স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব বলতে মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতাকে বোঝায়, যার কারণে তারা পরিবর্তনের চেয়ে বর্তমান অবস্থা বা প্রচলিত ব্যবস্থাকে পছন্দ করে।[১] এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা যা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্বের ফলে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগুলি পরিবর্তন বা নতুন বিকল্পের প্রতি অস্বস্তি বোধ করতে পারে এবং তারা প্রায়শই পূর্বনির্ধারিত বা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলিকেই সঠিক ও নিরাপদ মনে করে।[২]
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব হলো সেই প্রবণতা, যা মানুষকে বর্তমান পরিস্থিতি বা যে অবস্থায় তারা অভ্যস্ত, সেটিকেই ধরে রাখতে উৎসাহিত করে। এই পক্ষপাতিত্বের কারণে পরিবর্তনের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা প্রতিরোধ দেখা যায়। বিশেষত, এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আচরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, যেখানে মানুষ নতুন বিকল্পের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হতে পারে এবং পরিচিত বিষয়গুলোকে বেশি মূল্য দিতে পারে।[৩][৪]
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব মূলত "সঞ্চিত ঝুঁকি" (loss aversion) এবং "সম্মতির প্রভাব" (endowment effect) এর সাথে সম্পর্কিত। "সঞ্চিত ঝুঁকি" হল এমন এক প্রবণতা যেখানে মানুষ মনে করে, তারা পরিবর্তন করলে হারানোর সম্ভাবনা বেশি, এবং "সম্মতির প্রভাব" হল সেই মানসিকতা যেখানে মানুষ নিজের কাছে যা আছে সেটিকে বেশি মূল্য দেয়।[৫]
ড্যানিয়েল কানেম্যান এবং আমোস টভারস্কি এই প্রবণতাগুলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাদের প্রস্পেক্ট থিওরিতে। তারা দেখিয়েছেন যে মানুষ নতুন সুযোগের চেয়ে পরিচিত পরিস্থিতি থেকে বিচ্যুত হতে চায় না কারণ পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বা ক্ষতির চেয়ে বর্তমান স্থিতি ধরে রাখা তাদের জন্য নিরাপদ মনে হয়।[৬]
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এটি রাজনীতি, অর্থনীতি, এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে প্রতিরোধের সম্মুখীন হন, কারণ সাধারণ মানুষ পরিচিত ব্যবস্থার চেয়ে নতুন ও অনিশ্চিত বিকল্পগুলি গ্রহণ করতে চায় না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারীরা তাদের বর্তমান পোর্টফোলিও থেকে সরে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি যদি নতুন বিনিয়োগের সুযোগগুলি আরো লাভজনক হয়।[৭]
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্বের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেগুলি মূলত মানুষের মানসিক ও সামাজিক প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত:[৪][৮]
মানুষ প্রায়ই পরিচিত পরিবেশ এবং অভ্যাসগুলোর প্রতি আবেগগতভাবে সংযুক্ত থাকে। পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা তাদের মধ্যে অস্বস্তি এবং দুশ্চিন্তা জাগ্রত করে।
নতুন বিকল্পগুলোর সম্ভাব্য উপকারিতা পুরোপুরি উপলব্ধি না করতে পারা বা তা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্য থাকা।
নতুন পরিবর্তনের ফলাফল সম্পর্কে অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া।
পরিবার, সমাজ, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রায়ই বর্তমান অবস্থাকে ধরে রাখতে উৎসাহিত করে, যা নতুন পরিবর্তনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব সবসময় ক্ষতিকারক নয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি নতুন সম্ভাবনাগুলিকে অবমূল্যায়ন করার ফলে ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই, স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্বের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য বাধা গুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য মানুষের উচিত তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যতিক্রমী বা নতুন বিকল্পগুলিকেও গুরুত্ব দেওয়া।[১২]
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব মানুষের আচরণে একটি সাধারণ প্রবণতা যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। যদিও এটি স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা প্রদান করে, পরিবর্তনের প্রতি এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব মাঝে মাঝে অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এবং বিকল্পগুলির সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্বের সনাক্তকরণ
স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্ব সনাক্ত করার জন্য বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতির ওপর। এটি সনাক্ত করা যায় যখন কেউ নতুন ও সম্ভাব্য বিকল্প থাকা সত্ত্বেও পরিচিত অথবা পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের দিকে বেশি ঝোঁক দেখায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি অনিশ্চয়তার কারণে পরিবর্তনকে এড়িয়ে চলা হয়, বা পরিচিত পরিস্থিতি থেকে বিচ্যুতির সম্ভাব্য ঝুঁকির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে তা স্থিতিবস্থার পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত দিতে পারে। বিশেষত, যদি কেউ যুক্তিযুক্তভাবে আরও ভালো বিকল্পের কথা জেনেও বর্তমান অবস্থায় স্থিত থাকার পক্ষে থাকে, তবে সেটি স্পষ্টতই এই পক্ষপাতিত্বের লক্ষণ।[১৩]