হর্ষবর্ধন | |
---|---|
মহারাজাধিরাজ বা সকলোত্তরপথনাথ | |
উত্তর ভারতের শাসক | |
রাজত্ব | আনু. ৬০৬ – আনু. ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ |
পূর্বসূরি | রাজ্যবর্ধন |
উত্তরসূরি | অরুণাস্ব |
জন্ম | ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দ, থানেশ্বর, ভারত[২][৩] |
মৃত্যু | ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ, কনৌজ, ভারত[৪] |
রাণী | পুষ্পবতীএবং রাজা বায়ুসেনের কন্যা দুর্গাবতী |
রাজবংশ | বর্ধন বংশ (পুষ্যভূতি) |
পিতা | প্রভাকরবর্ধন |
মাতা | যশোমতী |
ধর্ম | শৈব, পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম |
হর্ষবর্ধন বা হর্ষ (৫৯০–৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর ভারতের এক খ্যাতনামা সম্রাট যিনি ৬০৬ থেকে ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ (মতান্তরে ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা প্রভাকর বর্ধনের সন্তান ছিলেন।
৬ষ্ঠ শতকের মাঝের দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে উত্তর ভারত ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র ও রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বড় ভাই থানেসারের রাজা রাজ্যবর্ধন গৌড়ের সম্রাট শশাংকের হাতে নিহত হলে ৬০৬ সালে হর্ষকে রাজা ঘোষণা করা হয়; তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। [৫] হর্ষ পাঞ্জাব থেকে মধ্য ভারত পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রগুলোকে একত্রিত করেন। ক্ষমতার শীর্ষে পশ্চিমে পাঞ্জাব থেকে শুরু করে পূর্ব বঙ্গ ও ওড়িশা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নর্মদা নদীর উত্তরে অবস্থিত সমস্ত সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকাতে হর্ষবর্ধনের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। নর্মদার দক্ষিণে রাজ্য বিস্তার করার চেষ্টা করার সময় দক্ষিণে চালুক্য বংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজিত হন ৬১৮-৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে।
হর্ষের রাজত্বে সুশাসন এবং শান্তি বজায় থাকার কারণে বহুদূর দেশ থেকেও বহু শিল্পী , বিদ্বান ব্যক্তি ও ধর্ম প্রচারক তার রাজসভায় সমাদৃত হন। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েনসাঙ্ রাজা হর্ষের রাজসভায় উপনীত হন এবং তার রাজসভার সুবিচার এবং রাজার দানশীলতার সম্বন্ধে প্রশস্তি বাক্য লেখেন নিজের ভ্রমণকাহিনীতে।
হর্ষবর্ধন কবিতা ও নাটক লিখতেন। তিনি নাগানন্দ, প্রিয়দর্শিকা এবং রত্নাবলী নামের তিনটি সংস্কৃত নাটক লেখেন। কনৌজ শহর ছিল হর্ষবর্ধনের রাজধানী এবং এখানে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা হত। বিখ্যাত বাণভট্ট হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন। তিনি হর্ষবর্ধনের জীবনীমূলক গ্রন্থ হর্ষচরিত রচনা করেন; এটি ছিল সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রথম ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ। হর্ষবর্ধন প্রথম জীবনে এক জন শৈব হলেও পরবর্তীকালে তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হন; তিনি ভারতে বহু বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন এবং নালন্দা মহাবিদ্যালয়ে অনেক দান করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজা যিনি চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
৬০৬ খ্রীস্টাব্দের বিপর্যয়ের পরে রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই বৎসর হইতে 'হর্ষাব্দ' গণনা করা হয়। তাঁহার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও এই অব্দ প্রচলিত ছিল।
রাজকীয় ক্ষমতা অর্জনের পর হর্ষের প্রথম কর্তব্য হইল কনৌজের কারাগার হইতে ভগ্নী (গ্রহবর্মনের স্ত্রী) রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করা। তিনি এক বিশাল বাহিনী লইয়া কনৌজ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে কামরূপের (পশ্চিম আসামের) অধিপতি ভাস্করবর্মণের সহিত তাঁহার এক সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এই দক্ষ কূটনৈতিক চালের ফলে শশাঙ্ক পূর্ব ও পশ্চিম, দুই দিক হইতেই আক্রমণের সম্মুখীন হইলেন। ইতিমধ্যে রাজ্যশ্রী কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বিন্ধ্য পর্বতের অরণ্যাঞ্চলে গমন করেন। বহু অনুসন্ধানের পর হর্ষ যখন রাজ্যশ্রীর সন্ধান পাইলেন তখন তিনি তাঁহার সহচরীগণের সহিত অগ্নিতে আত্মবিসর্জন দিতে উদ্যত হইয়াছেন। হর্ষ এবং সম্ভবতঃ তাঁহার মিত্র কামরূপরাজের আক্রমণের ভয়ে শশাঙ্ক কনৌজ পরিত্যাগ করেন।
কবে এবং কিরূপে হর্ষ কনৌজের সিংহাসন লাভ করেন তাহা জানা যায় না। হিউয়েন সাঙের মতে, মৌখরী রাজ্যের মন্ত্রিগণের অনুরোধে হর্ষ কনৌজের সিংহাসন গ্রহণ করেন। গ্রহবর্মনের মৃত্যুর পরে কনৌজের সিংহাসনের কোন উত্তরাধিকারী অবশিষ্ট ছিল না, এই ধারণার বশবর্তী হইয়া কোন কোন আধুনিক ঐতিহাসিক হিউয়েন সাঙের বক্তব্যকে প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু শিলালিপি হইতে জানা যায় যে গ্রহবর্মনের মৃত্যুর পরে মৌখরী বংশীয় একজন রাজা কনৌজে রাজত্ব করেন। সম্ভবতঃ হর্ষের সিংহাসন লাভ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে হয় নাই। হয়ত তিনি রাজ্যশ্রীর নামে সিংহাসন দাবি করেন এবং তাঁহার প্রতিভূ হিসাবে কিছুকাল রাজ্য শাসন করেন। পরে ৬১২ খ্রীস্টাব্দে তিনি প্রকাশ্যে রাজক্ষমতা গ্রহণ করেন।
'হর্ষচরিতে' বানভট্ট লিখিয়াছেন যে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে হর্ষ 'নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পৃথিবীকে গৌড়শূণ্য' করিবার (অর্থাৎ শশাঙ্ককে ধ্বংস করিবার) শপথ গ্রহণ করেন এবং তাহার কয়েক দিন পরে তিনি 'চতুদিক জয়ের' জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন। রাজ্যশ্রীর উদ্ধারের পর হর্ষের শিবিরে প্রত্যাবর্তনেই বানভট্টের বিবরণ সমাপ্ত হইয়াছে। শশাঙ্কের সহিত হর্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং তাঁহার অন্তান্ত সামরিক অভিযানের কোন বিবরণ বানভট্ট লিপিবদ্ধ করেন নাই। হিউয়েন সাঙ হর্ষের দিগ্বিজয়ের যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহা ধোঁয়াটে রকমের সাধারণ কাহিনী মাত্র। কাজেই হর্ষের রাজ্যজয়ের বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় না।
ভাস্করবর্মনের সহিত হর্ষের মিত্রতা সত্ত্বেও শশাঙ্ক অন্ততঃ ৬১৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ণ গৌরবে রাজত্ব করেন। সম্ভবতঃ ইহার বহুকাল পরে তাঁহার মৃত্যু হয়, কারণ ৬৩৭ খ্রীস্টাব্দে হিউয়েন সাঙ তাঁহার মৃত্যুকে সাম্প্রতিক ঘটনা বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার মৃত্যুর পরেই হর্ষ মগধ, গৌড়, উড়িয়া এবং কোঙ্গোদ (উড়িয়্যার গঞ্জাম জেলা) অধিকার করেন। জনৈক চীনদেশীয় লেখকের মতে তিনি ৬৪১ খ্রীস্টাব্দে 'মগধরাজ' উপাধি গ্রহণ করেন।
পশ্চিমে হর্ষ বলভীর অধিপতি দ্বিতীয় ধ্রুবসেনকে পরাজিত করেন। সম্ভবতঃ বলভী তাঁহার সামন্ত রাজ্যে পরিণত হয়। হিউয়েন সাঙ বলিয়াছেন যে বলভীর রাজা হর্ষের কল্লাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।
দক্ষিণে হর্ষ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে আক্রমণ করেন, কিন্তু তাঁহাকে পরাজিত করিতে পারেন নাই। যুদ্ধ কোথায় হইয়াছিল, এবং হর্ষ নর্মদা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন কিনা, তাহা জানা যায় না। উত্তর ভারতের সর্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত শাসককে প্রতিহত করিয়া চালুক্যগণ বিশেষ গৌরব অনুভব করিয়া ছিলেন। তাঁহারা হর্ষকে 'সকলোত্তরাপথনাথ' (সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি) বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু হর্ষ কখনও সমগ্র উত্তরাপথের একচ্ছত্র ঋষিপঞ্জি ছিলেন না।
বানভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ, উভয়েই সিন্ধু প্রদেশের সহিত হর্ষের সম্বন্ধের উল্লেখ করিয়াছেন। সম্ভবতঃ তিনি এই প্রদেশটি আক্রমণ করেন, কিন্তু উহা জয় করিতে পারেন নাই।
সমসাময়িক শিলালিপির সাক্ষ্য এবং হিউয়েন সাঙের বিবরণ হইতে নিঃসন্দেহে জানা যায় যে উত্তর ভারতের অধিকাংশও হর্ষের শাসনাধীন ছিল না। সম্ভবতঃ পাঞ্জাবের পূর্বাঞ্চল, প্রায় সমগ্র উত্তর প্রদেশ, বিহার, বঙ্গদেশের কিছু অংশ, এবং কোঙ্গোদ (গঞ্জাম) সহ উড়িষ্যায় তাঁহার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সৌরাষ্ট্র (কাথিয়াবাড়) এবং কামরূপ (আসাম) তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল কিনা তাহা সন্দেহের বিষয়। উত্তর ভারতের সমসাময়িক সকল শাসকই তাঁহার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রাধান্য স্বীকার করিতেন, কিন্তু তাঁহাকে প্রাচীন ভারতের শেষ সাম্রাজ্য-সংস্থাপক বলিয়া ধারণা করিবার কোন কারণ নাই।
হর্ষ চীনের সহিত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ৬৪১ খ্রীস্টাব্দে তিনি চীনের ভাঙ বংশীয় সম্রাট তাই-সুঙের নিকট একজন ব্রাহ্মণ দূত প্রেরণ করেন। পরে চীনা দূতগণ তিন বার তাঁহার রাজসভায় আসিয়াছিলেন।
Thanesar near Kurukshetra , is the birthplace of the ruler Harsha Vardhana ( 590-647)...
২। International Dictionary of Historic Places: Asia and Oceania by Trudy Ring, Robert M. Salkin, Sharon La Boda p. 507