হাকিম আজমল খান | |
---|---|
জন্ম | [১][২] | ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৮
মৃত্যু | ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ |
জাতীয়তা | ভারত |
পেশা | চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ |
আজমল খান (বা হাকিম আজমল খান) (১৮৬৮–১৯২৭) ছিলেন একজন ভারতীয় চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ইউনানি চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। দিল্লীতে তিবিয়া কলেজ স্থাপনের কারণে তাকে বিশ শতাব্দীতে ভারতে ইউনানি চিকিৎসার পুনর্জাগরণের কৃতিত্ব দেয়া হয়। মহাত্মা গান্ধীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, খিলাফত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯২১ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি দলের পঞ্চম[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] মুসলিম প্রেসিডেন্ট হন।[৩]
হাকিম আজমল খান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ১৯২০ সালে তিনি এর প্রথম আচার্য হন। ১৯২৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।[৪]
হাকিম আজমল খান ১৮৬৮ সালে (১৭ শাওয়াল ১২৮৪ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার মুঘল সম্রাট বাবরের সময় থেকে চিকিৎসা চর্চা করে আসছিল। তার পরিবারে ইউনানি চিকিৎসা চর্চা হত। তারা দিল্লীর সম্ভ্রান্ত বলে পরিচিত ছিলেন। তার দাদা হাকিম শরিফ খান মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের চিকিৎসক ছিলেন। তিনি শরিফ মঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে চিকিৎসার পাশাপাশি ইউনানি চিকিৎসা শিক্ষা দেয়া হত।[৫][৬]
আজমল খান কুরআন অধ্যয়ন করেন। শৈশবে তিনি প্রথাগত ইসলামি জ্ঞান অর্জন করেন এবং আরবি ও ফারসি শেখেন। এরপর বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শিক্ষালাভ করেন। তাদের সবাই পরিচিত চিকিৎসক ছিলেন। ইউনানি চিকিৎসার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তার দাদা শরিফ মঞ্জিল নামক হাসপাতাল ও চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্র থাপন করেছিলেন। উপমহাদেশজুড়ে তা সেরা ইউনানি চিকিৎসালয়গুলোর অন্যতম ছিল। এখানে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হত।[৭] দিল্লীর সিদ্দিকি দাওয়াখানার হাকিম আবদুল জামিলের তত্ত্বাবধানে তিনি তার ইউনানি শিক্ষা সমাপ্ত করেন।[৭]
হাকিম আজমল খান রামপুরের নবাবের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। তাকে "মসিহায়ে হিন্দ" (ভারতের সুস্থকারক) এবং "মুকুটোবিহীন রাজা" বলা হত। পিতার মত তিনিও চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বলা হত যে তিনি রোগীর চেহারা দেখে রোগ বুঝে নিতে পারতেন। শহরের বাইরে যেতে হলে তিনি ১০০০ রুপি নিতেন। তবে রোগী যদি দিল্লীতে আসে তবে তার সামাজিক অবস্থা বিবেচনা না করে বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন।
আজমল খান তার সময় ভারতের স্বাধীনতায় অবদান রাখা ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবেচিত হতেন। স্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে তার অবদান অতুলনীয় ছিল।
ইউনানি চিকিৎসাপদ্ধতির দেশীয় প্রক্রিয়ার বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য তিনি উদ্যোগী হন। তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এগুলো হল দিল্লীর সেন্ট্রাল কলেজ, হিন্দুস্তানি দাওয়াখানা ও আয়ুর্বেদিক এন্ড ইউনানি তিবিয়া কলেজ। এসব প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চর্চা করা হত ফলে ভারত থেকে ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়।[৮][৯] আজমল খান ইউনানি প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্য চিকিৎসার ধারণা গ্রহণের প্রস্তাব করে। তবে এই প্রস্তাব অনেকের কাছে গ্রহণীয় ছিল না। তারা প্রক্রিয়ার বিশুদ্ধতা রক্ষার পক্ষে ছিলেন।[১০]
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হাকিম আজমল খান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য হন। আমৃত্যু তিনি এ পদে ছিলেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়কে আলিগড় থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নেয়া হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা, (যেমন অর্থনৈতিক) দূর করতে সাহায্য করেন। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং নিজ অর্থেও প্রতিষ্ঠানের অর্থসমস্যা দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন।[১১][১২]
হাকিম আজমল খান চিকিৎসা থেকে তার মনোযোগ রাজনীতির দিকে নিয়ে আসেন। এসময় তিনি উর্দু সাপ্তাহিক আকমল উল আখবার এ লেখা শুরু করেন। এই পত্রিকা তার পরিবার কর্তৃক চালু করা হয়েছিল। ১৯০৬ সালে শিমলায় ভারতের ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাত করা মুসলিম দলে তিনি নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধিদল কর্তৃক লিখিত মেমোরেন্ডাম ভাইসরয়কে উপস্থাপন করা হয়। পরের বছর ১৯০৬ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। অনেক মুসলিম নেতা গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হলে তিনি সাহায্যের জন্য গান্ধীর দিকে অগ্রসর হন এবং এর মাধ্যমে খিলাফত আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যান্য মুসলিম নেতা যেমন আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মুহাম্মদ আলি, মাওলানা শওকত আলিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এছাড়া হাকিম আজমল খান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এবং নিখিল ভারত খিলাফত কমিটির প্রধান হওয়া একমাত্র ব্যক্তি।
১৯২৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর হাকিম আজমল খান হৃদযন্ত্রের সমস্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার সরকারি উপাধি ত্যাগ করেন। তার অনেক ভারতীয় অনুসারী তাকে মসিহুল মুলক (জাতির সুস্থকারক) বলে উপাধি দেয়। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় তার স্থলে মুখতার আহমেদ আনসারি স্থলাভিষিক্ত হন।[১৩]
দেশবিভাগের পরে হাকিম আজমল খানের নাতি হাকিম মুহাম্মদ নবি খান পাকিস্তানে চলে আসে। তিনি তার দাদার কাছ থেকে চিকিৎসা শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। লাহোরে তিনি "দাওয়াখানা হাকিম আজমল খান" চালু করেন। পাকিস্তানজুড়ে এর শাখা রয়েছে।
আজমল খানের নাম উপমহাদেশের ভেষজ চিকিৎসার সাথে বহুলভাবে জড়িত। আধুনিক চিকিৎসার পূর্বে তার পরিবার চিকিৎসার সাথে জড়িত ছিল। দাওয়াখানা হাকিম আজমল খান প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি তাদের পরিবার কর্তৃক পরিচালিত হয়।[১৪]