আমুল ফীল (আরবি: عام الفيل; হাতির সাল বা হাতির বছর) বা হস্তিবর্ষ হলো আনুমানিক ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামী ইতিহাসে সঙ্ঘটিত একটি ঘটনার সময়কাল। ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী, এটি সে বছরে সঙ্ঘটিত হয়, যে বছরে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ জন্মগ্রহণ করেন।[১] নামটির আগমন ঘটেছে মক্কায় সঙ্ঘটিত কথিত[২] একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে: যা ছিল আবরাহা নামক ইয়েমেনের তৎকালীন সম্রাটের বিশাল সৈন্যবাহিনী সহ মক্কা আক্রমণ[৩][৪] এবং সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির আক্রমণের মাধ্যমে উক্ত সেনাবাহিনীকে[৫] পরাস্তকরণ। ঘটনাটি মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের সুরা ফিলে আংশিক বর্ণিত হয়েছে।
আনুমানিক ৫২৫ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ইয়েমেনের শাসক ছিলেন ইহুদী সম্রাট জুনাওয়াস এবং আবিসিনিয়ার তৎকালীন শাসক ছিলেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। অপরদিকে রোমান সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। ইয়েমেনের ইহুদী শাসক জুনাওয়াস খ্রিস্টধর্মের অনুসারীদের উপর চরম নির্যাতন শুরু করে, এক পর্যায়ে খ্রিস্টধর্মের অনেক অনুসারীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যের সহায়তায় আবিসিনিয়ার সরকার ইয়েমেনে আক্রমণ চালায়। সেকালে আবিসিনিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠিত নৌ বাহিনী ছিলনা। রোমান নৌ বাহিনীর সহায়তায় আবিসিনিয়া নিজেদের ৭০ হাজার সৈন্য ইয়েমেনের উপকূলে নামিয়ে দিতে সক্ষম হয়। পূর্ব আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়াসহ দূর প্রাচ্যের সাথে চলমান ব্যবসার উপর শত শত বছর ধরে আরবদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। আর এর জন্য ইয়েমেন ছিল কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আরবদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করে এই ব্যবসায় নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করাই ছিল এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য।
ইয়েমেনের উপর আবিসিনিয়ার যে সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করে, আরইয়াত ছিল সেনাপ্রধান আর আবরাহা ছিল সেই বাহিনীর একজন যোদ্ধা। পরবর্তীকালে আরইয়াত এবং আবরাহার মধ্যে ক্ষমতা দখল নিয়ে যুদ্ধ বেধে যায় এবং যুদ্ধে আরইয়াত নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত আবরাহা গোটা ইয়েমেন দখল করে বসে। অতঃপর সে নিজেকে ইয়েমেনে নিযুক্ত আবিসিনিয়া সরকারের গভর্নর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইয়েমেনে নিজের ক্ষমতা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করে আবরাহা একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজ করতে শুরু করে। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই রোমান সাম্রাজ্য এবং আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান সরকারের সেই উদ্দেশ্যই বিদ্যমান ছিল। আর তা হলো একদিকে আরবে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা আর অন্য দিকে দূর প্রাচ্যের ভারতবর্ষ ও রোমান অধিকৃত অঞ্চলে আরবদের পরিচালিত ব্যবসা সম্পূর্ণ করায়ত্ত করা। এই উদ্দেশ্যে আবরাহা ইয়েমেনের রাজধানী সানায় একটি বিরাট গির্জা নির্মাণ করল। ঐতিহাসিকগণ এর নাম লিখেছেন “আল-কালিস” এই কাজটি সুসম্পন্ন করার পর সে আবিসিনিয়ার সম্রাটকে লিখল যে– “আমি আরবদের হজ্জ অনুষ্ঠান মক্কার কাবা হতে সানার এই গির্জায় স্থানান্তরিত না করে ছাড়বনা।” ইয়েমেনে সে এই কথা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করল এবং চারদিকে এই কথা প্রচার করতে লাগলো। তার এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল আরবদের রাগান্বিত করা, কারণ আরবরা যদি রাগান্বিত হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে সে এটাকে উপলক্ষ বানিয়ে মক্কায় আক্রমণ চালানোর এবং কাবাগৃহ বিধ্বস্ত করার সুযোগ পাবে। তার পরিকল্পনা সফল হয়। কুরাইশদের কিছু যুবক একত্রিত হয়ে তার এই গির্জায় আগুন ধরিয়ে দেয় অথবা গির্জার ভিতর মলমূত্র ত্যাগ করে। এই ধরনের কোনো ঘটনা যদি আদৌ ঘটে থাকে তবে তা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তার এই ঘোষণাটি ছিল চরম উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। তবে, কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, আবরাহা নিজেই নিজেদের লোক দ্বারা এই ধরনের কাণ্ড ঘটায় উত্তেজনা তৈরি করে আরব আক্রমণের বাহানা তৈরি করার জন্য।
অতঃপর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে আবরাহা ৬০ হাজার সৈন্য ও ১৩ টি হাতি নিয়ে মক্কার দিকে যাত্রা করে[৬][৭]।
পথিমধ্যে বেশ কয়টি আরব গোত্র আবরাহা বাহিনীর গতিরোধ করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। এ সেনাদল মক্কার কাছাকাছি পৌঁছে একটি অগ্রবর্তী দল প্রেরণ করে। কুরাইশ গোত্রের প্রধান ছিল তখন মুহাম্মাদের পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব। এ অগ্রবর্তী দল আব্দুল মুত্তালিবের প্রায় দুইশত উট লুট করে নিয়ে যায়। আবরাহা একজন দূতের মাধ্যমে কুরাইশ প্রধান আব্দুল মুত্তালিবকে ডেকে পাঠায়। আব্দুল মুত্তালিব আবরাহার সাথে দেখা করতে যায়। আব্দুল মুত্তালিব দেখতে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। আবরাহা তাকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়। আলাপচারিতা শুরু হবার পর আব্দুল মুত্তালিব তার দুইশত উট ফেরত চায়। আবরাহা বললেন– “আপনাকে দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এই কথায় আমার নিকট আপনার আর কোন মর্যাদা রইলনা। কারণ, আপনি আপনার উটগুলো ফেরত চাইলেন কিন্তু আপনার এবং আপনার বাপ দাদার ধর্মের কেন্দ্রস্থল কাবা ঘর রক্ষার ব্যাপারে আপনি কিছুই বললেননা।” জবাবে আব্দুল মুত্তালিব বললেন – “উটের মালিক আমি, তাই আমি উট ফেরত চাইলাম। এই ঘরের মালিক আল্লাহ। আল্লাহই এই ঘর রক্ষা করবেন। আপনার বাহিনীর মোকাবিলা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।”[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
আব্দুল মুত্তালিব আবরাহার সেনানিবাস হতে ফিরে কুরাইশদেরকে সাধারণ হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে বাঁচার জন্য পর্বতমালায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বললেন। অতঃপর তিনি আরও কয়েকজন কুরাইশ সরদারকে সাথে নিয়ে কাবা শরীফে উপস্থিত হলেন এবং কাবার দরজার কড়া ধরে এক সৃষ্টিকর্তা (আল্লাহ)'র নিকট দোয়া করলেন, তিনি যেন রক্ষা করেন। তখনও কাবার ভিতর ৩৬০ টি মূর্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এই কঠিন সময়ে তারা কেবল এক আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিল।
পরের দিন আবরাহা মক্কায় প্রবেশের জন্য অগ্রসর হল। কিন্তু তার নিজের হাতি সহসা বসে পরল[৬][৮]। হাতিটিকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে চালানোর চেষ্টা করলে উহা দৌড়াতে শুরু করে কিন্তু মক্কার দিকে চালানোর চেষ্টা করলে তা সাথে সাথে বসে পড়ত। এই সময় হঠাৎ ঝাকে ঝাকে পাখি চঞ্চু ও পাঞ্জায় পাথরকুচি নিয়ে উড়ে আসে এবং কাবা আক্রমণকারী আবরাহা বাহিনীর উপর পাথরকুচির বৃষ্টি বর্ষণ করতে থাকে। এই পাথরকুচির আঘাতে আবরাহার বাহিনীর সৈন্যদের শরীরের মাংসপেশী খসে পড়তে শুরু করে এবং তারা চর্বিত ভুষির ন্যায় পরিণত হয়। এইরুপ অবস্থায় তারা নিরুপায় ও পাগলপারা হয়ে ইয়েমেনের দিকে পালাতে শুরু করে। এইভাবে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে তারা নানা জায়গায় পড়ে মরতে লাগলো অথবা মরে পড়তে লাগলো। এই ঘটনা সঙ্ঘটিত হয় মুজদালিফা ও মিনার মাঝখানে মুহাসসির নামক স্থানে।
মক্কার কোন কোন লোকের নিকট দীর্ঘদিন এই পাথরকুচির নমুনা সংরক্ষিত ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই ঘটনা সঙ্ঘটিত হবার ৩/৪ বছরের মধ্যে ইয়েমেন থেকে আবিসিনিয়া সরকারের পতন ঘটে। যে বছর এ ঘটনা সঙ্ঘটিত হয় সেই বছরটিকে আরবরা “হস্তী বর্ষ” নামে অভিহিত করে। মুহাম্মাদের জন্মও এই বছরে সম্পন্ন হয়[৭]। উল্লেখ্য, এ ঘটনার পর কুরাইশরা প্রায় ১০ বছর এক সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহ ব্যতীত আর কারও ইবাদত করেনি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের সুরা ফীল নামক সুরায় এই ঘটনাটি সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা পাওয়া যায়।
অনুবাদ
This elephant was called Mahmud and it was sent to Abrahah from Najashi, the king of Abyssinia, particularly for this expedition.
[T]he lead elephant, named Mahmud, stopped and knelt down, refusing to go further.