স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা (তিব্বতি: སྤོམ་མདའ་ཚང་རབ་དགའ་, ওয়াইলি: spom mda' tshang rab dga’[১]) (১৯০২–১৯৭৪) কুয়োমিনতাং-পন্থী সামন্ততন্ত্রবিরোধী একজন তিব্বতী বিপ্লবী ছিলেন, যিনি তিব্বত সরকার বিরোধী খাম্স-পা বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি নুব-বোদ-লেগ্স-ব্চোস-স্ক্যিদ-স্দুগ (ওয়াইলি: nub-bod-legs-bcos-skyid-sdug) নামক রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
তিব্বতের খাম্স অঞ্চলে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং (ওয়াইলি: spom mda' tshang) পরিবার একটি ধনী ও অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবার রূপে গণ্য হত। এই পরিবারের স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-স্তোব-র্গ্যাস (ওয়াইলি: spom mda' tshang stob rgyas) এবং স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' (ওয়াইলি: spom mda' tshang rab dga’) নামক দুই ভাই ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে খাম্স-পা বিদ্রোহ সংগঠিত করেন।[২][৩]:৪৫০ ত্রয়োদশ দলাই লামার মৃত্যুর পর তাদের পারিবারিক বন্ধু থুব-ব্স্তান-কুন-ফেল-লাকে (ওয়াইলি: thub bstan kun phel la) ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণে তারা তিব্বত সরকারের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। তারা প্রথমে চামদো ও পরে লাসা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।[৪] তিব্বত সরকার স্পোম-ম্দা'-ত্শাং (ওয়াইলি: spom mda' tshang) পরিবারের ওপর প্রথমে নিষেধাজ্ঞা জারী করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু পরে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করা হয়। তিব্বতী উলের প্রধান রপ্তানিকারক এই পরিবারকে শাস্তিপ্রদান করা হলে সরকারী কোষাগারে অর্থলাভের সম্ভাবনা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় রফার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই মধ্যস্থতার ফলে পরিবারটি বিদ্রোহকে আর বাড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিদ্রোহ বিফল হলে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' কালিম্পং পালিয়ে যান।[৫]:৯৬
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' ব্রিটিশ ভারতের কালিম্পং শহরে নুব-বোদ-লেগ্স-ব্চোস-স্ক্যিদ-স্দুগ (ওয়াইলি: nub-bod-legs-bcos-skyid-sdug) নামক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা করেন।[৫]:৫১,৫৩,৫৬,৬৬,৮০,৯৮-৯৭ এই দলের সদস্যরা তৎকালীন তিব্বত সরকারকে একটি প্রাচীনপন্থী ও সামন্ততান্ত্রিক সরকার গিসেবে গণ্য করতেন এবং এই সরকারের অপসারণ করে তিব্বতে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন, যা তিব্বতে আধুনিক শিক্ষা, উন্নত প্রযুক্তি ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর প্রচলন করে তিব্বতকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে। সান ইয়াত-সেনের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' বিশ্বাস করতেন যে, চীনে যেভাবে চিং রাজবংশের উৎখাত করা হয়েছে, ঠিক সেই ভাবে তিব্বতেও পরিবর্তন আসবে। তিনি কুয়োমিনতাংয়ের তত্ত্বগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিব্বতে তা প্রয়োগ করার চিন্তা করেন। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়ার মানুষকে তত্ত্ব দিয়ে সহায়তা করার জন্য তিনি সান ইয়াত-সেনের প্রশংসা করে সামন্ততন্ত্রগুলির উচ্ছেদ সাধনের ডাক দেন।[৬] স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা'র মতে বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন 'স্বৈরাচারী' সরকার থেকে তিব্বতকে মুক্ত করাই তার দলের লক্ষ্য ছিল।[৩]:৪৫০
চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন কুয়োমিনতাং সরকার তিব্বতে চীনা প্রভাব বিস্তারের জন্য উৎসাহী থাকায় চিয়াং গোপণে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' ও তার আন্দোলনকে অর্থসাহায্য করতেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কায়রো সম্মেলনের ঠিক পূর্বে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' চীনপন্থী খাম্স-পা সেনার সাহায্যে তিব্বতী সেনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার জন্য চিয়াংয়ের নিকট সহায়তা প্রার্থনা করেন। তিনি চিয়াংয়ের নিকট দলাই লামার শাসনাধীন তিব্বত সরকারকে আধুনিক সভ্যতার পক্ষে সহ্যাতীতভাবে বেমানান রূপে বর্ণনা করেন। তার দল তিব্বতের সরকারের বিরুদ্ধে কুয়োমিনতাংকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করতে থাকে। এই সময় চিয়াং তাকে চীনা পাসপোর্ট প্রদান করেন।[৭][৮] ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' তাওয়াং ও ভুটান অঞ্চলে ঐতিহাসিক সীমানা নির্দেশক মানচিত্র তৈরীর জন্য দ্গে-'দুন-ছোস-ফেলকে এই অঞ্চলগুলির মধ্য দিয় লাসা প্রেরণ করেন।[৩]:৪৫৩
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কালিম্পং শহরে ব্রিটিশ আধিকারিক রিচার্ডসনের নজরে এই দলের কর্মকাণ্ড নজরে পড়ে[৩]:৪৫৪ এবং ১০ই এপ্রিল তিনি তিব্বত সরকারকে এই দলের ব্যাপারে অবহিত করেন।[৩]:৪৫৬ ২৬শে এপ্রিল তিব্বত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রত্যর্পণের দাবী জানানো হয়, কিন্তু স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা' নিজেকে চীনা নাগরিক হিসেবে দাবি করায় তিব্বত সরকারের এই অনুরোধ মানা সম্ভব হয় না। ১৯শে জুন স্পোম-ম্দা'-ত্শাং-রাব-দ্গা'র বিরুদ্ধে বিপ্লবের চেষ্টা ও গুপ্তচরগিরির অভিযোগ এনে তার বাসস্থানে তল্লাশী চালানো হয়, কিন্তু দিল্লির চীনা দূতাবাস থেকে অগ্রিম খবর পেয়ে তিনি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট করে ফেলতে সক্ষম হন। এতদসত্ত্বেও চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার দল নিয়ে কিছু চিঠিপত্র পুলিশের হস্তগত হলে[৩]:৪৫৮ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত থেকে তাকে সাংহাই শহরে পাঠিয়ে দেওয়ার হয়।[৩]:৪৬০