স্যার হামফ্রে ডেভি (ইংরেজি - Sir Humphry Davy) একজন আবিষ্কারক এবং প্রখ্যাত রসায়নবিদ। তিনি একাধিক ক্ষার ধাতু এবং মৃৎ ক্ষার ধাতু আবিষ্কার করেছেন।[১]
হামফ্রে ডেভি | |
---|---|
জন্ম | 17 December 1778 কর্নওয়াল, ইংল্যান্ড |
মৃত্যু | 29 May 1829 (aged 50) |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ |
ডেভি ব্রিটেনের কর্নওয়ালে ১৭৭৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।[২] নয় বছর বয়সে ডেভি পরিবারের সঙ্গে কর্নওয়াল থেকে ভারফেলে চলে আসেন। তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন ট্রুরু গ্রামার স্কুলে। ১৭৯৪ সালে পিতার দেহান্তরের পর ডেভি, জন বিঙ্ঘহাম বোরলাসে নামক এক চিকিৎসকের সাথে কাজ শুরু করেন। ১৭ বছর বয়স থেকে ডেভি কবিতা লেখা শুরু করেন।[২]
ডেভিস গিলবার্ট নামের এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার, ডঃ বোরলাসের বাড়িতে ডেভির বক্তৃতা শুনে ডেভিকে বলেন তার বাড়ির পুস্তকালয় ব্যবহার করতে। এরপর ডেভির সাথে আলাপ হয় ডঃ এডওয়ার্ডস নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যিনি সেন্ট বার্থোলোমিউ হাসপাতালে রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। ডঃ এডওয়ার্ডস ডেভিকে তার নিজের গবেষণাগার ব্যবহারের অনুমতি দেন এবং সম্ভবত তিনিই তাকে হ্যালে বন্দরের ভগ্নায়মান দশার কথা উল্লেখ করেন।[৩] হ্যালে বন্দর সেই সময় ক্ষয়ীভূত হচ্ছিল তামা এবং লোহা সমুদ্রের জলের সংস্পর্শে আসায়। সেই সময় গ্যাল্ভানিক ক্ষয়ের কথা জানা না থাকলেও, ডেভি সমুদ্রের জলের সংস্পর্শে তামার পাতে কি প্রভাব পড়ে তার পরীক্ষা শুরু করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তামার সাথে ঢালাই লোহার মিশ্রণ ব্যবহার করলে তাম্র পাতের ক্ষয় রোধ করা যাবে।[৪]
১৭৯৮ সালের ২রা অক্টোবর ডেভি ব্রিস্টলের নিউমেটিক ইনস্টিটিউশানে (Pneumatic Institution) ডঃ বেডোসের বিভিন্ন গবেষণায় সহযোগীতা করার জন্যে যোগ দেন। তিনি মূলত নিউমেটিক ইনস্টিটিউশানের জন্য ভোল্টাইক ব্যাটারির তৈরী করছিলেন।
এই সময় ডেভির সাথে জেমস ওয়াট, তার পুত্র গ্রেগরি ওয়াট, স্যামুয়েল টেলর কোলেরিজ এবং রবার্ট সাউদির সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব স্থাপন হয়। এদের সবাই ডেভির সাথে নিয়মিত নাইট্রিক অক্সাইড (লাফিং গ্যাস) সেবন করতেন। ডেভি এই সময় উল্লেখ করেন যে এই গ্যাস চিকিৎসা বিজ্ঞানে চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, চিকিৎসাবিদ্যায় চেতনানাশকের ব্যবহার ডেভির মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরে শুরু হয়।[৫] এই সময় "ওয়েস্ট কান্ট্রি কালেকশান" পুস্তকের প্রথম সংস্করন প্রকাশিত হয়। এতে ডেভির গবেষণা ভিত্তিক অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। এইসব লেখার বিষয়বস্তু ছিলঃ "তাপ, আলো এবং এদের সমন্বয়", "ফসফরাস, অক্সিজেন এবং এদের সমন্বয়", "শ্বসনের তত্ত্বাবলী" ইত্যাদি।[৩]
ডেভি ১৮০১ সালে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশানে যোগ দান করেন রসায়ন বিদ্যার প্রফেসর হিসেবে। ১৮০৪ সালে ডেভি রয়েল সোসাইটির সদস্য পদ পান। ১৮০৭ সালে জিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্যর হামফ্রে ডেভি। ১৮১০ সালে ডেভি রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের বিদেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৮১২ সালে নাইট্রোজেন ট্রাই ক্লোরাইড এর বিষক্রিয়ায় দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। ঐ বছরেই ডেভি রয়েল ইন্সটিটিউশানে শেষ বক্তব্য রাখেন এবং অবসর গ্রহণ করেন। যদিও তিনি গবেষণা বন্ধ করেন নি। তার গবেষণায় সাহায্যের জন্যে তিনি মাইকেল ফ্যারাডেকে সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
ডেভি দীর্ঘদিন ভোল্টাইক ব্যাটারি এবং তড়িৎ বিশ্লেষণের ওপর কাজ করেছেন। তড়িৎ বিশ্লেষনের সাহায্যে অনেক যৌগকে ভেঙ্গে তিনি বিভিন্ন মৌল আবিষ্কার করেন। ডেভি ১৮০৭ সালে পটাশিয়াম ধাতু আবিষ্কার করেন পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড থেকে।[৬] ডেভি এরকম আরো কিছু ক্ষারীয় ধাতু, মৃৎ ক্ষারীয় ধাতু এবং হ্যালোজেন আবিষ্কার করেন।[৭] ডেভির আবিষ্কৃত মৌলগুলি হলঃ সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বেরিয়াম, বোরন ইত্যাদি।[৮]
ক্লোরিন এবং আয়োডিন মৌলের সনাক্তকরনেও ডেভির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৭৭৪ সালে সুইডেনের বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম স্কিলি (Carl Wilhelm Scheele) ক্লোরিন আবিষ্কার করলেও, তিনি একে একটি অম্ল ভেবে ভুল করেন। ডেভি তার পরীক্ষা দ্বারা অক্সিজেনের অনুপস্থিতি প্রমাণ করেন এবং এই মৌলিক গ্যাসের নাম দেন ক্লোরিন। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গে লুসাকের অনুরোধে ডেভি, আরেক রসায়নবিদ বার্নার্ড কোর্টোইশের আবিষ্কৃত এক রহস্যজনক পদার্থকে মৌল পদার্থ হিসেবে শনাক্ত করেন এবং নাম দেন আয়োডিন।
অবসর গ্রহণের পর ডেভি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যান।[৯] ব্রিটেনে ফিরে আসার পর তিনি কয়লাখনিতে ব্যবহারযোগ্য বাতির ওপর কাজ শুরু করেন। কারণ, কয়লাখনিতে উৎপন্ন মিথেন এবং অন্যান্য দাহ্য গ্যাস আগুনের উপস্থিতিতে এসে বিস্ফোরনের এবং প্রানহানির প্রবণতা বৃদ্ধি করে। ১৮১৫ সালে তিনি সফল ভাবে ডেভি ল্যাম্প আবিষ্কার করেন।[৫]
এছাড়াও তিনি অম্ল এবং ক্ষারের ওপর বিস্তারিত ভাবে গবেষণা করেন। ১৮১৫ সালে তিনি বলেন, অম্ল হল সেই বস্তু যাতে প্রতিস্থাপন যোগ্য হাইড্রোজেন আয়ন থাকে, যা আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে ধাতু্র উপস্থিতিতে প্রতিস্থাপন করা যাবে। অম্লের সঙ্গে ধাতুর বিক্রিয়ার লবণ এবং অম্লের সাথে ক্ষারের বিক্রিয়ার লবণ ও জল উৎপন্ন হয়।[১০]
ডেভি জীবনের শেষ সময়ে আবার কবিতা এবং প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। তার লেখাতে ভ্রমণ কাহিনী থেকে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিভিন্ন চিন্তাধারা ধরা পড়েছে।[১১] এই সকল লেখনী তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় এবং প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮২৯ সালে ৫০ বছর বয়সে ডেভি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের এক হোটেলে দেহ ত্যাগ করেন।