স্যামুয়েল জনসন | |
---|---|
স্থানীয় নাম | Samuel Johnson |
জন্ম | (পুরনো রীতি ৭ সেপ্টেম্বর) লিচফিল্ড, স্টাফোর্ডশায়ার, গ্রেট ব্রিটেন | ১৮ সেপ্টেম্বর ১৭০৯
মৃত্যু | ১৩ ডিসেম্বর ১৭৮৪ লন্ডন, গ্রেট ব্রিটেন | (বয়স ৭৫)
সমাধিস্থল | ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি |
ছদ্মনাম | ডক্টর জনসন |
পেশা | কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, জীবনীকার, সম্পাদক ও ভাষাতাত্ত্বিক |
ভাষা | ইংরেজি |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | পেমব্রোক কলেজ, অক্সফোর্ড (ডিগ্রি নেই) |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি | আ ডিকশনারি অব দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ আ জার্নি টু দ্য ওয়েস্টার্ন আইলস অব স্কটল্যান্ড |
দাম্পত্যসঙ্গী | এলিজাবেথ পোর্টার (প্রদত্ত নাম: জার্ভিস) (বি. ১৭৩৫; মৃ. ১৭৫২) |
স্যামুয়েল জনসন (ইংরেজি: Samuel Johnson; ১৮ সেপ্টেম্বর ১৭০৯ [পুরনো রীতি ৭ সেপ্টেম্বর] - ১৩ ডিসেম্বর ১৭৮৪), যাকে প্রায়ই ডক্টর জনসন নামে অভিহিত করা হয়, ছিলেন একজন ইংরেজ লেখক। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, জীবনীকার, সম্পাদক ও ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন। তিনি অ্যাঞ্জেলিকান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।[১] রাজনৈতিকভাবে তিনি ব্রিটিশ রাজনৈতিক দল টরি'র সমর্থক ছিলেন। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি জনসনকে "ইংরেজ ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্ডিত" বলে উল্লেখ করে।[২] জেমস বসওয়েল তাকে নিয়ে দ্য লাইফ অব স্যামুয়েল জনসন রচনা করেন, ওয়াল্টার জ্যাকসন বেট বইটিকে "সাহিত্যে জীবনী সংক্রান্ত শিল্পকলার সবচেয়ে বিখ্যাত একক কর্ম" বলে অভিহিত করেন।[৩]
স্টাফোর্ডশায়ারের লিচফিল্ডে জন্মগ্রহণকারী জনসন অক্সফোর্ডের পেমব্রোক কলেজে এক বছরের অধিক সময় পড়াশোনা করেন, কিন্তু আর্থিক দৈন্যতার কারণে তাকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন কর্মরত থাকার পর তিনি লন্ডনে চলে যান, সেখানে তিনি দ্য জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজিন-এ লিখতে শুরু করেন। তার প্রারম্ভিক কর্মসমূহের মধ্যে রয়েছে জীবনী সংক্রান্ত লাইফ অব মিস্টার রিচার্ড স্যাভেজ, কবিতা লন্ডন ও দ্য ভ্যানিটি অব হিউম্যান উইশেস এবং নাটক আইরিন।
নয় বছর অধ্যবসায়ের পর ১৭৫৫ সালে জনসনের আ ডিকশনারি অব দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশিত হয়। আধুনিক ইংরেজি ভাষায় এর ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং বইটিকে "পাণ্ডিত্যের অন্যতম সেরা একক অবদান" বলে অভিহিত করা হয়।[৪] কাজটি জনসনকে জনপ্রিয়তা ও সফলতা এনে দেয়। ১৫০ বছর পর অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত জনসনের কাজটিই ছিল বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিধান।[৫] তার পরবর্তী কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধ দ্য প্লেস অব উইলিয়াম শেকসপিয়ার, এবং অধিক পঠিত লোককথা দ্য হিস্টরি অব রাসেলাস, প্রিন্স অব আবিসিনিয়া। ১৭৬৩ সালে জেমস বসওয়েলের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়, যার সাথে তিনি পরে স্কটল্যান্ড ভ্রমণ করেন। জনসন তাদের ভ্রমণ নিয়ে আ জার্নি টু দ্য ওয়েস্টার্ন আইল্যান্ডস অব স্কটল্যান্ড রচনা করেন। তার জীবনে অন্তিম সময়ে তিনি বিশালাকৃতির ও প্রভাব বিস্তারকারী লাইভস অব দ্য মোস্ট এমিনেন্ট ইংলিশ পোয়েটস রচনা করেন, এটি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর কবিদের জীবনী ও বিবর্তনের সংকলন।
স্যামুয়েল জনসন ১৭০৯ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাইকেল জনসন একজন বইবিক্রেতা এবং মাতা সারা (প্রদত্ত নাম: ফোর্ড)।[৬] তার জন্ম হয়েছিল স্ট্রাফোর্ডশায়ারের লিচফিল্ডে তার পিতার বইয়ের দোকানের উপরে তাদের পারিবারিক বাড়িতে। তার জন্মকালে তার মাতার বয়স ছিল ৪০, যা খুবই অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত। ফলে সতর্কতামূলব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এবং একজন পুরুষ ধাত্রী ও জর্জ হেক্টর নামে একজন স্বনামধন্য শল্যচিকিৎসককে নিয়ে আসা হয়েছিল।[৭] শিশু জনসন কাঁদেননি, এবং তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। তার এক আত্মীয় অবাক হয়ে বলেছিলেন যে তিনি এমন কাউকে রাস্তায় পেলেও তুলে আনতেন না।[৮] জনসনের পরিবার ভয় পেয়েছিল যে তিনি হয়ত বাঁচবেন না, এবং সেন্ট ম্যারিস গির্জার একজন বদলি যাজক এনে তার অভিসিঞ্চন করান।[৯] তার দুজন ধর্মপিতা ছিলেন পদার্থবিদ ও পেমব্রোক কলেজের স্নাতক স্যামুয়েল সুইনফেন এবং আইনজীবী, তদন্তকারী বিচারক ও লিচফিল্ড শহরের কেরানি রিচার্ড ওয়েকফিল্ড।[১০]
জনসনের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘতে এবং তার জন্য জোন মার্কলিউ নামে একজন ধাইমা রাখা হয়। কিছুদিন পর তিনি স্ক্রফুলা রোগে আক্রান্ত হন,[১১] সেসময়ে একে "রাজার শত্রু" বলে ডাকা হত এবং বলা হত যে রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্নরাই এই রোগ সাড়াতে পারে। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সাবেক চিকিৎসক স্যার জন ফ্লোয়ার শিশু জনসনকে "রাজকীয় স্পর্শ" দেওয়ার সুপারিশ করেন,[১২] এবং ১৭১২ সালের ৩০শে মার্চ তিনি রানী অ্যানের স্পর্শ লাভ করেন। যাই হোক, এই রীতিও ব্যর্থ হয় এবং তার একটি অস্ত্রোপচার হয়, যার ফলে তার মুখমণ্ডল ও শরীরে স্থায়ী দাগ রয়ে যায়।[১৩] কয়েক মাস পর জনসনের ভাই নাথানিয়েলের জন্মের কয়েকমাস পর তার পিতা কয়েক বছর ধরে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন এবং পরিবারটি তাদের পূর্বতন জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে।[১৪]
জনসন শৈশব থেকেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন এবং তার পিতামাতা, যারা পরবর্তী কালে তার বিরাগভাজন ছিলেন, তার নতুন কাজগুলো অন্যদের দেখিয়ে বেড়াতেন।[১৫] তিন বছর বয়সে তার শিক্ষা লাভ শুরু হয় এবং তার মাতা তাকে বুক অব কমন প্রেয়ার থেকে উদ্ধৃতি মুখস্থ করাতেন ও আবৃত্তি করাতেন।[১৬] চার বছর বয়সে তাকে নিকটস্থ বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় এবং ছয় বছর বয়সে তাকে তার শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত চর্মকারের কাছে পাঠানো হয়।[১৭] এক বছর পরে জনসন লিচফিল্ড গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে লাতিন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।[১৮] এই সময়ে জনসন বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে শুরু করেন, যা পরবর্তী কালে তাকে কোন নজরে দেখে তাতে প্রভাব ফেলে এবং তা তার মরণোত্তর টরেট সিনড্রোমের রোগ নির্ণয়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।[১৯] তিনি সকল বিষয়ে বাকিদের চেয়ে ভালো করেন এবং নয় বছর বয়সে তাকে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।[১৮] এই সময়ে তার পুরুষ-ধাত্রী জর্জ হেক্টরের ভাইপো এডমান্ড হেক্টর ও জন টেলরের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়, যাদের সাথে তার আজীবন যোগাযোগ ছিল।[২০]
১৬ বছর বয়সে জনসন ওরচেস্টারশায়ারের পেডমোরের তার মামাতো ভাই ফোর্ডদের সাথে বসবাস করতেন।[২১] সেখানে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কর্নেলিয়াস ফোর্ড, যিনি জনসন যখন বিদ্যালয়ের না যেতেন তখন ধ্রুপদী শিক্ষা সম্পর্কিত তার জ্ঞান জনসনের সাথে ভাগাভাগি করতেন।[২২] ফোর্ড ছিলেন একজন সফল ও প্রসিদ্ধ শিক্ষায়তনিক ব্যক্তি ও কুখ্যাত মদ্যপ যার আধিক্যের ফলে ছয় বছর পর তার মৃত্যু হয়।[২৩] তার মামাতো ভাইদের সাথে ছয়মাস কাটানোর পর জনসন লিচফিল্ডে ফিরে আসেন, কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হান্টার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্য রাগান্বিত হন এবং জনসনকে বিদ্যালয়ের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে অসম্মতি জানান।[২৪] লিচফিল্ড গ্রামার স্কুলে ফিরে যেতে ব্যর্থ হওয়ায় জনসন স্টুরব্রিজের রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন।[২২] বিদ্যালয়টি পেডমোরের নিকটবর্তী হওয়ায় জনসন ফোর্ডদের সাথে বেশি সময় অতিবাহিত করতে পারতেন এবং তিনি কবিতা লিখতে ও পদ্য অনুবাদ করতে শুরু করেন।[২৪] যাই হোক, তিনি লিচফিল্ডে তার পিতামাতার কাছে ফিরে আসার পূর্বে স্টুরব্রিজে মাত্র ছয়মাস অতিবাহিত করেন।[২৫]
এই সময়ে জনসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কারণ তার পিতা ঋণে জর্জরিত ছিলেন।[২৬] অর্থ উপার্জনের জন্য জনসন তার পিতার সাথে বই সেলানোর কাজ শুরু করেন এবং দেখা যায় যে জনসন তার পিতার বইয়ের দোকানেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে থাকেন এবং তার সাহিত্যিক প্রজ্ঞা গড়ে তুলতে থাকেন। তার মায়ের চাচাতো বোন এলিজাবেথ হ্যারিয়টস ১৭২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যাওয়ার সময় জনসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য অর্থ রেখে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার পরিবার দারিদ্রের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে।[২৭] ১৭২৮ সালের ৩১শে অক্টোবর তার ১৯ বছর পূর্ন হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে জনসন অক্সফোর্ডের পেমব্রোক কলেজে ভর্তি হন।[২৮] উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থ তার কলেজের ব্যয় পূরণ করতে না পারলে তার এক বন্ধু ও কলেজের সহপাঠি অ্যান্ড্রু করবেট তাকে বাকি অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।[২৯]
জনসন পেমব্রোকে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি তার অলসতার গল্প করতেন। তার শিক্ষক তাকে আলেকজান্ডার পোপের মেসিয়াহ-এর লাতিন অনুবাদ করতে বলেন।[৩০] জনসন এক বিকেলের মধ্যে অর্ধেক অনুবাদ সম্পন্ন করেন এবং পরের সকালেই বাকিটুকু সমাপ্ত করেন। কবিতাটি তাকে খ্যাতি এনে দিলেও এর দ্বারা তিনি তার আশানুরূপ কোন বস্তুগত সুবিধা পাননি।[৩১] কবিতাটি পরবর্তী কালে পেমব্রোকের শিক্ষক জন হাজবেন্ডস সম্পাদিত মিসসেলানি অব পোয়েমস (১৭৩১) বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এটি এখন পর্যন্ত বিদ্যমান জনসনের শুরুর সময়ের লেখনী। জনসন তার বাকি সময় পড়াশোনায় ব্যয় করতেন, এমনকি বড়দিনের ছুটিতেও। তিনি "অ্যাডভার্সারিয়া" নামে অধ্যয়নের একটি পরিকল্পনা সাজান, যা অসমাপ্ত রেখে যান, এবং তিনি গ্রিক ভাষা শেখার সময় বাকি সময়টুকু তিনি ফরাসি ভাষা শেখায় ব্যয় করতেন।[৩২]
তেরো মাস পর আর্থিক সংকটে পরে জনসন কোন ডিগ্রি ছাড়াই অক্সফোর্ড ত্যাগ করেন এবং লিচফিল্ডে ফিরে আসেন।[২৭] অক্সফোর্ডের থাকার শেষ সময়ে তার গৃহশিক্ষক জর্ডান পেমব্রোক ত্যাগ করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন উইলিয়াম অ্যাডামস। জনসন অ্যাডামসের শিক্ষাদান উপভোগ করতেন, কিন্তু ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জনসনের কাছে ফিয়ের টাকার আর মাত্র এক চতুর্থাংশ বাকি ছিল, ফলে তিনি বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। তিনি তার পিতার কাছ থেকে ধার করা অনেক বই রেখে যান কারণ তার কাছে এগুলো পরিবহনের খরচ ছিল না এবং তিনি আশা করেছিলেন তিনি পুনরায় অক্সফোর্ডে ফিরে আসবেন।[৩৩]
ইতোমধ্যে তিনি একটি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৭৫৫ সালে তার অভিধান প্রকাশের পূর্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মাস্টার অব আর্টস ডিগ্রি প্রদান করে।[৩৪] ১৭৬৫ সালে ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিন ও ১৭৭৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করে।[৩৫] ১৭৭৬ সালে তিনি বসওয়েলের সাথে পেমব্রোকে ফিরে আসেন এবং তার সাবেক গৃহশিক্ষক ও তৎকালীন কলেজের প্রধান অ্যাডামসকে নিয়ে কলেজ পরিদর্শন করেন। এই পরিদর্শনকালে তিনি তার সময়ে কলেজের অবস্থা ও তার প্রারম্ভিক কর্মজীবনের কথা স্মরণ করেন এবং জর্ডানের প্রতি তার অনুরাগের কথা প্রকাশ করেন।[৩৬]
১৭২৯ সালের শেষভাগ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত জনসনের জীবন সম্পর্কে অল্পই জানা গিয়েছে। ধারণা করা হয় তিনি তার পিতামাতার সাথে বসবাস করতেন। তিনি দফায় দফায় নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক ব্যথায় ভোগেন;[৩৭] টুরেট সিনড্রোমের ফলে তার মুখ ও অঙ্গভঙ্গি অধিক দৃশ্যমান ও প্রায়ই মন্তব্য করার মত হয়ে ওঠে।[৩৮] ১৭৩১ সালে জনসনের পিতা অত্যধিক ঋণে জর্জরিত হন এবং লিচফিল্ডে তার অনেক সম্পত্তি হাতছাড়া হয়। জনসন অগ্রবর্তী অবস্থান পাওয়ার আশা করেন এবং স্টুরব্রিজ গ্রামার স্কুলে একটি সুযোগ পান, কিন্তু তার কোন ডিগ্রি না থাকায় তার আবেদন ১৭৩১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাতিল হয়।[৩৭] এই সময়ে জনসনের পিতা খুবই অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৭৩১ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন।[৩৯] জনসন ইতোমধ্যে মার্কেট বসওয়ার্থে স্যার ওলস্টান ডিক্সি পরিচালিত একটি স্কুলে আন্ডারমাস্টার হিসেবে একটি কাজ পান। ডিক্সি তাকে কোন ডিগ্রি ছাড়াই পড়ানোর সুযোগ দেন।[৪০] যদিও জনসনকে চাকরের মত খাটানো হত,[৪১] তিনি শিক্ষাদানকে বিরক্তিকর বলে মনে করলেও এতে আনন্দ খুঁজে পান। ডিক্সির সাথে তার মতানৈক্যের পর তিনি স্কুল ত্যাগ করেন এবং ১৭৩২ সালের জুন মাসে বাড়ি ফিরে আসেন।[৪২]
জনসন লিচফিল্ড স্কুলে কাজ পাওয়ার অনুসন্ধান চালিয়ে যান। অ্যাশবর্নে একটি কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর তিনি তার বন্ধু এডমান্ড হেক্টরের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। হেক্টর তখন প্রকাশক টমাস ওয়ারেনের বাড়িতে থাকতেন। এই সময়ে ওয়ারেন তার বার্মিংহাম সাময়িকী প্রকাশ শুরু করেন এবং জনসনকে তার সাহায্যের জন্য কাজে লাগান।[৪৩] ওয়ারেনের সাথে এই সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে এবং জনসন তাকে জেরোনিমো লবো'র আবিসিনিয়ান্স-এর অনুবাদের প্রস্তাব করেন।[৪৪] জনসন আবে ইয়োখিম ল্য গ্রাঁ'র ফরাসি অনুবাদ পড়েন এবং ভাবেন সংক্ষিপ্ত সংস্করণই "উপকারী ও লাভজনক" হবে।[৪৫] তিনি নিজে না লিখে হেক্টরকে দিয়ে লেখানোর জন্য পাঠ করতেন। হেক্টর পরে কপিটি মুদ্রণযন্ত্রে নিয়ে যেতেন ও সংশোধন করতেন। এক বছর পর জনসনের আ ভয়েজ টু আবিসিনিয়া প্রকাশিত হয়।[৪৫] তিনি ১৭৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লিচফিল্ডে ফিরে আসেন এবং পেত্রার্ক থেকে পোলিজিয়ানো পর্যন্ত লাতিন কবিতার ইতিহাসের সাথে পোলিজিয়ানোর লাতিন কবিতার টীকাসহ সম্পাদনা করতে শুরু করেন। শীঘ্রই একটি প্রস্তাবনা মুদ্রিত হয়, কিন্তু অর্থায়নের অভাবে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।[৪৬]
জনসন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হ্যারি পর্টারের চরম অসুস্থ্যতার সময়ে তার সাথে ছিলেন,[৪৭] এবং এই অসুস্থ্যতার ফলে ১৭৩৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্টারের মৃত্যু হয়। পর্টারের বিধবা স্ত্রী এলিজাবেথের (প্রদত্ত নাম জার্ভিস; "টেটি" নামেও পরিচিত) বয়স ছিল তখন ৪৫ এবং তার তিন সন্তান ছিল।[৪৮] কয়েক মাস পর জনসন তার প্রণয় প্রার্থনা করে। রেভারেন্ড উইলিয়াম শ দাবী করেন যে সম্ভবত এলিজাবেথই প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন।[৪৯] জনসন এই ধরনের সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু বিত্তবান বিধবা তাকে প্রভাবিত করেন এবং তার বিপুল রক্ষিত সম্পদ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।[৫০] ১৭৩৫ সালের ৯ই জুলাই তারা ডার্বির সেন্ট ওয়েরবুর্গ গির্জায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।[৫১] পর্টার পরিবার এই বিবাহ মেনে নেয়নি, বিশেষ করে তাদের বয়সের ব্যবধানের জন্য, জনসনের তখন ২৫ ও এলিজাবেথের তখন ৪৬ বছর বয়স ছিল। জনসনের সাথে এলিজাবেথের বিবাহে তার পুত্র জার্ভিস এতটাই বিরক্ত হন যে তিনি তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন।[৫২] যাই হোক, তার কন্যা লুসি জনসনকে শুরু থেকেই গ্রহণ করে নেন এবং তার অন্য পুত্র জোসেফও পরবর্তী সময়ে এই বিবাহ মেনে নেন।[৫৩]
১৭৩৫ সালের জুন মাসে স্ট্রাফোর্ডশায়ারের একজন ভদ্রলোক টমাস হুইটবির সন্তানদের গৃহশিক্ষক হিসেবে শিক্ষাদানকালে জনসন সলিহাল স্কুলের প্রধানশিক্ষক পদের জন্য আবেদন করেন।[৫৪] যদিও জনসনের বন্ধু ব্যারিস্টার গিলবার্ট ওয়ালমিসলি তাকে সহায়তা করেন, জনসন পাস করে যান কারণ স্কুলের পরিচালকবৃন্দ মনে করেন যে তিনি "খুবই উদ্ধত, অ-প্রকৃতিস্থ ভদ্রলোক, এবং তার মুখমণ্ডল এমন বিদঘুটে ছিল যে তারা মনে করেন শিক্ষার্থীদের উপর এর প্রভাব পরবে।"[৫৫] ওয়ালমিসলির উৎসাহে জনসন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি যদি তার নিজের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তবে তিনি সফল শিক্ষক হতে পারবেন।[৫৬] ১৭৩৫ সালের শরতে জনসন লিচফিল্ডের নিকটে এডিয়ালে এডিয়াল হল স্কুল নামে একটি প্রাইভেট একাডেমি চালু করেন। তার মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী ছিল, তারা হলেন লরেন্স ওফলি, জর্জ গ্যারিক ও ১৮ বছর বয়সী ডেভিড গ্যারিক, যিনি পরে তার সময়ের অন্যতম খ্যাতিমান অভিনেতা হয়েছিলেন।[৫৫] এই বিদ্যালয়টির প্রকল্পটি ব্যর্থ হয় এবং এতে টেটির অনেক অর্থ ব্যয় হয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানে ব্যর্থ হয়ে এর পরিবর্তে তিনি তার প্রথম বড়সড় লেখনী ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত আইরিন লেখা শুরু করেন।[৫৭] জীবনীকার রবার্ট ডিমারিয়া মনে করেন টুরেট সিনড্রোমের জন্য গণ-পেশা, যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা গৃহ শিক্ষক হিসেবে তার কাজ করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই হয়ত জনসন "লেখনীর মত অদৃশ্য পেশা" গ্রহণ করেন।[১৯]
জনসন ১৭৩৭ সালের ২রা মার্চ তার ভাই মারা যাওয়ার দিন তার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ডেভিড গ্যারিকের সাথে লন্ডন ত্যাগ করেন। তিনি কাছে কোন অর্থ ছিল না এবং এই সফরের ব্যাপারে নিরাশ ছিলেন, কিন্তু তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে লন্ডনে গ্যারিকের জানাশোনা। তারা সেখানে গ্যারিকের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় রিচার্ড নরিসের সাথে থাকার জায়গা করে নেন।[৫৮] জনসন তার আইরিন লেখার কাজ শেষ করতে দ্রুতই গোল্ডেন হার্ট ট্যাভার্নের নিকটবর্তী গ্রেনিচে চলে যান।[৫৯] ১৭৩৭ সালের ১২ই জুলাই তিনি এডওয়ার্ড কেভের নিকট পাওলো সারপি'র দ্য হিস্টরি অব দ্য কাউন্সিল অব ট্রেন্ট (১৬১৯)-এর ভাষান্তরের প্রস্তাবনা পাঠান, কিন্তু এক মাস পরেও কেভ তা গ্রহণ করেননি।[৬০] ১৭৩৭ সালের অক্টোবরে জনসন তার স্ত্রীকেও লন্ডনে নিয়ে আসেন এবং কেভের অধীনে দ্য জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজিন-এ লেখক হিসেবে কাজ পান।[৬১] এই ম্যাগাজিন ও অন্যান্য প্রকাশকদের নিকট থেকে তার কাজ ছিল প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ও অসমান্তরাল এবং "এত বেশি, এত ভিন্নধর্মী ও বিস্তৃত" যে জনসন নিজেই সম্পূর্ণ তালিকা তৈরি করতে পারতেন না।[৬২] জনসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাব্যিক নাম কলাম্বিয়া প্রদান করেন এবং তা ১৭৩৮ সালে দ্য জেন্টলম্যান্স ম্যাগাজিন-এ ব্রিটিশ সংসদের বিতর্ক সম্পর্কিত প্রকাশনায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
১৭৩৮ সালের মে মাসে তার প্রথম বড় কাজ, লন্ডন নামক কবিতা, অজ্ঞাত নামে প্রকাশিত হয়।[৬৩] রোমান কবি ইউভেনালের স্যাটায়ার থ্রি অবলম্বনে রচিত কবিতাটিতে অপরাধ, দুর্নীতি, ও দারিদ্রপীড়িত লন্ডনের সমস্যা থেকে পালাতে টেলস নামক চরিত্রটির ওয়েলস চলে যাওয়ার গল্প বিবৃত হয়েছে।[৬৪] জনসন এই কবিতার জন্য কোন বাহবা পেতে চাননি, তাই কবি হিসেবে তিনি তার নাম যোগ করেননি।[৬৫] আলেকজান্ডার পোপ বলেন, লেখক দ্রুতই বেড়িয়ে আসবেন, কিন্তু পরবর্তী আরও ১৫ বছর তা গোপন ছিল।[৬৩]
আগস্ট মাসে জনসন অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের এমএ ডিগ্রি না থাকার কারণে অ্যাপলবি গ্রামার স্কুলের শিক্ষকের পদ হতে প্রত্যাখ্যাত হন। এই ধরনের প্রত্যাখ্যানের সমাপ্তি টানার জন্য আলেকজান্ডার পোপ তৎকালীন আর্ল জন লেভেসন-গাওয়ারকে তার প্রভাব খাটিয়ে জনসনকে একটি ডিগ্রি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন।[৮] গাওয়ার জনসনকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদানের লক্ষ্যে পিটিশন জারি করেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয় যে "খুব বেশি চাওয়া হয়ে গেছে"।[৬৬] গাওয়ার পরে তার বন্ধু জোনাথন সুইফটের নিকট অনুরোধ করেন তার প্রভাব খাটিয়ে ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনসনকে মার্স্টার্স ডিগ্রি প্রদান করতে, যা অক্সফোর্ডের এমএ ডিগ্রির সমকক্ষ বিবেচিত হবে,[৬৬] কিন্তু জনসনের পক্ষে কথা বলতে নারাজ ছিলেন।[৬৭]
১৭৩৭ থেকে ১৭৩৯ সালের মধ্যে কবি রিচার্ড স্যাভেজের সাথে জনসনের বন্ধুত্ব হয়।[৬৮] টেটির অর্থে জীবনযাপন করছেন এই বিষয়ে দুঃখবোধ করে তিনি তার সাথে বসবাস করা বন্ধ করে দিয়ে স্যাভেজের সাথে সময় কাটাতে থাকেন। তারা দুজনেই দরিদ্র ছিলেন এবং সরাইখানা বা ঘুমানোর ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে রাত্রিযাপন করতেন। কিছু রাত তাদের কাছে অর্থ না থাকার কারণে তারা ভোর হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন।[৬৯] স্যাভেজের বন্ধুরা তাকে ওয়েলসে চলে যাওয়ার কথা বলেন, কিন্তু স্যাভেজ ব্রিস্টলে থেকে যান এবং পুনরায় ঋণে জর্জড়িত হন। ঋণের জন্য তাকে জেলে যেতে হয় এবং ১৭৪৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এক বছর পর জনসন লাইফ অব মিস্টার রিচার্ড স্যাভেজ (১৭৪৪) লিখেন। জীবনীকার ও সমালোচক ওয়াল্টার জ্যাকসন বেটের ভাষায়, "এটি একটি মর্মস্পর্শী কাজ, যা জীবনী সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম উদ্ভাবনী কাজ হিসেবে বিদ্যমান।"[৭০]