখানে 'উদয়াস্ত' নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।[৯]
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান, ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কীভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।
— “পরানের গহীন ভিতর” কাব্যের একটি জনপ্রিয় অংশ।
সৈয়দ হকের কবিতায় রয়েছে গভীর অনুপ্রেরণা। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ একদা এক রাজ্যে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কোরাস, বৃষ্টি ও জলের কবিতা কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তুলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লিখেন। কবিতার নাম আহা, আজ কি আনন্দ অপার!।[১০]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস দেয়ালের দেশ প্রকাশিত হয়। তার রচিত এক মহিলার ছবি (১৯৬১), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪) উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে তার রচিত উপন্যাসগুলো পূর্বাণী পত্রিকায় ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হত।[১১] তার রচিত খেলারাম খেলে যা উপন্যাসকে অনেকে যৌনআশ্রিত বলে আখ্যা দেন। তিনি উপন্যাসের ভূমিকায় এই উপন্যাসকে 'এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবে সফলতা পেয়েছেন। বিবিসি বাংলায় নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তিনি নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। তার পরের নাটক নুরুলদীনের সারাজীবন ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত।[১২] সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন। তার অন্যান্য নাটক নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, ঈর্ষা, এখানে এখন-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে।[১৩]
২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেয়।[১৪] চার মাস চিকিৎসার পর ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ (১২ আশ্বিন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[১৫] পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর বুধবার (১২ আশ্বিন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ) চ্যানেল আই টেলিভিশনের তেজগাঁও চত্বরে সকাল ১০টায় প্রথম দফা জানাজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দুপুর ২টায় দ্বিতীয় দফা জানাজা এবং অপরাহ্নে কুড়িগ্রামে তৃতীয় দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পাশে দাফন করা হয়।[১৬]
ছোট গল্প
কবিতা
উপন্যাস
কাব্যনাট্য
প্রবন্ধ
কথা কাব্য
আত্মজীবনী
অনুবাদ
শিশুসাহিত্য
অন্যান্য
বছর | চলচ্চিত্র | কাহিনীকার | চিত্রনাট্যকার | সংলাপ রচয়িতা | গীতিকার | ভাষা | টীকা |
---|---|---|---|---|---|---|---|
১৯৫৯ | মাটির পাহাড় | হ্যাঁ | |||||
১৯৬১ | তোমার আমার | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | ||
১৯৬৪ | শীত বিকেল | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | |||
১৯৬৬ | ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো | হ্যাঁ | উর্দু | পরিচালক ও প্রযোজক | |||
১৯৬৭ | নয়নতারা | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | |||
১৯৬৯ | ময়নামতি | হ্যাঁ | বাংলা | ||||
১৯৭০ | মধুমিলন | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | ||
কাঁচ কাটা হীরে | হ্যাঁ | বাংলা | |||||
ক খ গ ঘ ঙ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | ||||
বিনিময় | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | ||||
১৯৭২ | অবুঝ মন | হ্যাঁ | বাংলা | ||||
১৯৭৬ | মাটির মায়া | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | |
১৯৮২ | বড় ভাল লোক ছিল | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার |
১৯৮৩ | পুরস্কার | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা | |
১৯৮৪ | অভিযান | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | |
২০০৮ | একজন সঙ্গে ছিল | হ্যাঁ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | বাংলা | ||
২০১১ | গেরিলা | হ্যাঁ | বাংলা | নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত | |||
২০২২ | হডসনের বন্দুক | হ্যাঁ | বাংলা | হডসনের বন্দুক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত |
কবির নামে যা আছে : সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। কবি সৈয়দ শামসুল হক কালচারাল ক্লাব। এটি ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িতে স্থাপিত হয়। সৈয়দ শামসুল হক শিশুসাহিত্য পুরস্কার প্রতি বছর কবির জন্মদিনে প্রদান করে থাকে একই উপজেলার গীতিকার তৌহিদ উল ইসলাম পাঠাগার। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য কুড়ি হাজার টাকা। এ ছাড়া কবির নামে ক্লাবের পাশে একটি মঞ্চ রয়েছে।