নিজারি ইসমালি রাজ্যের নেতা হাসান সাব্বাহ | |
---|---|
উপাধি | আলামুতের প্রভু[১] |
জন্ম | ১০৫০-এর দশক |
মৃত্যু | ১২ জুন ১১২৪ (২৬ রবিউস সানি ৫১৮ হিজরি) |
মাজহাব | ইসমাইলি শিয়া |
মূল আগ্রহ | কালাম, ফিকহ, শরিয়া |
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন |
হাসান সাব্বাহ (ফার্সি: حسن صباح; ১০৫০ এর দশক–১১২৪)[২][৩] (পুরো নাম: হাসান বিন 'আলী বিন মুহাম্মদ বিন জাফর বিন আল-হুসেন বিন মুহাম্মাদ বিন আল-সাব্বাহ আল-হিমায়ারি)[৪] ছিলেন একজন নিজারি ইসমাইলি ব্যক্তিত্ব।[৫] ১১ শতকে উত্তর পারস্যের আলবুরজ পর্বতমালায় তিনি একটি গোষ্ঠীকে তিনি তার পক্ষাবলম্বন করাতে সক্ষম হন। পরে তিনি আলামুত নামে পরিচিত একটি পর্বত দুর্গ অধিকার করেন[৬] এবং সেলজুক তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য এটিকে সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি একটি ফেদাইন গোষ্ঠী গঠন করেন।[৭] এর সদস্যদের হাশাশিন বা “এসাসিন” বলেও উল্লেখ করা হয়।
হাসান সাব্বাহ পারস্যের কোম শহরে ১০৫০ সালে এক শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[৮] শৈশবে তার পরিবার “রে” তে স্থানান্তিরিত হয়।[৮] “রে” শহর ছিল ইরানের ইসমাইলী ধর্মমত প্রচারের অন্যতম কেন্দ্র।[৯] হাসান সাব্বাহ তার প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইসমাইলী মতবাদের শিক্ষা নেন ও রে শহরের প্রধান ইসমাইলী মতবাদ প্রচারকারীর নিকট আরো শিক্ষা লাভ করেন।[১০]
এই ধর্মীয় কেন্দ্রেই হাসান আধিভৌতিক বিষয়ে গভীর আগ্রহ গড়ে তোলেন এবং বারোটি নির্দেশনা মেনে চলেন। দিনের বেলা তিনি বাড়িতে অধ্যয়ন করেন [১১]এবং হস্তরেখাবিদ্যা, ভাষা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিত (বিশেষ করে জ্যামিতি) আয়ত্ত করেন।[১২]
এর ফলে তিনি সতের বছর বয়সে ইসমাইলী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে; তৎকালীন ইসমাইলী ইমাম আল-মুনতাসির এর আনুগত্যের শপথ করেন।[১৩] আল মুনতাছির ছিলেন সে সময়ের ফাতিমিয় খলিফা। তিনি তার জ্ঞান ও কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন ও খলিফার তাকে কাজে নিযুক্ত করেন । তাকে খলিফার দরবারে তাকে নিয়মিত উপস্থিত হতে বলা হয়।[১৩]
তিনি আর খলিফার দরবারে না গিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন। পরে মিশরের খলিফার কাছে উপস্থিত হন। সেখানে প্রচারিত দাওয়াতি কাজ তাকে পরিচিত করে তোলে। এবার তিনি পারস্য, খোরাসানে ইসমাইলি মতবাদ প্রচার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে তিনি খলিফার বড় ছেলে নেযার এর অনুসারে দাওয়ত প্রচার করতে থাকেন। নিজেকে মনে করেন সহযোগী। কিন্ত খলিফা মুনতাসির মারা গেলে বড় ছেলের পরিবর্তে ছোট ছেলে আল মুসতালি বিল্লাকে খলিফা বানানো হয় ও তার হাতে সবাই বায়াত গ্রহণ করে। এসবের ফলে বড় ছেলের অনুসারীরা নেযারি দলের গোড়াপত্তন করে। এই থেকেই ইসমাইলিদের মধ্যে দুইটি ভাগ হয়ে যায়।আর এসবের মূলে ছিলেন হাসান সাব্বাহ। আর নেযারি দাওয়াদের থেকেই বাতিনি ও হাসাসিনদের তৈরি হয়।[১৪][১৫][১৬][১৭]
এরপর হাসান তার অনুসারীদের নিয়ে ;তার বাতিনী ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। তার প্রধান টার্গেট হয় ইরান ও কাস্পিয়ান অঞ্চলের দিকে। তার অনুসারীদের অন্য অঞ্চলে পাঠান। নিজাম-উল-মুলুকের কানে গেলে তিনি তাকে বন্দি করতে সেনাবাহিনী পাঠান। হাসান তাদের কৌশলে ফাকি দিয়ে গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করেন।
তারপর তিনি তার কাজের প্রসারের জন্য একটি নির্জন জায়গা খুজতে থাকেন। ১০৮৮ সালে তিনি আলমুট শহরের দেখা পান। সেখানেই তিনি তার ধর্ম প্রচার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। আলামুটে একটি দূর্গ ছিল যা প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও ৫ কিমি চওড়া। কথিত আছে এখানে এক রাজা ঈগল শিকার করার সময় এক ইগলকে উড়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর বসতে দেখেন ও এটিকে শুভ লক্ষণ হিসেবে নেন। তিনি সেখানেই এই দূর্গ নির্মাণ করেন। এইজন্যই এর নামকরণ করা হয় আলামুট বা ঈগলের বাসা।[১৮]
প্রায় দু’বছর সেখানে অবস্থান ও ইসমাইলি মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে তিনি ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গের দখল নিতে সমর্থ হন। লোকমুখে প্রচলিত কথা অনুসারে হাসান দুর্গের মালিককে ৩০০০ স্বর্ণের দিনারের বিনিময়ে দুর্গ বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। দুর্গের আমীর রাজি হলে হাসান যুদ্ধ শুরু করেন এবং দুর্গের আমীরকে পরাজিত করে দুর্গের দখল করেন। তিনি দুর্গের আমীরকে এক ধনী জমিদারের নাম ও ঠিকানা লিখে একটি চিঠি দেন এবং তার কাছ থেকে তিনি তার পাওনা টাকা নিতে বলেন। কিংবদন্তি আরো বলে যখন সে জমিদার হাসানের সই সহ সে চিঠি দেখেছিলেন তিনি দুর্গের আমীরকে বিস্মিত করে বিনাবাক্য ব্যয়ে তার পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন।[১৯][২০][২১][২২][২৩]
দূর্গ দখল করার পর তিনি তার কাজ শুরু করেন। তৈরি করেন গুপ্তঘাতকের সংগঠন। গুপ্ত হত্যা ও যুদ্ধের মাধ্যেমে তিনি তার পরিচিতি জানান দেন। তিনি তরুণ যুবকদের সংগ্রহ করতেন ও তাদের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন করতেন।
আলামুট দুর্গে তিনি বেহেস্তের আদলে এক বেহেস্ত তৈরি করেন। পাহাড়ের উপর দেওয়াল ঘেরা বিচিত্র গাছপালা, ঝর্ণা, রেশমী কাপড়ের তাবু। কিয়স্কওয়ালা আনিন্দ্য সুন্দর উদ্যান ও চোখের আরালে থাকা বাদকদের মোহিনীয় বাদ্য তাদেরকে আক্ষরিক অর্থে বেহেস্ত হিসেবে ধরা দিত। তাদের খেদমতে ছিল সুন্দর সুন্দর নারী। হাশিশ নামক এক মাদক দিয়ে আচ্ছন্ন করে তাদের হাসানের বেহেস্তে প্রবেশ করাতো। মাদকের নেশা কাটলে তাদের অন্ধ কুপে বন্দি করা হত। তাদের বলা হয় তারা যদি বেহেস্তে যেতে চায় তবে তাকে হাসানের আদেশ মানতে হবে। বেহেস্তে যাওয়ার ইচ্ছা তাদের মৃত্যু ভয় কমিয়ে দিতো। এর ফলে হাসান তাদের দিয়ে বিভিন্ন গুপ্ত হত্যা অনায়াসেই ঘটাতে পারতেন। নিজাম-উল-মুলক সহ অনেক ব্যাক্তি তাদের শিকার হয়।
পরবর্তী সময়ে হাসান স্বেচ্ছায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তবে তিনি তার কার্যক্রম যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর তিনি আর আলামুট থেকে অন্য কোথাও যাননি। এ দীর্ঘসময় তিনি তার দুর্গে পড়াশোনা, ধর্মীয় কাজকর্ম করেছেন ও শাসনকার্য চালিয়েছেন। তিনি তার শাসনকার্জে ধর্মীয় রীতিনীতি মানার ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। হাসান ফার্সিকে নিজারীদের জন্য পবিত্র সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, একটি সিদ্ধান্তের ফলে পারস্য, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সমস্ত নিজারি ইসমা'লি সাহিত্য কয়েক শতাব্দী ধরে ফার্সি ভাষায় প্রতিলিপি করা হয়েছিল।[১৮]
পরবর্তী সময়ে তাকে আর দূর্গের বাইরে দেখা যায়নি। ১১২৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে হাসান মারা গেলেও তার কার্যক্রম চলতে থাকে। পরবর্তীতে মঙ্গোলরা ১২৫৬ সালে তার দূর্গ ধ্বংস করে।[২৪]
ঐতিহাসিক এবং পণ্ডিতরা হাসান সাব্বাহকে নিজারি হত্যাকারী এবং তাদের মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বণর্ণা করেছেন। কায়রোর ফাতিমী সিংহাসনে নিজারের উত্তরাধিকার সংগ্রামের সময় এটি বিকশিত হয়েছিল যা অবশেষে নিজারি ইসমাইলিজম শিয়া ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।[২৫]
তখন থেকেই তাদের বিশ্বাস করানো হতো যে, রক্ষণশীল প্রকৃতির একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে ইসমাইলি ইমামতে দৃশ্যমান ও সেই সময়ের ইমাম ছাড়াও একটি লুকানো ইমাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[২৬] এছাড়াও হাসান ছাব্বাহ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল শিক্ষার প্রসার এবং অপ্রকাশিত ইমামের আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা।[২৭] অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে এমনকি তার এক পুত্রকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন মাতাল হওয়ার অভিযোগে।[২৮]
একজন নিজারি হত্যাকারীকে ফিদাই বা ভক্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, "যে তার জীবন অন্যের জন্য বা একটি বিশেষ কারণের সেবায় উৎসর্গ করে"।[২৯]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; Daftari, p. 311
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি