স্বাস্থ্যের উপর চায়ের প্রভাব মানব ইতিহাস জুড়ে গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে আছে। যদিও ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস উদ্ভিদ থেকে তৈরি চা পানের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই ধারণা প্রচলিত, তবে চা পানের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য উপকারিতা পাওয়া যায়, এমন কোনো উচ্চমানের প্রমাণ নেই, কিন্তু চা পাতায় থাকা ক্যাফেইনের প্রভাবে সম্ভবত সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে পারে।[১][২] একবিংশ শতকের শুরুর দিকে চায়ের ওপর ক্লিনিক্যাল গবেষণায় রোগের ঝুঁকি কমানোর সম্ভাবনা উল্লেখ করা হলেও, এর চিকিৎসাগত ব্যবহারে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি। কিছু সংখ্যক গবেষণায় বলা হয়েছে যে সবুজ চা এবং কালো চা উভয়ই রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মতো হৃদরোগের কিছু ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের ওপর উপকারী প্রভাব ফেলতে পারে। তবে গবেষণার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার মধ্যে তথ্য মূল্যায়নের পদ্ধতি এবং গবেষণার অংশগ্রহণকারীদের বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য। এসব কারণে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি।[২]
যেসব অঞ্চলে নিরাপদ পানির সরবরাহ নেই, সেখানে চা তৈরি করতে পানি ফুটিয়ে পান করলে তা রোগবাহী জীবাণু ধ্বংস করে, ফলে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি কমে যায়।
মানব খাদ্যাভ্যাসে অ্যালুমিনিয়ামের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চা পানের মাধ্যমে গৃহীত হয়।[৩] অ্যালুমিনিয়ামের মাত্রা নিরাপদ থাকলেও, এর সামান্য উপস্থিতি আলৎসহাইমারের রোগের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে কিছু চায়ে সীসা (মূলত চাইনিজ চা) এবং অ্যালুমিনিয়াম (ভারত/শ্রীলঙ্কান ব্লেন্ড এবং চীন) পাওয়া গেছে।[৪] এই বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য এখনও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।[৫]
বেশিরভাগ গবেষণায় চা পান এবং লোহিত পদার্থ শোষণের মধ্যে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।[৬] তবে অতিরিক্ত পরিমাণে কালো চা পান লোহিত পদার্থের শোষণ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং এটি রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।[৭]
চায়ের পাতা অতিরিক্ত ফুটিয়ে গাঢ় চা তৈরির ঐতিহ্যগত পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যা পরিবেশ দূষণকারী উপাদানের নিঃসরণ এবং গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে।[৮]
সব চা পাতায় ফ্লোরাইড থাকে; তবে একই গাছের পাকা পাতায় তরুণ পাতার তুলনায় ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি ফ্লোরাইড থাকে।[৯][১০]
চা পাতায় ফ্লোরাইডের পরিমাণ, চা পাতা তোলার পদ্ধতি এবং মাটিতে ফ্লোরাইডের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। চা গাছ অন্যান্য গাছের তুলনায় বেশি হারে এই উপাদান শোষণ করে। গাছ রোপণের জায়গা নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করলে এই ঝুঁকি কমানো যায়।[১১] ধারণা করা হয় যে, হাতে তোলা চা পাতায় মেশিনে তোলা চা পাতার তুলনায় কম ফ্লোরাইড থাকে, কারণ হাতে তোলা পদ্ধতিতে পুরনো পাতা তোলার সম্ভাবনা অনেক কম।[১২] ২০২৩ সালে ব্রিটেনে পরিচালিত এক গবেষণায় ৩৮ ধরনের চা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ব্রিটিশ সুপারমার্কেটে পাওয়া সস্তা চা মিশ্রণগুলোতে ফ্লোরাইডের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫৮০ মিলিগ্রাম প্রতি কিলোগ্রামে। অন্যদিকে, সবুজ চায়ে গড়ে প্রায় ৩৯৭ মিলিগ্রাম এবং বিশুদ্ধ চা মিশ্রণে প্রায় ১৩২ মিলিগ্রাম প্রতি কিলোগ্রাম ফ্লোরাইড পাওয়া গেছে। গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে সস্তা চায়ের মিশ্রণে সম্ভবত বেশি বয়সী পাতা ব্যবহার করা হয়, যার ফলে এতে ফ্লোরাইডের পরিমাণ বেশি থাকে। তারা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, একজন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন এক লিটার সস্তা চা পান করেন, তবে তিনি প্রায় ৬ মিলিগ্রাম ফ্লোরাইড গ্রহণ করবেন, যা দৈনিক ৩–৪ মিলিগ্রাম ফ্লোরাইড গ্রহণের সুপারিশকৃত গড় মাত্রার চেয়ে বেশি, তবে দৈনিক সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ১০ মিলিগ্রামের চেয়ে কম। ঝরা পাতা, পুরনো পাতা এবং কান্ড দিয়ে তৈরি ব্রিক চায়ে ফ্লোরাইডের মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে।.[১৩]
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সবুজ চা পাতার প্রতি কিলোগ্রামে ফ্লোরাইডের গড় ঘনত্ব ৫২ মিলিগ্রাম। উক্ত গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে চা প্রস্তুতকরণের সময় পাতা থেকে গড়ে ৮৯% ফ্লোরাইড চা পানিতে মুক্ত হয়।[১৪]
চা পাতায় অক্সালেট থাকায় অতিরিক্ত চা পান করলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। এছাড়াও, এটি শরীরে মুক্ত ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে চা থেকে শরীরে অক্সালেট শোষণের হার কম হওয়ায় এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম।[১৫] অত্যধিক পরিমাণে কালো চা পান কিডনি বিকলের কারণ হতে পারে, যা এর উচ্চ অক্সালেট উপাদানের কারণে ঘটে। এই অবস্থাটি তীব্র অক্সালেট নেফ্রোপ্যাথি নামে পরিচিত।[১৬][১৭]
চা পাতার শুষ্ক ভরের প্রায় ৩% থিয়ানিন ও ক্যাফেইন দ্বারা গঠিত।[১৮] চায়ের প্রকারভেদ ও প্রস্তুতি পদ্ধতির উপর নির্ভর করে প্রতি ২৪০ মিলিলিটার চায়ে ৩০-৯০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকতে পারে।[১৯] চা-তে থিওব্রোমিন এবং থিওফিলিন নামক দুটি উপাদান খুবই সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।[২০] শুকনো চা পাতায় কফির দানার তুলনায় ক্যাফেইন বেশি থাকলেও, সাধারণত এক কাপ চা তৈরি করতে কফির চেয়ে অনেক কম পরিমাণ চা পাতা ব্যবহার করা হয়। ফলে একই পরিমাণের এক কাপ চায়ে কফির তুলনায় অনেক কম ক্যাফেইন থাকে।[২১]
চায়ে থাকা ক্যাফেইন একটি হালকা মূত্রবর্ধক। তবে ব্রিটিশ ডায়েটেটিক অ্যাসোসিয়েশন পরামর্শ দিয়েছে যে চা স্বাভাবিক পানির চাহিদা পূরণের একটি পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা আরও উল্লেখ করেছে যে, "যুক্তরাজ্যে যে ধরনের চা ও কফি আমরা পান করি এবং যেসব পরিমাণে তা গ্রহণ করি, তা সাধারণত [পানিশোষণে] কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা নেই।"[২২]
ক্যাফেইনযুক্ত চা পানের মাধ্যমে মানসিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে পারে।[১]
২০১১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন জানায় যে, সবুজ চা পান করলে স্তন ও প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর দাবি সমর্থন করার জন্য খুবই কম প্রমাণ ছিল।[২৩]
২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের মানুষের উপর করা গবেষণা এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে চা ব্যবহারের সীমিত পরীক্ষা স্পষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি যে, চা ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর।[২৪]
প্রাথমিক দীর্ঘমেয়াদী ক্লিনিকাল গবেষণায় দেখা গেছে যে কালো চা পান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কিছুটা কমতে পারে।[২৫][২৬] অন্যদিকে, আরেকটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে সবুজ চা এবং কালো চা হৃৎ-ধমনীর ব্যাধি সৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে না।[২৭] দুটি দৈবকৃত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ এর পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে দীর্ঘদিন ধরে কালো চা পান করলে সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ কিছুটা কমে যেতে পারে (প্রায় ১-২ মিলিমিটার পারদস্তম্ভ)। তবে এই সিদ্ধান্ত সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে।[২৮] ২০১৩ সালের একটি ককরেন পর্যালোচনায় চা সেবনের মাধ্যমে সংবহন তন্ত্র সম্পর্কিত সূচকে (মোট ও এলডিএল কোলেস্টেরল) উপকারের কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে আরও গবেষণার প্রয়োজন।[২৯]
চা পান করার ফলে পুরুষ বা মহিলাদের অস্থি ভঙ্গের ঝুঁকি, বিশেষ করে কোমড় বা বাহুর হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে না বলে ধারণা করা হয়।[৩০]
যদিও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে সবুজ চা ওজন কমাতে সাহায্য করে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সবুজ চা পান করলে ওজন কমে বা স্বাভাবিক ওজন বজায় থাকে, এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।[৩১][৩২] ওজন কমানোর জন্য সবুজ চা ব্যবহারের ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে, যেমন বমিভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পেটে অস্বস্তি।[৩১]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; NCI
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Hartley2013
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি|pmc=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)।