হারমোনিকেস মুন্দি (লাতিন ভাষায়: Harmonices Mundi, অর্থ: বিশ্বজগতের ছন্দ) বিখ্যাত জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়োহানেস কেপলার রচিত একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ যা ১৬১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ে কেপলার বিভিন্ন ভৌত ঘটনা এবং জ্যামিতিক গড়নের ছন্দ ও সাদৃশ্য বা কনগ্রুয়েন্স নিয়ে আলোচনা করেন। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তার বিখ্যাত গ্রহীয় গতির তৃতীয় সূত্রের আদিরূপ বর্ণনা করেছিলেন।
কেপলার অনেকটা নিশ্চিতভাবে মনে করতেন যে জ্যামিতিক বস্তুগুলোই ঈশ্বরকে সমগ্র বিশ্ব সাজানোর মডেল সরবরাহ করেছে।[১] হারমোনিকেসে তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জগতের অনুপাতসমূহ, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। ঐকতানের (হারমনি) প্রধান সেটটি পিথাগোরাস, টলেমি এবং কেপলারের আগে আরও অনেকে অধ্যয়ন করেছিলেন যাকে তখন মুজিকা উনিভের্সালিস বা খগোল সঙ্গীত নামে আখ্যায়িত করা হতো। এমনকি তিনি হারমোনিকেস মুন্দি প্রকাশ করার পরপরই রবার্ট ফ্লুড নামে একজন বলা শুরু করেন যে কেপলারের আগেই তিনি নিজের একটি ঐকতানের তত্ত্ব লিখেছেন।[২]
কেপলার বইটি শুরু করেন সুষম বহুভুজ এবং সুষম ঘনবস্তুর বর্ণনা দিয়ে, শুরুতে যেসব বস্তুর ছবি ছিল তাদেরকে বর্তমানে কেপলারের ঘনবস্তু বলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ঐকতানের তত্ত্বটি তিনি সঙ্গীত, আবহাওয়াবিদ্যা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে প্রয়োগ করেন। তার মতে, জ্যোতিষ্কগুলোর আত্মায় সুর আছে, যে সুর থেকে ঐকতানের জন্ম হয়, এই সুরের সাথে আবার মানব আত্মার মিথস্ক্রিয়া ঘটে যা নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র কাজ করে। বইয়ের শেষ তথা পঞ্চম অধ্যায়ে কেপলার গ্রহের গতি, বিশেষ করে কক্ষীয় বেগ ও সূর্য থেকে ক্ষপথের দূরত্বের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তার আগেও জ্যোতির্বিদরা এই সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু ট্যুকোর উপাত্ত হাতে থাকায় কেপলার অনেক সূক্ষ্ণভাবে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন এবং এর ভৌত গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন।[৩]
ছন্দ অনেকগুলো ছিল, তবে এর মধ্যে কেপলার সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যেটি ব্যক্ত করেছেন পরবর্তীকালে তার নাম দেয়া হয়েছে কেপলারের গ্রহীয় গতির তৃতীয় সূত্র। অনেক ধরনের সমাবেশ নিয়ে গবেষণা করে তিনি শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, "পর্যায়কালের বর্গ সূর্য থেকে কক্ষপথের দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক"। ঠিক কত তারিখে তার এই বোধদয় হয়েছে তার উল্লেখ পাওয়া গেলেও ঠিক কীভাবে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।[৪] গ্রহীয় গতির জন্য এই বিশুদ্ধ গতিতাত্ত্বিক সূত্রের মাহাত্ম্য অবশ্য ১৬৬০-এর দশকের পূর্বে একেবারেই বোঝা যায়নি। কারণ এই দশকেই ক্রিস্টিয়ান হাওখেন্সের নতুন কেন্দ্রাতিগ বেগ সম্পর্কিত সূত্রের সাথে কেপলারের এই সূত্র মিলিয়ে আইজাক নিউটন, এডমান্ড হ্যালি এবং খুব সম্ভবত ক্রিস্টোফার রেন ও রবার্ট হুক প্রায় একই সময়ে দেখাতে সক্ষম হন যে, মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সূর্য থেকে গ্রহের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।[৫] এই সূত্র পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত স্কলাস্টিক চিন্তাধারাকে ভুল প্রমাণিত করে। স্কলাস্টিক পদার্থবিদ্যায় মনে করা হতো দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল সবসময়ই ধ্রুব থাকে, কেপলার এবং এমনকি গালিলেও-ও তাই মনে করতেন। গালিলেও মহাকর্ষ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে একটি সর্বজনীন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যার সারকথা হচ্ছে মহাকর্ষের প্রভাবে পড়ন্ত বস্তু সব সময়ই সমান হারে ত্বরণ লাভ করে। ১৬৬৬ সালে গালিলেওর ছাত্র বোরেল্লিও তার খ-বলবিদ্যায় এই ধ্রুব মহাকর্ষকে সমর্থন করেছেন।[৬]