স্যাটার্নেলিয়া | |
---|---|
পালনকারী | রোমান |
ধরন | ধ্রুপদি রোমান ধর্ম |
তাৎপর্য | গণ-উৎসব |
উদযাপন | ভোজ, ভূমিকা বদল, উপহার প্রদান, জুয়াখেলা |
পালন | সর্বজনীনভাবে রোমান দেবতা স্যাটার্নের উদ্দেশ্যে বলিদান ও ভোজসভা; সর্বসাধারণ কর্তৃক পাইলেয়াস পরিধান |
তারিখ | ১৭–২৩ ডিসেম্বর |
স্যাটার্নেলিয়া (লাতিন: Saturnalia) ছিল রোমান দেবতা স্যাটার্নের সম্মানে আয়োজিত একটি প্রাচীন রোমান উৎসব ও ছুটির দিন। জুলিয়ান পঞ্জিকার ১৭ ডিসেম্বর তারিখে এই উৎসব পালিত হত। পরবর্তীকালে উৎসবের মেয়াদ ২৩ ডিসেম্বর অবধি প্রসারিত করা হয়েছিল। ছুটির দিনটি উদ্যাপন করা হত রোমান ফোরামে স্যাটার্নের মন্দিরে একটি বলিদান ও সাধারণ ভোজসভার মাধ্যমে। এরপর ব্যক্তিগতভাবে উপহার আদান-প্রদান ও অবিরাম পার্টির মাধ্যমে একটি কার্নিভালের পরিবেশ সৃষ্টি হত যা রোমান সামাজিক রীতিনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিত: জুয়াখেলার অনুমতি দেওয়া হত এবং এই মরসুমটিকে যেহেতু ক্রীতদাস ও মুক্তপুরুষ উভয়েরই মুক্তির সময় মনে করা হত সেই হেতু দাসমালিকেরা তাদের ক্রীতদাসদের টেবিলে খাবার পরিবেশন করত।[১] এই উৎসবের একটি সাধারণ প্রথা ছিল ‘স্যাটার্নেলিয়ার রাজা’-কে নির্বাচন। এই রাজার কাজ ছিল জনসাধারণকে আদেশ প্রদান ও আনন্দোৎসবে পৌরোহিত্য করা। সাধারণও এই রাজার আদেশ মান্য করত। যে সব উপহার আদান-প্রদান করা হত তা সচরাচর ক্ষেত্রে মুখের ঠুলি-জাতীয় উপহার বা সিগিলারিয়া নামে পরিচিত মোম বা মাটির তৈরি ছোটো পুতুল। কবি ক্যাটুলাস এই উৎসবের দিনটিকে “শ্রেষ্ঠ দিন” বলে উল্লেখ করেন।[২]
স্যাটার্নেলিয়া ছিল পূর্ববর্তী গ্রিক উৎসব ক্রোনিয়ার রোমান প্রতিরূপ। ক্রোনিয়া উৎসবটি উত্তরায়ণান্তের শেষভাগে আটিক হেকাটোম্বাইয়ন মাসে পালিত হত। রোমানদের মধ্যে কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন সুবর্ণ যুগের (যে সময় স্যাটার্ন বিশ্ব শাসন করতেন) পুনঃপ্রতিষ্ঠা জ্ঞান করে এটির উপর বিশেষ ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিক পরফিরি স্যাটার্নেলিয়া উৎসবের সঙ্গে জড়িত মুক্তির ধারণাটির ব্যাখ্যা করেছিলেন “অমরত্বে আত্মার মুক্তি”র প্রতীক হিসেবে। পরবর্তীকালে পশ্চিম ইউরোপের মধ্য-শীতকালীন উৎসব-অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু কিছু প্রথা সম্ভবত স্যাটার্নেলিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এর মধ্যে বড়দিন, ফিস্ট অফ দ্য হোলি ইনোসেন্টস ও এপিফ্যানির সঙ্গে জড়িত প্রথাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নির্দিষ্টভাবে বললে ‘লর্ড অফ মিসরুল’ নির্বাচনের ঐতিহাসিক পশ্চিম ইউরোপীয় বড়দিন প্রথাটি সম্ভবত স্যাটার্নেলিয়ার প্রথাটি থেকে উৎসারিত হয়েছিল।
রোমান পুরাণে স্যাটার্ন ছিলেন এক কৃষিদেবতা। কথিত আছে, সুবর্ণ যুগে স্যাটার্ন পৃথিবী শাসন করতেন। সেই যুগে মানুষ ছিল নিষ্পাপ, তাই কায়িক পরিশ্রম না করেই পৃথিবীর প্রভূত সম্পদ উপভোগ করার সুযোগ পেত। স্যাটার্নেলিয়ার আনন্দোৎসবকে সেই হারানো পৌরাণিক যুগের অবস্থার প্রতিফলন মনে করা হত। এই উৎসবের গ্রিক প্রতিরূপটি ছিল ক্রোনিয়া,[৩] যা পালিত হত হেকাটোম্বাইয়ন মাসের দ্বাদশ দিনে[৪][৩] (আটিক পঞ্জিকা অনুসারে মধ্য-জুলাই থেকে মধ্য-অগস্ট নাগাদ[৩][৪])। গ্রিক লেখক এথেনিয়াসও সমগ্র গ্রিকো-রোমান জগৎ জুড়ে পালিত এই ধরনের উৎসবের অন্যান্য উদাহরণগুলির কথা উল্লেখ করেছিলেন,[৫] যার মধ্যে রয়েছে হার্মিসের সম্মানে আয়োজিত ক্রিটীয় উৎসব হার্মাইয়া, পসেইডনের সম্মানে ট্রোয়েজেন শহরের একটি অজ্ঞাতনামা উৎসব, জিউস পেলোরিওসের সম্মানে থেসালীয় উৎসব পেলোরিয়া এবং ব্যাবিলনের একটি অজ্ঞাতনামা উৎসব।[৫] এছাড়াও তিনি দাসমালিকদের ক্রীতদাসের সঙ্গে ভোজন করার প্রথাটির কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রথাটি এথেন্সের এনথেস্টেরিয়া ও স্পার্টার হায়াসিনথিয়া উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[৫] আর্গোস শহরের হাইব্রিস্টিকা উৎসবটি প্রত্যক্ষভাবে স্যাটার্নেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হলেও সেই উৎসবেও একই রকম ভূমিকা বদলের একটি প্রথা ছিল, যেখানে নারীরা পুরুষের বেশ ধারণ করত এবং পুরুষেরা নারীর পোষাকে সজ্জিত হত।[৫]
প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদ জাস্টিনাস স্যাটার্নকে ইতালিতে প্রাক্-রোমান জনবসতির এক ঐতিহাসিক রাজা বলে উল্লেখ করেছেন:
ইতালির প্রথম অধিবাসীরা ছিল অ্যাবরিজিনগণ। কথিত আছে, এদের রাজা স্যাটার্নাস এমন অসাধারণ ন্যায়বিচারপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন যে, রাজ্যে একজন ক্রীতদাসও ছিল না, আর কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ছিল না। সবই ছিল সকলের এবং অবিভক্ত, একই ভূসম্পত্তি সকলে ব্যবহার করত; যে জীবনযাত্রার স্মরণে আদেশ করা হয়েছে যে স্যাটার্নেলিয়ায় বিনোদনের সময় ক্রীতদাসেরা তাদের মালিকদের সঙ্গে সর্বত্র বসতে পারবে, এইভাবে সকলের পদমর্যাদা এক হবে।
স্যাটার্নেলিয়াই সম্ভবত ছিল সর্বাধিক-পরিচিত রোমান ছুটির দিন। তা সত্ত্বেও কোনও একক প্রাচীন সূত্রে এই উৎসবের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় না। বর্তমানকালে এই উৎসবটিকে বুঝতে হলে বিভিন্ন বিবরণে উল্লিখিত নানান দিকগুলিকে একত্রিত করে নিয়ে তবে বুঝতে হয়।[৭] পরবর্তী প্রাচীন যুগের লাতিন লেখক মাক্রোবিয়াসের বহু খণ্ডে বিন্যস্ত স্যাটার্নেলিয়া গ্রন্থের নাটকীয় প্রেক্ষাপটি হল এই উৎসব। এই গ্রন্থটি এই উৎসব-সংক্রান্ত প্রধান তথ্য-উৎস। মাক্রোবিয়াস জাস্টিনাসের ‘রাজা স্যাটার্নে’র রাজত্বকালটির বর্ণনায় বলেছেন যে, এই সময়টি ছিল “মহানন্দময় সময় যখন একাধারে বিশ্বজনীন প্রাচুর্য বিরাজমান ছিল এবং তার কারণ ছিল রাজ্যে বদ্ধ ও মুক্তের কোনও বিভাজন ছিল না – স্যাটার্নেলিয়া উৎসবে ক্রীতদাসেরা যে সম্পূর্ণ ছাড়পত্র উপভোগ করত তা থেকেই এটি বোঝা যায়।”[৮] লুসিয়ানের স্যাটার্নেলিয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ক্রোনোস স্বয়ং ঘোষণা করেছিলেন যে, একটি “উৎসবের মরসুম [পালন করতে হবে], যখন মদ্যপান করা আইনসঙ্গত হবে এবং ক্রীতদাসেরা তাদের মালিকদের গালাগালি দেওয়ার ছাড়পত্র পাবে”।[৯]
মাক্রোবিয়াসের রচনার একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্যাটার্নেলিয়া ছিল দক্ষিণায়ণের পূর্বে আয়োজিত একটি আলোর উৎসব এবং এই উৎসবে প্রচুর পরিমাণে মোমবাতির ব্যবহার জ্ঞান ও সত্য অন্বেষণের প্রতীক।[১০] পরবর্তীকালীন রোমান সাম্রাজ্যে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে ডিয়েস নাটালিস সোলিস ইনভিকটি বা “অপরাজেয় সূর্যের জন্মদিন” উপলক্ষ্যে আলোর নবীকরণ ও নববর্ষের আগমন পালন করা হত।[১১]
স্যাটার্নেলিয়া উৎসবের জনপ্রিয়তা খ্রিস্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতেও অব্যাহত ছিল। রোমান সাম্রাজ্য খ্রিস্টান শাসনাধীনে আসার পর এই উৎসবের প্রথাগুলি বড়দিন ও নববর্ষ-কেন্দ্রিক ঋতু উৎসবগুলির মধ্যে নতুন ছাঁচে ফেলে গড়ে তোলা হয় অথবা অন্ততপক্ষে শেষোক্ত উৎসবগুলিকে প্রভাবিত করে।[১২][১৩][১৪][১৫]
খ্রিস্টপূর্ব ২১৭ অব্দে ট্র্যাজিমিন হ্রদের যুদ্ধের পর স্যাটার্নেলিয়া উৎসবটির মধ্যে একটি বড়ো পরিবর্তন আনা হয়। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় এই যুদ্ধে রোমানরা কার্থেজের হাতে বিশ্রীভাবে পরাস্ত হয়েছিল। এর আগে পর্যন্ত তারা উৎসবটি পালন করত রোমান প্রথা (মোরে রোমানো) অনুযায়ী। সিবিলাইন গ্রন্থাবলির উপদেশ অনুসারে এর পর তারা "গ্রিক প্রথা" গ্রহণ করে এবং গ্রিক পদ্ধতিতেই বলিদান প্রথা চালু করে। গণ-ভোজসভা ও ক্রমাগত “ইও স্যাটার্নেলিয়া” বলে চিৎকার করা এই উৎসবের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।[১৬] ক্যাটো দি এল্টার (খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪-১৪৯ অব্দ) রোমান স্যাটার্নেলিয়া উৎসবে তথাকথিত ‘গ্রিক’ উপাদানগুলি যোগের পূর্ববর্তী এক সময়ের কথা স্মরণ করেছেন।[১৭]
ভিন্ন জাতির দেবতাদের অনুগ্রহ লাভের আশায় তাদের উদ্দেশ্যে কাল্ট (কাল্টাস) উৎসর্গ করা রোমানদের ক্ষেত্রে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না এবং বিশেষভাবে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ রোমান সমাজের উপর যে চাপ সৃষ্টি করেছিল তার ফলেই একাধিক নতুন ধর্মীয় রীতি গৃহীত হয় ও সংস্কার সাধিত হয়।[১৮] রবার্ট পামার মনে করেন যে, এই যুগে নতুন প্রথার প্রবর্তন ঘটানো হয়েছিল কার্থেজিয়ান দেবতা বাল হাম্মোনকে তুষ্ট করার অঙ্গ হিসেবে। এই বাল-হাম্মোনকে রোমান স্যাটার্ন ও গ্রিক ক্রোনোসের প্রতিরূপ মনে করা হত।[১৯] দাসমালিক কর্তৃক ক্রীতদাসদের টেবিলে খাদ্য পরিবেশন সম্ভবত এইভাবে কার্থেজীয় বা আফ্রিকান যুদ্ধ বন্দীদের ক্ষেত্রেও প্রসারিত করা হয়েছিল।[২০]
স্যাটার্নের প্রধান মন্দিরের মূর্তিটির পা সাধারণত পশমের দ্বারা বাঁধা থাকত। উৎসব উপলক্ষ্যে মুক্তিদানের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সেটি খুলে নেওয়া হত।[২৩][২৪] সরকারি অনুষ্ঠান পালিত হত ‘গ্রিক প্রথা’ (রাইটাস গ্রিসাস) অনুযায়ী। একজন পুরোহিত বলিদান অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করতেন।[২৫] পুরোহিতের মাথা অনাচ্ছাদিত থাকত; রোমান প্রথা অনুযায়ী, পুরোহিতেরা ক্যাপিটে ভেলাটো অর্থাৎ টোগার একটি বিশেষ ভাঁজ দিয়ে মাথা ঢেকে বলিদান আয়োজন করতেন।[২৬] এই প্রক্রিয়াটিকে সাধারণত ব্যাখ্যা করা হয় স্যাটার্নকে গ্রিক দেবতা ক্রোনাসের সঙ্গে আত্তীকৃত করার দ্বারা। কারণ রোমানরা প্রায়শই গ্রিক পুরাণ, দেবমূর্তি এমনকি ধর্মীয় প্রথাগুলিকেও তাদের নিজস্ব দেবদেবী হিসেবে ব্যাখ্যা করত। কিন্তু পুরোহিতের মস্তক অনাবৃত রাখা সম্ভবত স্যাটার্নেলিয়া-সংক্রান্ত পরিবর্তন; যা স্বাভাবিক তার বিপরীত ক্রিয়াটিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এটা করা হত।[২৭]
বলিদান অনুষ্ঠানের পর রোমান সেনেট লেক্টিস্টার্নিয়াম নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এই প্রথাটির উৎস গ্রিক। এই অনুষ্ঠানে দেবতার মূর্তি একটি বহুমূল্য আসনে এমনভাবে বসানো হত যেন মনে হয় দেবতা নিজে উপস্থিত থেকে সক্রিয়ভাবে উৎসবে অংশগ্রহণ করছেন। এরপর একটি সাধারণ ভোজসভা (কনভিভিয়াম পাবলিকাম) আয়োজিত হত।[২৮][২৯]
এই দিনটিকে সকল কাজের থেকে ছুটির দিন ধরা হত। বিদ্যালয় বন্ধ থাকত, ব্যায়ামাদির নিয়মাবলিও উৎসব উপলক্ষ্যে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হত। আদালতের অধিবেশনও হত না, সেই কারণে ন্যায়বিচারের কাজও বন্ধ থাকত। এই সময় যুদ্ধের ঘোষণাও করা যেত না।[৩০] সাধারণ অনুষ্ঠানের পর গৃহে উৎসব চলতে থাকত।[৩১] গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলি পালিত হয় ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর তারিখে। এই দুই দিনও সাধারণের ছুটি থাকত। গৃহস্থেরা অতি প্রত্যুষে স্নান করত এবং সম্পন্ন ব্যক্তিরা এক পার্থিব দেবতার উদ্দেশ্যে প্রথানুসারে একটি স্তন্যপায়ী শূকরশাবক বলি দিত।[৩২]
স্যাটার্নের একটি অপেক্ষাকৃত কম মঙ্গলময় দিক ছিল। স্যাটার্নের অন্যতম পত্নী লুয়াকে (অপর নাম লুয়া স্যাটার্নি বা ‘স্যাটার্নের লুয়া’) ‘লুয়া ম্যাটার’ (মাতৃরূপা ধ্বংস) হিসেবে চিহ্নিত করা হত এবং এই দেবীর সম্মানে যুদ্ধে নিহত শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র দাহ করা হত এবং তা করা হত সম্ভবত শাস্তি হিসেবে।[৩৫] স্যাটার্নের ক্থোনিক প্রকৃতির জন্য পাতাললোক ও তার শাসক ডিস প্যাটারকে স্যাটার্নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ডিস প্যাটার হলেন গ্রিক প্লৌটনের (লাতিনে প্লুটো) গ্রিক প্রতিরূপ, যিনি গুপ্তধনেরও দেবতা ছিলেন।[৩৬] খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালের সূত্রগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, স্যাটার্নেলিয়া উৎসবে অথবা এই উৎসবের কাছাকাছি কোনও এই সময়ে মৃত গ্ল্যাডিয়েটরদের উৎসর্গ করা হত (মুনেরা) স্যাটার্নের কাছে।[৩৭] গ্ল্যাডিয়েটর-কেন্দ্রিক এই অনুষ্ঠানগুলি ডিসেম্বর মাসে দশ দিন ধরে আয়োজিত। এগুলি উপস্থাপনা করত প্রধানত কোয়েস্টরেরা এবং স্যাটার্নের কোষাগার থেকে এই অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করা হত।[৩৮]
খ্রিস্টান আত্মপক্ষসমর্থনকারীরা গ্ল্যাডিয়েটর মুনেরা প্রথাটিকে নরবলির একটি প্রকারভেদ বলে সমালোচনা করেন।[৩৯][৪০] রিপাবলিকে যুগে এই প্রথাটির অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ পাওয়া না গেলেও, গ্ল্যাডিয়েটর উৎসর্গের এই উদাহরণটির জন্য পরবর্তীকালে মনে করা হত যে, আদিম স্যাটার্ন নরবলি দাবি করতেন। মাক্রোবিয়াস বলেছেন যে, ডিস প্যাটার নরমুণ্ড পেলে শান্ত হতেন এবং স্যাটার্ন শান্ত হতেন মানুষ সহ বলি শিকার (ভিরোরাম ভিকটিমিস) পেলে।[৪১][৪০] হারকিউলিসের ইতালি ভ্রমণের সময় এই সভ্যতাবিস্তারকারী উপদেবতা প্রথাটি বন্ধ করে অন্যভাবে অনুষ্ঠান প্রবর্তনার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ডিস প্যাটারের উদ্দেশ্যে নরমুণ্ড প্রদানের বদলে রোমানরা প্রতীক পুত্তলিকা বা মুখোশ (ওসকিলা) উৎসর্গ শুরু করে; ফিলোকেলাসের বর্ষপঞ্জিতে স্যাটার্নেলিয়ার প্রতীক হিসেবেও একটি মুখোশ দেখা যায়। গ্রিক ফোটা শব্দটির অর্থ যেহেতু ‘মানুষ’ ও ‘আলোক’ দুইই, সেই হেতু স্যাটার্নের প্রতি বিকল্পে মোমবাতি উৎসর্গ ছিল জীবনের আলোর প্রতীক।[৩৩][৩৪] যে ছোটো মূর্তিগুলি উপহার হিসেবে আদানপ্রদান করা হত (সিগিলারিয়া), সেগুলিও সম্ভবত ছিল প্রতীকী বিকল্প।[৪২]
"ক্রীতদাস গৃহস্থালির প্রধানের দায়িত্ব ছিল পেনেটসে উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করা, জিনিসপত্র জোগাড় করা ও বাড়ির ভৃত্যদের কাজকর্মের নির্দেশ দেওয়া। ইতিমধ্যে সে তার মনিবকে লতে আসত যে বার্ষিক অনুষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী গৃহস্থালি ভোজে অংশগ্রহণ করেছে। এই উৎসবের জন্য যে সকল বাড়িতে যথাযথ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসৃত হত সেখানে সর্বপ্রথমে ক্রীতদাসেদের সম্মানে এমনভাবে নৈশাহারের আয়োজন করা হত ঠিক যেমনভাবে বাড়ির মালিকের জন্য করা হত; এবং তারপরেই গৃহস্থালির প্রধানের জন্য আসন পাতা হত। তাই তারপর প্রধান ক্রীতদাস এসে নৈশাহারের সময় ঘোষণা করত এবং প্রভুদের টেবিলে তলব করত।"[৪৩]
মাক্রোবিয়াস, স্যাটার্নেলিয়া ১.২৪.২২–২৩
স্যাটার্নেলিয়া উৎসবের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ভূমিকা বদল ও আচরণগত ছাড়পত্র প্রদান।[৫] ক্রীতদাসেদের জন্য এমন এক ভোজসভার আয়োজন করা হত, যা অন্য ক্ষেত্রে তাদের মালিকদের জন্যই আয়োজন করা হত।[৫] এই ভূমিকা বদলের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রাচীন উৎস-সূত্রগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়: কোনও সূত্র মতে, মনিব ও ক্রীতদান একসঙ্গে আহার করত,[৪৪] অন্যান্য সূত্র মতে আবার, ক্রীতদাসেরা প্রথমে ভোজন করত অথবা মনিবেরা ক্রীতদাসেদের স্বহস্তে খাবার পরিবেশন করত। সম্ভবত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথাটির মধ্যেও কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।[৭]
স্যাটার্নেলিয়া উপলক্ষ্যে শাস্তির ভয় ছাড়াই ক্রীতদাসদের তাদের মালিকদের অসম্মান করার ছাড়পত্র দেওয়া হত। এটা ছিল মুক্ত ভাষণের সময়: অগাস্টান কবি হোরাস এটিকে বলেছেন “ডিসেম্বর মুক্তি”।[৪৫] স্যাটার্নেলিয়ার প্রেক্ষাপটে রচিত দু’টি স্যাটায়ারে হোরাস দেখিয়েছেন এক ক্রীতদাস কীভাবে তার মালিকের তীব্র সমালোচনা করছে।[৪৬] যদিও সবাই জানত যে, সামাজিক পদমর্যাদায় এই সাম্যতাবিধান সাময়িক এবং তার সীমাবদ্ধতাও ছিল; কোনও সামাজিক রীতিই এতে চরম বিপদের সম্মুখীন হত না, কারণ উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে এই সাময়িক সাম্যতারও সমাপ্তি ঘটত।[৪৭]
পুরুষ রোমান নাগরিকদের বিশেষ পোষাক টোগার পরিবর্তে গ্রিক সিন্থেসিস পরিধান করা হত রঙিন “নৈশাহারের পোষাক” হিসেবে। এই গ্রিক পোষাকটিকে অন্য সময়ে দিবাভাগে পরিধান করা ছিল রোমান সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নরুচির পরিচায়ক।[৪৮] নাগরিক মর্যাদাসম্পন্ন রোমানেরা সাধারণত অনাবৃত মস্তকে বাইরে বের হত। কিন্তু স্যাটার্নেলিয়া উৎসবে তারা পিলেয়াস নামে এক ধরনের মোচাকৃতি ফেল্ট টুপি পরত যা ছিল সাধারণভাবে মুক্তপুরুষের প্রতীক। ক্রীতদাসেরা সাধারণভাবে পিলেয়াস পরিধানের অধিকারী ছিল না, কিন্তু স্যাটার্নেলিয়ার সময় সাম্যতাবিধানের জন্য তাদের এই টুপি পরার অনুমতি দেওয়া হত।[৪৯][৫০]
বিভিন্ন সূত্রে নারীদের জন্য উপহার প্রদানের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তার থেকে অনুমিত হয় জন্ম-স্বাধীন রোমান নারীরা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করত। কিন্তু ভোজসভায় তাদের উপস্থিতি নির্ভর করতে সংশ্লিষ্ট সময়ের রীতির উপরে। পরবর্তীকালীন রিপাবলিকের যুগ থেকে নারীরা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে পুরুষদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় অংশ নিত। সাধারণভাবে পুরুষ-সর্বস্ব সমাবেশগুলি নিশ্চিতভাবেই নারী বিনোদনশিল্পীরা উপস্থিত থাকত।[৫১] স্যাটার্নেলিয়ার সামাজিক পদমর্যাদা-সংক্রান্ত ভূমিকা বদলে চরিত্রাভিনয় ও মুখোশ-পরিধান বা ছদ্মবেশ ধারণেরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়।[৫২][৫৩] উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও নাট্যাভিনয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে ধ্রুপদি ইতিহাসবিদ এরিক সেগাল মনে করেন যে, রোমান কমেডিতে যে প্রগলভ ও অবাধ জীবনযাপনকারী ক্রীতদাস ও লম্পট উচ্চমর্যাদাসম্পন্নদের একত্রে অভিনয়ের মধ্যে স্যাটার্নেলিয়ার আদর্শ মিশে গিয়েছিল।[৫৪]
জুয়া ও পাশা খেলা সাধারণভাবে নিষিদ্ধ ছিল অথবা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদিত ছিল না। কিন্তু স্যাটার্নেলিয়া উপলক্ষ্যে ক্রীতদাস সহ সকলেই এই খেলার অনুমতি পেত। মুদ্রা ও বাদাম বাজি রাখা হত। ফিলোকেলাসের বর্ষপঞ্জিতে স্যাটার্নেলিয়ার ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল পাশা সহ টেবিলে উপবিষ্ট লোম-ছাঁটা কোট পরিহিত এক ব্যক্তিকে এবং নিচে লেখা ছিল: “ক্রীতদাস, তোমাকে তোমার মালিকের সঙ্গে খেলার ছাড়পত্র দেওয়া হল।”[৫৫][৫৬] অনিয়ন্ত্রিত অতিভোজন ও মাতলামি নিয়মে পরিণত হত এবং মিতাচারী ব্যক্তি সেই উৎসবে ছিল ব্যতিক্রম।[৫৭]
সেনেকা কিছুটা পরীক্ষামূলকভাবে এই উৎসবের মূল্যায়ন করে এক বন্ধুকে চিঠিতে লেখেন:
"এখন এই ডিসেম্বর মাসে শহরের বৃহত্তর অংশ উত্তেজিত কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। সাধারণের আমোদপ্রমোদের উপর থেকে লাগাম ঢিলে করা হয়; সর্বত্র তুমি শুনতে পাবে মহাপ্রস্তুতির শব্দ, যেন স্যাটার্নের প্রতি উৎসর্গিত দিনগুলি এবং কাজকর্মের দিনগুলির মধ্যে সত্যিই কিছু পার্থক্য আছে। …তুমি যদি এখানে থাকতে, আমি স্বেচ্ছায় আমাদের আচরণের পরিকল্পনাটি নিয়ে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতাম; আমাদের সাধারণ পন্থা কী ত্যাগ করা উচিত, নাকি একাকীত্ব এড়ানোর জন্য দু’জনে ভালোভাবে নৈশাহার করে টোগা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত।"[৫৮]
কোনও কোনও রোমানের এই আনন্দোৎসব বাড়াবাড়ি মনে হত। প্লিনি লরেন্টাইন ভিলায় অবসর যাপনের জন্য একটি নির্জন অংশের বর্ণনা দিয়েছেন: "...বিশেষত স্যাটার্নেলিয়ার সময় যখন বাড়ির অবশিষ্টাংশ উৎসবের ছাড়পত্র লাভ করে কোলাহল ও হৈচৈময় হয়ে উঠে। এইভাবে আমি আমার পরিবারের খেলায় বিঘ্ন ঘটাই না এবং তারাও আমার কাজ বা পড়াশোনায় বিলম্ব ঘটায় না।"[৫৯]