হাদিসের সমালোচনা হল ইসলামী নবী মুহাম্মদের কথাবার্তা, কর্মকাণ্ড এবং নীরব সম্মতির রেকর্ডকৃত বর্ণনাসমূহের, অর্থাৎ হাদিসের, সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ।[১]
প্রধানধারার ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে, মুহাম্মদের সুন্নাহ - বা শিক্ষা এবং কার্যাদি - কুরআনের মতই ঐশ্বরিক দিকনির্দেশনা ও অনুসরণীয়। তবে, শরিয়া (ইসলামী আইন) এর অধিকাংশ নিয়মাবলী কুরআনের থেকে বরং হাদিস থেকে উদ্ভূত। অন্যদিকে হাদিস অস্বীকারকারীরা (Quranists), হাদিসের কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বিশ্বাস করে যে কুরআন ছাড়া হাদিসের কোনো ভিত্তি নেই। মুহাম্মদকে মান্য করা মানে তারা মনে করে শুধুমাত্র কুরআনের আনুগত্য করা। এমনকি কেউ কেউ দাবি করেন যে অধিকাংশ হাদিস বানোয়াট; ৮ম এবং ৯ম শতাব্দীতে রচিত এবং ভুলভাবে মুহাম্মদের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে খারিজিদের কিছু সম্প্রদায়ও হাদিস প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্যদিকে মুতাজিলা সম্প্রদায় ইসলামি আইনের ভিত্তি হিসেবে হাদিস অস্বীকার করলেও সুন্নাহ এবং ইজমা (ঐকমত্য) গ্রহণ করতো।[২]
হাদিসের সমালোচনা বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। জাল হাদিসগুলো বাদ দেওয়ার জন্য এবং ক্লাসিক্যাল হাদিস সংকলনে সংকলিত খাঁটি ("সাউন্ড" বা সহিহ) হাদিসের একটি "কোর" প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামের শাস্ত্রীয় হাদিস বিজ্ঞান তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ এবং ইসলামের কিছু শাখা যুক্তি দেখায় যে এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট হয়নি। তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে - প্রতিটি প্রারম্ভিক প্রজন্মের সাথে হাদিসের সংখ্যা সন্দেহজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; প্রচুর সংখ্যক হাদিস একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক; এবং ইসলামি আইনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে এদের অবস্থান জাল হাদিস তৈরির প্রেরণা যুগিয়েছে।[৩]
এই সমালোচকরা বিভিন্ন মতের – যেমন, হাদিস বিজ্ঞানের কৌশলগুলিকে গ্রহণ করলেও বিশ্বাস করেন যে এর আরও "কঠোর প্রয়োগ" প্রয়োজন (সালাফি জামাল আল-দিন আল-কাসিমি) এবং শরিয়া আইন হালনাগাদ এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রস্তুতির জন্য এটি জরুরি। আবার কেউ বিশ্বাস করেন সুন্নাহ অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ভিত্তিসম্পন্ন হাদিস আছে মাত্র একটি মুষ্টিমেয় (বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সৈয়দ আহমদ খান)। এছাড়াও আছেন সম্পূর্ণ "হাদিস অস্বীকারকারীরা" যারা বিশ্বাস করেন হাদিস সুন্নাহর অংশ নয় এবং মুসলিমদের আনুগত্য শুধুমাত্র কুরআনের জন্য প্রযোজ্য (বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদীগণ আসলাম জয়রাজপুরী এবং গোলাম আহমেদ পারভেজ)।[৪]
ইসলামী আইনের সর্বপ্রথম মতাদর্শ ও আলেমগণ—মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর দেড় শতাব্দীর কাছাকাছি সময় থেকে—ভবিষ্যতবাণীমূলক সুন্নাহর গুরুত্ব এবং এর ভিত্তি, অর্থাৎ হাদিসের ব্যাপারে একমত ছিলেন না। মতামতের মধ্যে পার্থক্য ছিল। কেউ কেউ (আহল-আল-রায়) মনে করতেন, ভবিষ্যতবাণীমূলক হাদিস আইনের একটি উৎস, কিন্তু একমাত্র উৎস নয়, এর পাশাপাশি খলিফাদের ঐতিহ্য বা মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবীদের কথাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। আবার অন্যরা (আহল-আল-কালাম বা যুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক) হাদিসের ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে সরাসরি হাদিস প্রত্যাখ্যান করতেন।
সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে (৭৬৭-৮২০ খ্রিস্টাব্দে) আল-শাফেয়ী, যিনি ইসলামী আইনের শাফেয়ী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি ভবিষ্যতবাণীমূলক হাদিসের ঐতিহ্যকে সমুন্নত করেন এবং ইসলামিক আইন বা ফিকহের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই চিন্তাধারা অনুসারে, নবীর হাদিস অন্যান্য সমস্ত হাদিসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে, সেই সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ঐকমত্য ছিল না বলেই মনে হয়, কারণ আল-শাফেই'কে অন্যান্য মতের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। মৌখিকভাবে প্রচলিত হওয়ায় হাদিসের বিশ্বাসযোগ্যতাকে যারা সমালোচনা করতেন, আল শাফেয়ী যুক্তি দেখাতেন, আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল মানুষ নবীকে অনুসরণ করুক, তাই আল্লাহ নিশ্চিত করেছেন যে এই ঐতিহ্য অবিকৃত থাকবে।
সুন্নাহ ঐশী বাণী বা ওহীর একটি উৎস এবং শাস্ত্রীয় ইসলামী আইন (শরিয়া) এর ভিত্তি হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কুরআনে আইন সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে বিধায় সুন্নার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, গোসল বা ওজু, নামাজের সঠিক পদ্ধতি, সঠিক অভিবাদন, দাসদের প্রতি সদয়তার গুরুত্ব—কোরআনে এগুলোর বিস্তারিত বিবরণ নেই। আল শাফেয়ীর সওয়ালের ফলে হাদিসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেলেও, আগের যুক্তিবাদী মনোভাবের ধারাবাহিকতায় কিছুটা সংশয়বাদ অব্যাহত থাকে।
হাদিস শাস্ত্র (`ʻilm al-ḥadīth) এর উদ্দেশ্য হলো বিশ্বস্ত বা "সহিহ" এবং অবিশ্বস্ত হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করা, যাতে পূর্বেরটিকে (সহিহ হাদিস) ইসলামিক অনুশীলন ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করা যায়। ইসলামের তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যেই এই অনুশীলন একটি পরিপক্ক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। হাদিস শাস্ত্র আল-শাফিয়ী কর্তৃক নবী মুহাম্মদের হাদিসকে অগ্রাধিকার দেওয়াকে সমর্থন করতে সহায়তা করেছিল, যেটি পরবর্তীতে ইসলামি আইনের প্রাথমিক উৎস হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে "মতাদর্শিক" হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে।
হাদিস শাস্ত্রকে ব্যাপক আকারের জাল হাদিস মোকাবেলা করার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মুহাম্মদ আল-বুখারী দাবি করেছিলেন যে, তিনি যে ৬,০০,০০০ হাদিস যাচাই করেছেন তার মধ্যে মাত্র ~৭,৪০০ বর্ণনাই তার অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড পূরণ করেছে। এমনকি সেই ৭,৪০০ এর মধ্যেও একটি বড় অংশ ছিল একই বর্ণনার ভিন্নতা, শুধুমাত্র বর্ণনাকারীদের শিকলের (ইসনাদ) পার্থক্যসহ। হাদিসের সত্যতা (সিহ্হা) প্রতিষ্ঠার মানদণ্ড ছিল ভিন্ন বর্ণনাকারীদের থেকে একই প্রতিবেদনের সমর্থন, শিকলে তালিকাভুক্ত বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা এবং চরিত্রের মূল্যায়ন (যদিও মুহাম্মদের সাহাবীদের, তাদের মুহাম্মদের সাথে সাহচর্য তাদের চরিত্র এবং যোগ্যতাকে অবিলম্বে নিশ্চিত করায়, এই মূল্যায়ন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল) এবং শিকলে ফাঁকের অনুপস্থিতি। অর্থাৎ, হাদিসের ত্রুটিগুলো বর্ণনাকারীদের চরিত্র (`আদালা) বা যোগ্যতা (দাবিথ) এর অভাবের সাথে সম্পর্কিত বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এটাও মনে করা হতো যে এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনাকারীদের চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং ইসনাদ ছিল একটি ঐতিহ্যের বর্ণনার ইতিহাসের সরাসরি প্রতিফলন। কোনো বর্ণনার বিষয়বস্তুর (মতন) চেয়ে, ইসনাদের ওপর মূল্যায়ন বেশি নিবদ্ধ ছিল।
সুন্নি মুসলমানদের জন্য হাদিসের প্রধান সংকলনগুলি কুতুব আল-সিত্তাহ ("ছয়টি বই") নামে পরিচিতি লাভ করে, যার মধ্যে মুহাম্মদ আল বুখারির সহিহ আল-বুখারি, সহীহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, জামি আল তিরমিযী, সুনান আল-নাসাই, এবং সুনান ইবনে মাজাহ অন্তর্ভুক্ত।