বাঙালি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে হামুদুর রহমান কমিশন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সামরিক ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করে।[১] এই কমিশন ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সরকার প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে গঠন করা হয়।[১]
এই কমিশনকে "গণহত্যা এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক সকল ঘটনা এবং অবস্থার পুর্নাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি" এবং সেই সঙ্গে "পূর্ব হাইকমান্ডের কমান্ডার কোন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে" সেটাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়। "[১]
এই কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে অনেক বেশি সময় নেয় এবং বিশ্লেষণভিত্তিক অনেক বেশি সাক্ষ্য এবং প্রমাণ উপস্থাপন করে। এতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দেয় যে,পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অযাচিত অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, রাজনীতিবিদদের অসদাচরণ এবং সেই সঙ্গে আইএসআই এবং ফেডারেল গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা, যার ফলে ভারতীয় গুপ্তচরেরা পূর্ব পাকিস্তানসহ সকল সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছিল।[২]
মূলত, রিপোর্টটির ১২ টি কপি ছিল। সরকারকে দেয়া একটি কপি ছাড়া সকল কপি ধ্বংস করা হয় এবং সরকার ঐ সময়ে সেটি প্রকাশ করেনি। ২০০০ সালে এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ফাঁস হয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ২০০০ সালে সরকার ১৯৭১ সাল কেন্দ্রিক অন্যান্য রিপোর্টসহ এই রিপোর্ট সম্পূর্ণ প্রকাশ করে।[১]
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে "গণহত্যা এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক সকল ঘটনা এবং অবস্থার পুর্নাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি" এবং সেই সঙ্গে "পূর্ব হাইকমান্ডের কমান্ডার কোন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে" সেটাও খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। এবং সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে জম্মু এবং কাশ্মীরে যুদ্ধ নিয়েও প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এই কমিশন গঠন করা হয় ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন বাংগালি বংশভুত প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে। [৩]
প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতি ভবনে জমা দেন এবং যেটি ভুট্টো পর্যালোচনা করেন। কমিশন এই প্রতিবেদনকে সম্ভাব্য মনে করে কারণ এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়নি যারা ঐ সময়ে ভারতে বন্দি ছিল।[৫] কমিশন বর্ণনা করে " পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয় এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তা পরিবর্তিত হতে পারে।" প্রাথমিকভাকে কমিশন ২১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং প্রতিবেদনের ১২ টি কপি তৈরি করে। প্রতিবেদনের ১ টি কপি রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয় এবং বাকিগুলো ধ্বংস বা চুরি করা হয়।[৬]
তদন্ত ১৯৭৪ সালে পুনরায় শুরু করা হয়, যখন পূর্ব পাকিস্তানে আটক বন্দিদের ভারত মুক্তি দেয় এবং তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়। কমিশন ৩ জুন, ১৯৭৪ সালে লাহোরে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে এবং বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং ১৬ জুলাই, ১৯৭৪ অ্যাবোটাবাদে তদন্ত পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৪ সালে তদন্ত পুনরায় শুরুর পরে কমিশন ৭৩ জন আমলা এবং উচ্চ পদস্ত সামরিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে। কমিশন ৩০০ জনের মত সাক্ষ্য এবং শত শত গোপন দলিল এবং পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সংকেত পরীক্ষা করে দেখে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন, যেটিকে সম্পূরক প্রতিবেদনও বলা হয়, ১৯৭৪ সালের ২৩ অক্টোবর জমা দেওয়া হয়, যেখানে দেখানো হয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক ও নৈতিক ব্যর্থতা পূর্ব পাকিস্তানে কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য দায়ী। [৪] এই প্রতিবেদন গোপনীয় এবং বিভিন্ন সামরিক অফিসারের বক্তব্যে এর সম্পর্কে শুধুই অনুমিত।[৬] এই প্রতিবেদনে পাঁচ অধ্যায় এবং একটি সংযোজনী আছে -
কমিশন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দাবিকৃত পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩০ লাখ মানুষ হত্যা এবং ২ লাখ ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং হতাহতের সংখ্যা ২৬,০০০ বলে দাবি করে।[৭]
প্রথম প্রতিবেদনের প্রথম অধ্যায় - রাজনৈতিক পটভূমি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সামরিক দিক পর্যালোচনা করে। সম্পূরক প্রতিবেদনের প্রথম অধ্যায় - ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ঘটনা, সামরিক দিক, পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ এবং নৈতিকতা নিয়ে বিশ্লেষণ করে।
এই প্রতিবেদনে, পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে অযাচিত এবং উচ্ছৃঙ্খলভাবে অগ্নিসংযোগ, সারাদেশে হত্যাকাণ্ড, বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবী হত্যা এবং গণকবর দেয়া, বাঙালি অফিসারদের বিদ্রোহের কারণে হত্যা, পূর্ব পাকিস্তানি অসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবস্যায়ী ও শিল্পপতিদের হত্যা, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বিপুল সংখ্যক বাঙালি নারীকে ধর্ষণ এবং ইচ্ছাকৃত কারণে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়[৬] এই প্রতিবেদনে আরও অভিযুক্ত করা হয়, জেনারেলরা অপরিপক্কভাবে আত্মসমর্পণ করে, এতে আরও বলা হয়, ১৯৫৮ সালের পর থেকে সেনাবাহিনী সরকার পরিচালনায় যুক্ত হয় এবং এতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্য দুর্নীতি এবং অদক্ষতা তৈরি করে। "এছাড়া সার্ভিস অফিসার" প্রতিবেদনে বলা হয় " আমাদের কাছে বলেছে দুর্নীতির কারণে এই সম্পৃক্ততা, ওয়াইন এবং মহিলাদের প্রতি আসক্তি এবং জমি ও বাড়ির লোভ, অনেক সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা, বিশেষত যারা উচ্চ আসন দখল করে আছে, তারা যুদ্ধ করার আগ্রহই হারায়নি বরং পেশাগত দক্ষতা হারিয়েছে।"[৮] প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান, যিনি ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পরাজয়ের পর ক্ষমতা হারান, তিনি "আত্মসমর্পণের অনুমতি এমনকি প্ররোচিত করেছিলেন এবং একারণে তাকে এবং অন্যান্য সিনিয়র সামরিক অফিসারদের প্রকাশ্যে বিচারের সুপারিশ করেন।[৮]
এই প্রতিবেদনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে, লম্পট এবং মাদকাসক্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। [২] এই প্রতিবেদন অনুসারে, জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী, দৃঢ় এবং সঠিক বিচার শুধু জাতিকে পরিতুষ্ট করবে না বরং ভবিষ্যতের পুনরাবৃতি রোধ করবে।[৯]
এই কমিশন সুপারিশ করে যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ এবং তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.জি.এম.এম. পীরজাদা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, মেজর জেনারেল উমর এবং মেজর জেনারেল মিঠা, আর্মি এসএস গ্রুপের কমান্ডারের প্রকাশ্যে বিচার হওয়া উচিত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের জন্য। আরও পাঁচ জন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের বিচারের সুপারিশ করা হয় কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলার জন্য। এদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী, মোহাম্মাদ জামসেদ, এম. রহিম খান, ইরশাদ আহমদ খান, বি. এম. মুস্তফা এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি.এম. বাকুইর সিদ্দিকি, মোহাম্মদ হায়াত এবং মোহাম্মদ আসলাম নিয়াজী।
বিচারপতি হামুদুর রহমান ২৩শে অক্টোবর, ১৯৭৪ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে জমা দেন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে ভুট্টো প্রতিবেদনটিকে গোপনীয় করেন এই ভয়ে যে, এটি প্রকাশ পেলে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর বিশেষত সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যার ফলে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে নীতিভ্রষ্টতা এবং মানহানিকর কিছু হতে পারে। যাইহোক, ১৯৭৫ সালে ভুট্টো প্রধান বিচারপতিকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের রেকর্ড সেকশন থেকে প্রতিবেদনটি হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেছে, এটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধান বিচারপতি এবার আর্মি স্টাফ অফিসার জেনারেল জিয়া-উল-হককে জানালেন এবং প্রতিবেদনটি ফাঁসের আশঙ্কা করলেন। অফিসার জেনারেল জিয়া-উল-হকও জানালেন আসল প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং কেউ জানে না কীভাবে এটি হারিয়ে গেছে। ২০০০ সালে যখন প্রতিবেদনটি ফাঁস হয়, তখন জানা গেল, পাকিস্তান আর্মির জেনারেলের সদরদপ্তরের কমান্ড্যান্ট হেডকোয়ার্টারে এটি সংরক্ষিত ছিল। প্রতিবেদনটি পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফের অফিসের রেকর্ড সেকশনে পাওয়া যায়। মিডিয়া আরও উদ্ধৃত করে, জেনারেল জিয়া-উল-হক নৌ গোয়েন্দা সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিবেদনটি চুরি করে তার কাছে জমা দেওয়ার জন্য।
কমিশনের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, প্রতিবেদনটি ছিল গোপনীয় এবং ঐ সময়ে এর প্রকাশনাও নিষিদ্ধ ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৮০ সালে মারা যান, কিন্তু তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মীরা ২০০০ সাল পর্যন্ত অবসরোত্তর পেনশন পাচ্ছিল।[৮] প্রতিবেদনের কিছু অংশ ফাঁস হয় এবং ভারতের পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডেতে ছাপা হয় ২০০০ সালের আগস্টে।[৪][৯] পরের দিন পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকাতেও সম্পূরক প্রতিবেদন প্রকাশ পায়।[১০] জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ২০০০ সালের অক্টোবরে বলেন, ১৯৭১ সালের ঘটনা শুধু রাজনৈতিক নয় বরং সামরিক পরাজয়, তাই জেনারেলদের বিচার করা সমীচীন হবে না।[৮] পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রতিবেদনের কপি দেওয়ার অনুরোধ করে।[৯] তদন্তের ২৯ বছর পরে, ২০০০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের রাষ্ট্রপতি মুশাররফ সম্পূর্ণ প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে।[২]