স্বামী শিবানন্দ | |
---|---|
![]() স্বামী শিবানন্দ | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | তারকনাথ ঘোষাল ১৬ ডিসেম্বর ১৮৫৪ |
মৃত্যু | ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ | (বয়স ৭৯)
ধর্ম | হিন্দুধর্ম |
ক্রম | রামকৃষ্ণ মিশন |
দর্শন | অদ্বৈত বেদান্ত |
ধর্মীয় জীবন | |
গুরু | শ্রীরামকৃষ্ণ |
স্বামী শিবানন্দ ( ১৬ ডিসেম্বর ১৮৫৪- ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪) ছিলেন একজন হিন্দু আধ্যাত্মিক নেতা, শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ তথা প্রত্যক্ষ শিষ্য। তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় সঙ্ঘ্যাধক্ষ (১৯২২-১৯৩৪) ছিলেন। তিনি তার ভক্তবৃন্দের কাছে ছিলেন মহাপুরুষ মহারাজ। রামকৃষ্ণের জীবনীচিত্রে শিবানন্দ এবং সুবোধানন্দই তার একমাত্র প্রত্যক্ষ শিষ্য হিসাবে প্রদর্শিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন ব্রহ্মজ্ঞানী (অর্থ, "ব্রহ্ম বা পরম সত্তার জ্ঞাতা")।[১] শিবানন্দ তার ভিক্ষু-ভাইদের জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করেন। স্বামী বিজ্ঞানানন্দকৃত নকশায় বেলুড় মঠে নির্মিত রামকৃষ্ণ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শিবানন্দ। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল তারক নাথ ঘোষাল।
তারকনাথ ঘোষালের জন্ম ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সদর বারাসতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা রামকানাই ঘোষাল ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলে।
শিবানন্দের জন্ম বাংলার বারাসত গ্রামে । তাঁর পিতা ছিলেন রামকানাই ঘোষাল, একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ যিনি আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট আয় করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তন্ত্রের অনুসারী ছিলেন । তার প্রথমা স্ত্রী বামসুন্দরী দেবীর সন্তান ছিলেন শিবানন্দ। তারকনাথের মাতা, রামকানাইয়ের প্রথমা স্ত্রী বামসুন্দরী দেবী পঁচিশ থেকে ত্রিশ জন দরিদ্র ছাত্রের বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।[২] রামকানাই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কে ব্যক্তিগতভাবেও জানতেন, কেননা তিনি ব্যবসায়িক বিষয়ে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে যেতেন।
তারকনাথ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তার পিতাকে সাহায্য করার জন্য কলকাতায় ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জির কোম্পানিতে চাকরি নেন।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তারকনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য রামচন্দ্র দত্তের প্রথমবার রামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাত হয়। এর কিছু দিন পরে তিনি তাকে দেখার জন্য দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরে যান। তারপর থেকে তিনি রামকৃষ্ণের নির্দেশে প্রার্থনায় যোগ দেন এবং ধ্যান অনুশীলন শুরু করেন। পরে তিনি লেখেন "আমি এখনও স্থির হতে পারিনি যে, তিনি [রামকৃষ্ণ] একজন মানুষ ছিলেন নাকি সুপারম্যান! একজন দেবতা নাকি স্বয়ং ঈশ্বর! কিন্তু আমি তাকে একজন সম্পূর্ণ আত্ম-নিবেদনশীল মানুষ হিসাবে বুঝতে পেরেছি। সর্বোচ্চ ত্যাগ, সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী, এবং প্রেমের সর্বোচ্চ অবতার তিনি।" [২]
তারকনাথ ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ করেন। তার পিতা তার ভগিনীর বিবাহের জন্য সাধ্যমত যৌতুকের ব্যবস্থা করতে পারেনি, তারকনাথ তাই সম্ভাব্য বরের পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করতে রাজি হন। তিন বছর পরে তার স্ত্রী মারা যান। এরপর তারকনাথ বরানগর মঠ চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত কখনও ভক্তের বাড়িতে আবার কখনও নির্জন জায়গায় থাকতে শুরু করেন। [৩]
তারকনাথ রামকৃষ্ণ দেবের অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিতই দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। রামকৃষ্ণকে প্রথমে শ্যামপুকুরের বাড়িতে এবং পরে কাশীপুর বাগান বাড়িতে আনা হলে, তারকনাথ রামকৃষ্ণের সেবার উদ্দেশ্যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত সহ অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও যোগ দেন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণের তিরোধানের পর, তার প্রত্যক্ষ শিষ্যদের কয়েকজন যারা সন্ন্যাস গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন, তারা বরানগরের এক জরাজীর্ণ বাড়িতে মিলিত হন। সন্ন্যাস গ্রহণে তারকনাথের নাম হয় স্বামী শিবানন্দ এবং সেই সময় হতেই সেখানে তিনি প্রথম বসবাস করতে থাকেন। এভাবে বরানগরে রামকৃষ্ণ মঠের সূচনা হয়।
শিবানন্দ তার পরিভ্রমণকালে প্রথমে সমগ্র উত্তর ভারতের আলমোড়ায় যান। সেখানে এক স্থানীয় ধনী ব্যক্তি, লালা বদরিলাল শাহের সাথে পরিচিত হন, যিনি রামকৃষ্ণের ভক্ত শিষ্যদের একজন ছিলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে, এক সংস্কৃত পণ্ডিত, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের ছাত্র এডওয়ার্ড টরন্টো স্টার্ডির (১৮৬০-১৯৫৭) সাথে তারকনাথের দেখা হয়। থিওসফি তথা দিব্যজ্ঞানে আগ্রহী স্টার্ডি পরে ইংল্যান্ডে বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাতে তার একজন ভক্ত এবং অনুসারী হয়ে ওঠেন। [৪] তিনি মননশীল জীবনযাপনের জন্য বেশ কয়েকবার হিমালয়ে গমন করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বামী তুরিয়ানন্দের সঙ্গে অমরনাথেও গিয়েছিলেন।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দেবিবেকানন্দের ভারত প্রত্যাগমণের পর তারকনাথের পরিব্রাজক জীবনের সমাপ্তি ঘটে। বিবেকানন্দকে অভ্যর্থনা জানাতে মাদ্রাজে যান এবং তার সঙ্গী হয়েই কলকাতায় আসেন। বিবেকানন্দ বেদান্ত প্রচারের জন্য শিবানন্দকে তৎকালীন সিংহলে পাঠান। সেখানে তিনি ভগবদ্গীতা ও রাজ যোগের উপর ক্লাস করেন। তিনি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বেলুড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মঠে আসেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্লেগ মহামারি দেখা দিলে বিবেকানন্দের অনুরোধে শিবানন্দ ত্রাণ কার্য চালান।১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিবেকানন্দের সাথে মায়াবতীতে যান। দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে, তার নামাঙ্কিত 'শিবানন্দ ধাম' নামে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে, বিবেকানন্দের তিরোধানের ঠিক আগে, উত্তরপ্রদেশের শ্রাবন্তী জেলার ভিঙ্গার রাজার বিবেকানন্দকে দেওয়া দানে অদ্বৈত আশ্রম শুরু করতে বারাণসীতে যান। সেখানে তিনি সাত বছর আশ্রমের প্রধান ছিলেন। অর্থকষ্টের মধ্যে তারা কঠোরভাবে জীবনযাপন করেন।[৪] এই সময়ে, তিনি বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা স্থানীয় হিন্দিতে অনুবাদ করেন এবং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আশ্রমের কাজকর্ম দেখাশোনা করেন।
বেলুড় মঠের আদি ট্রাস্টিদের একজন শিবানন্দ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে, রামকৃষ্ণ মিশনের সহাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে যখন স্বামী প্রেমানন্দ তথা বাবুরাম মহারাজ অসুস্থ হয়ে প্রয়াত হন, তখন তার মঠ ও মিশনের বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব নেন শিবানন্দ। এর পর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, স্বামী ব্রহ্মানন্দের তিরোধান হলে , তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ হন। তিনি তার পূর্বসূরি ন্যায় দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি ধ্যান অনুশীলনে উপর জোর দেন। তিনি অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা ও ময়মনসিংহে ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার অনেক আধ্যাত্মিক সাধককে দীক্ষা দেন। [৩] ১৯২৪ এবং ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দক্ষিণ ভারতে দুটি দীর্ঘ সফরে যান। প্রথমে উটকামুন্ডে এবং পরে বোম্বাই এবং নাগপুরে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, তিনি দেওঘরে যান এবং রামকৃষ্ণ মিশনের স্থানীয় কেন্দ্রের জন্য নতুন ভবন দ্বারোঘাটন করেন।
তারকনাথ কৈশোরে এক রকম বাধ্য হয়েই বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু, তার যুবতী স্ত্রীর সম্মতিতে, তিনি একেবারে ব্রহ্মচারী জীবনযাপন করেন। [৩] সেই কারণেই বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠার পর, স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা আখ্যায়িত মহাপুরুষ মহারাজ তিনি (মহান ব্যক্তি) "মহাপুরুষ নামে পরিচিত হন।[৩]
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিবানন্দের স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি এক স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি, রামকৃষ্ণের জন্মদিনের কয়েকদিন পর, শিবানন্দ প্রয়াত হন। বেলুড় মঠের পুরাতন মন্দির সংলগ্ন ছোট কক্ষটি 'শিবানন্দের কক্ষ' নামে পরিচিতি লাভ করে। [৩]
অধ্যক্ষ হিসাবে শিবানন্দের কার্যকালে, রামকৃষ্ণ মিশন ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থানে প্রসারিত হয়। উটকামুন্ডে এবং পরে বোম্বাই এবং নাগপুরে শাখা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।বিদেশেরও বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রও খোলা হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে, তিনি আলমোড়ায় একটি রামকৃষ্ণ মিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন । ব্রহ্মানন্দের মৃত্যুর পর তিনি বহু মানুষকে দীক্ষা দেন।
অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদাসিদে স্বভাবের সমস্ত গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। শিবানন্দ বারাণসীতে তার মঠে অসুস্থ সহআবাসিকের ময়লা কাপড় ধুয়েছিলেন। তিনি সেখানে দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে নার্সারি স্কুল চালু করেন। [৫] ব্রহ্মানন্দের মৃত্যুর পর, শিবানন্দ নিজেকে রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ হিসাবে ঘোষণা করতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি নিজেকে ব্রহ্মানন্দের একজন প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করতেই চেয়েছিলেন। [৭] তিনি সন্ন্যাস জীবনে শৃঙ্খলার পক্ষে ছিলেন এবং যতদিন তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন, তিনি নিজেও সেগুলি কঠোরভাবে সেগুলি অনুসরণ করতেন।