![]() প্লুটোর প্রাকৃতিক উপগ্রহ স্টিক্স, ১৩ জুলাই ২০১৫ তারিখে ৬৩২,০০০ কিলোমিটার দূর থেকে মহাকাশযান নিউ হোরাইজনস কর্তৃক দৃষ্ট | |
আবিষ্কার | |
---|---|
আবিষ্কারক | মার্ক আর. শোওয়াল্টার ও অন্যান্যরা |
আবিষ্কারের স্থান | হাবল স্পেস টেলিস্কোপ |
আবিষ্কারের তারিখ |
|
আবিষ্কারের পদ্ধতি | আলোকচিত্র দ্বারা |
বিবরণ | |
উচ্চারণ | /ˈstɪks/[১] |
নামকরণের উৎস | Στύξ স্টিক্স |
বিকল্প নামসমূহ | এস/২০১২ (১৩৪৩৪০) ১ এস/২০১২ পি ১ |
বিশেষণ | স্টিজিয়ান /ˈstɪdʒiən/[২] |
কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য[৩] | |
অর্ধ-মুখ্য অক্ষ | ৪২৬৫৬±৭৮ কিমি |
উৎকেন্দ্রিকতা | ০.০০৫৭৮৭±০.০০১১৪৪ |
কক্ষীয় পর্যায়কাল | ২০.১৬১৫৫±০.০০০২৭ d |
নতি | ০.৮০৯±০.১৬২ ডিগ্রি |
যার উপগ্রহ | প্লুটো |
ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ | |
মাত্রাসমূহ | ১৬ x ৯ x ৮ কিলোমিটার[৪] |
ভর | ৭.৫×১০১৫ কিg[৫] |
নাক্ষত্রিক ঘূর্ণনকাল | ৩.২৪ ± ০.০৭ ডি (ক্যাওটিক)[৪] |
অক্ষীয় ঢাল | ৮২°[৬] (কক্ষীয় তলের দিকে) |
প্রতিফলন অনুপাত | ০.৬৫ ± ০.০৭ জ্যামিতিক[৪] |
আপাত মান | ২৭±০.৩[৭][৮] |
স্টিক্স (ইংরেজি: Styx) প্লুটোর একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ। ২০১২ সালের ১১ জুলাই এই উপগ্রহটির আবিষ্কারের কথা ঘোষিত হয়। ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী, এটিই প্লুটোর ক্ষুদ্রতম জ্ঞাত উপগ্রহ। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে মহাকাশযান নিউ হোরাইজনস প্লুটো ও তার অন্যান্য উপগ্রহগুলির সঙ্গে স্টিক্সের ছবিও তুলেছিল। তার মধ্যে একটি ছবি পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়।[৪]
স্টিক্স প্লুটোর দ্বিতীয় নিকটতম তথা পঞ্চম আবিষ্কৃত উপগ্রহ। কারবারোস আবিষ্কারের এক বছর পরে এই উপগ্রহটি আবিষ্কৃত হয়। দীর্ঘতম বেধে স্টিক্সের পরিধি প্রায় ১৬ কিমি (৯.৯ মা)[৪] এবং প্লুটোকে একবার প্রদক্ষিণ করতে এটির সময় লাগে ২০.১ দিন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্ক আর. শোওয়াল্টারের নেতৃত্বাধীন একটি দল হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সঙ্গে যুক্ত ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩ দ্বারা ২০১২ সালের ২৬ জুন থেকে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে গৃহীত আলোকচিত্রের চোদ্দটি সেট ব্যবহার করে স্টিক্স উপগ্রহটি আবিষ্কার করেন।[৯] ২০১২ সালের ১১ জুলাই এই আবিষ্কারের কথা সর্বসমক্ষে ঘোষিত হয়। ইতিপূর্বে জানা ছিল সৌরজগতের সর্বাপেক্ষা অনুজ্জ্বল জ্যোতিষ্কটি হল কারবারোস। স্টিক্সের উজ্জ্বলতা সেটির প্রায় অর্ধেক এবং প্লুটোর উজ্জ্বলতার এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ।[১০] এটির চিহ্নিত করা হয়েছিল এস/২০১২ (১৩৪৩৪০) ১ নামে[১১] এবং ঘরোয়াভাবে এটিকে 'পি৫' নামে উল্লেখ করা হত।[১০][১২][১৩]
নিউ হোরাইজনস নামে একটি যন্ত্রচালিত মহাকাশযানের প্রস্তুতি্র জন্য সম্পাদিত সমীক্ষাকর্মের ফলে স্টিক্স আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই যানটি প্লুটোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এইভাবে প্লুটোর আরও একটি ক্ষুদ্রাকার উপগ্রহ আবিষ্কার হওয়ার ফলে বিজ্ঞানীরা মনে করতে থাকেন যে, এই অঞ্চলে এমনও আরও বস্তু থাকতে পারে যা ক্ষুদ্রাকার হওয়ায় ইতিপূর্বে শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়নি এবং সেগুলির আঘাতে মহাকাশযানটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যে ধরনের বস্তুর সম্ভাব্য উপস্থিতি আশঙ্কা করা হয়েছিল সেগুলির মধ্যে ছিল সেকেন্ডে ১৩ কিলোমিটার বেগে ধাবমান কোনও তালিকা-বহির্ভূত বস্তু বা বলয়[৭][১৪] অথবা ক্ষীণ বলয় বা বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত অতিক্ষুদ্র উপগ্রহ (যেমন শনির উপগ্রহ প্যালান), যার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উল্কা সংঘর্ষের ফলে ছিটকে যাওয়া উপাদান ধরে রাখতে অসমর্থ। এই ধরনের বিক্ষিপ্ত বস্তুর উপস্থিতি মহাকাশযানটির চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে বলেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছিলেন।[১৫] যদিও নিউ হোরাইজনস মহাকাশযানটি কোনও ক্ষুদ্রকায় উপগ্রহ বা বলয় শনাক্ত করেনি এবং নিরাপদেই প্লুটো ও তার পারিপার্শ্বিক এলাকা অতিক্রম করে।
প্লুটোকে ঘিরে অপ্রত্যাশিতভাবে যে জটিল উপগ্রহ মণ্ডলী গড়ে উঠেছে, তা সম্ভবত সুদূর অতীতে প্লুটোর সঙ্গে কুইপার বেষ্টনীর অপর কোনও বড়োসড়ো বস্তুর সংঘাতের ফলশ্রুতি।[১৬] প্লুটোর উপগ্রহগুলি সম্ভবত এই ধরনের কোনও ঘটনার ফলে উদ্ভূত ধ্বংসাবশেষ একাঙ্গীভূত হয়ে সৃষ্ট হয়েছে, ঠিক যেমনভাবে একটি আদি মহাসংঘাতের ফলে চাঁদ সৃষ্টি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সংঘাতের ফলে উদ্ভূত বস্তিগুলিকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কক্ষীয় অনুনাদ বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল বলেও মনে করা হয়।[১০]
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে স্টিক্সের ব্যাস অনুমান করা হয়েছিল ১০ এবং ২৫ কিমি (৬.২ এবং ১৫.৫ মা)-এর মধ্যে।[১৭][১৮] স্টিক্সের আপাত মাত্রা এবং যথাক্রমে ০.৩৫ ও ০.০৪ নিম্ন ও উচ্চ মাত্রায় প্রতিফলিত সৌরকিরণের অনুমিত পরিমাণ ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছিল।[৭] নিউ হোরাইজনস কৃত পরিমাপ থেকে জানা যায় স্ট্রিক্স (খুব আশ্চর্যজনক না হলেও) অত্যন্ত অনিয়তাকার এবং এটির পরিমাপ ১৬ x ৯ x ৮ কিলোমিটার।[৪] ধারণা করা হয়, একটি সংঘর্ষের ফলে উৎক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে এই উপগ্রহটির উৎপত্তি এবং সেই সংঘর্ষের ফলেই সংঘর্ষরত বস্তুগুলি থেকে অধিকতর পরিমাণে উদ্বায়ী বরফ (যেমন নাইট্রোজেন ও মিথেনের উদ্বায়ী বরফ) হারিয়ে যায়। এই পদ্ধতিতেই প্রধানত জলীয় বরফ দ্বারা একটি বস্তু গঠিত হওয়া সম্ভব।[১৯]
প্লুটো-ক্যারন সাধারণ ভরকেন্দ্রটিকে ক্যারন ও নিক্সের মধ্যে রেখে ৪২,৬৫৬ কিলোমিটার দূরত্ব স্টিক্স উক্ত সাধারণ ভরকেন্দ্রটিকে প্রদক্ষিণ করছে।[৩] প্লুটোর সবক’টি উপগ্রহই আপাতভাবে যে কক্ষপথে প্লুটোকে প্রদক্ষিণ করে সেগুলি প্রায় নিখুঁতভাবে বৃত্তাকার ও এক-তলীয়। স্টিক্সের আবিষ্কারক মার্ক শোঅল্টার সেগুলিকে বর্ণনা করেছিলেন "কতকটা রাশিয়ান পুতুলের মতো সুবিন্যস্তভাবে খাপ খাওয়ানো" ("neatly nested ... a bit like Russian dolls") বলে।[১৬]
হাইড্রা ও নিক্সের সঙ্গে স্ট্রিক্সের কক্ষীয় অনুরণন যথাক্রমে ১১:৬ ও ১১:৯ (অনুপাত দু’টি সময়ের প্রতি এককে পরিক্রমণের সংখ্যা; পর্যায় অনুপাতগুলি ব্যস্তানুপাতিক)।[৩][২০] এই "লাপ্লেস-সদৃশ" ত্রি-বস্তু অনুরণনের ফলে নিক্স ও হাইড্রার সঙ্গে স্টিক্সের সংযোগের অনুপাত ২:৫।
স্টিক্সের আবর্তনকাল ২০.১৬১৫৫ দিন,[৩] যা ক্যারন-প্লুটো কক্ষীয় পর্যায়ের ৬.৩৮৭ দিনের সঙ্গে ১:৩ গড়-গতি অনুরণনের প্রায় ৫.০ শতাংশ। অন্যান্য উপগ্রহ নিক্স, কারবারোস ও হাইড্রার সঙ্গে স্টিক্স নিকট অনুরণনের ক্রমের এক অস্বাভাবিক ১:৩:৪:৫:৬ (পর্যায় অনুপাত)-এর অংশ সৃষ্টি করেছে।[১০] কক্ষপথটি সুষম হলেও স্টিক্সের আবর্তন বিশৃঙ্খল। প্লুটোর অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার উপগ্রহগুলির মতো স্টিক্সও গ্রহটির সঙ্গে জোয়ারের বন্ধনে আবদ্ধ নয় এবং এটির আবর্তনও সময়ের স্বল্প ক্রম অন্তর বিভিন্ন হয় (নিউ হোরাইজনস ফ্লাইবাইয়ের অতিক্রমণের সময় আবর্তনের হার ছিল প্রায় ৩.২৩৯ দিন)।[২১]
আবিষ্কারের পর গৌণ গ্রহ চিহ্নিতকরণের নিয়ম অনুযায়ী স্টিক্সের নামকরণ করা হয়েছিল এস/২০১২ (১৩৪৩৪০) ১। কারণ, ২০১২ সালে এই উপগ্রহটি (এস) গৌণ গ্রহ ১৩৪৩৪০ প্লুটোকে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। ঘরোয়াভাবে এটি পরিচিত ছিল "পি৫" নামে, যার অর্থ এটি প্লুটোর পঞ্চম আবিষ্কৃত উপগ্রহ।
প্লুটোর উপগ্রহগুলির নামকরণের রীতি অনুযায়ী ধ্রুপদি পুরাণের দেবতা প্লুটোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নামগুলিকেই ব্যবহার করা হয়। পি৪ ও পি৫-এর নাম নির্ধারণের জন্য ২০১৩ সালে আবিষ্কারক দলের পক্ষ থেকে মার্ক শোওয়ল্টার ও সেটি ইনস্টিটিউট একটি নিঃশর্ত ইন্টারনেট নির্বাচনের আয়োজন করে। এই নির্বাচনে জনসাধারণকে আহ্বান করা হয় তাদের পছন্দের নামটিকে ভোট দেওয়ার জন্য। তাদের দেবতা প্লুটোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গ্রিক পৌরাণিক নাম বেছে নেওয়ার অথবা নিজস্ব কোনও নাম প্রস্তাব রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়।[২২] প্রাথমিক ঘোষণার পর স্টার ট্রেক ফ্র্যাঞ্চাইজে ক্যাপ্টেন জেমস টি. কার্কের চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেতা উইলিয়াম শ্যাটনার ভালকান ও রোম্যুলাস নাম দু’টি প্রস্তাব করেন। তাঁর লৌকিক যুক্তি ছিল ভালকান আগুনের দেবতা ও প্লুটোর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং রোম্যুলাস রোম শহরের প্রতিষ্ঠাতার নাম। কিন্তু এই নাম দু’টির মধ্যে স্টার ট্রেক-এর কাল্পনিক মহাবিশ্বের ভালকান ও রোম্যুলাস নাম কাল্পনিক গ্রহের নামেরও পরোক্ষ ইঙ্গিত ছিল।[২৩][২৪] রোম্যুলাসের নামের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। কারণ, আগেই একটি গ্রহাণুর উপগ্রহকে সেই নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল।[২৫] কিন্তু শ্যাটনার ভালকানের নাম প্রস্তাবের কথা ট্যুইট করে জানালে সেই নামটি নির্বাচনে জয় লাভ করে। সেই সঙ্গে কারবারাস (প্লুটোর পাতাললোকের প্রহরী কুকুরের নাম) নামটি দ্বিতীয় এবং স্টিক্স (পাতাললোকের স্টিক্স নদীর দেবীর নাম) তৃতীয় স্থান অধিকার করে। বিজয়ী নামগুলি ইন্টারন্যাশানাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের কাছে জমা দেওয়া হয়।[২৪]
ভালকান নামটি পাতাললোকের কোনও চরিত্রের নাম না হওয়ায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন (আইএইউ)-এর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাছাড়া এই নামটি বুধের কক্ষপথের মধ্যে কল্পিত একটি অনুমিত গ্রহের নামকরণের জন্য আগেই ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেই সূত্রে ভালকানয়েড শব্দটিরও উৎপত্তি ঘটেছিল।[২৩][২৬][২৭]
২০১৩ সালের ২ জুলাই আইএইউ আনুষ্ঠানিকভাবে পি৫-এর জন্য স্টিক্স এবং পি৪-এর জন্য কারবারোস নাম দুইটির আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়।[২৮][২৯]