আতপাঘাত | |
---|---|
প্রতিশব্দ | হিট স্ট্রোক (ইংরেজি), সান স্ট্রোক (ইংরেজি), সিরিয়াসিস (ইংরেজি)[১] |
![]() | |
১৯৪৩ সালের ইরাকের একটি স্থিরচিত্র, যেটিতে আতপাঘাতে (হিট স্ট্রোক) আক্রান্ত একজন ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা কমাতে তার দেহে পানি ছিটানো হচ্ছে। | |
বিশেষত্ব | জরুরি চিকিৎসা |
লক্ষণ | অতিজ্বর (হাইপারথারমিয়া), লাল, শুষ্ক অথবা আর্দ্র ত্বক, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি, বমি ভাব[২] |
জটিলতা | সংজ্ঞালোপ বা মূর্ছা যাওয়া, ডুরেপেশী লোপ (র্যাবডোমায়োলাইসিস), বৃক্ক বৈকল্য[৩] |
প্রকারভেদ | সাধারণ আতপাঘাত, পরিশ্রমজনিত আতপাঘাত[৩] |
কারণ | অত্যধিক বাহ্যিক তাপমাত্রা, অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রম[৩][৪] |
ঝুঁকির কারণ | বৃদ্ধ বয়স, তাপদাহ, উচ্চ আর্দ্রতা, ঔষধ, হৃদরোগ, চর্মরোগ[৩] |
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি | লক্ষণ-উপসর্গের উপর নির্ভর করে[৩] |
পার্থক্যমূলক রোগনির্ণয় | নিউরোলেপ্টিক ম্যালিগন্যান্ট সিনড্রোম, ম্যালেরিয়া, মস্তিষ্কঝিল্লিপ্রদাহ (মেনিনজাইটিস)[৩] |
চিকিৎসা | দ্রুত শরীর ঠাণ্ডা করা, সহ-চিকিৎসা[৪] |
আরোগ্যসম্ভাবনা | মৃত্যুহার <৫% (শারীরিক পরিশ্রম বিবেচনায় না নিয়ে) , ৬৫% পর্যন্ত (শারীরিক পরিশ্রম বিবেচনায় নিয়ে)[৩] |
মৃতের সংখ্যা | প্রতি বছর > ৬০০ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে)[৪] |
আতপাঘাত কিংবা ইংরেজি পরিভাষায় হিট স্ট্রোক হল একটি গুরুতর তাপজনিত অসুস্থতা যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি হয়ে যায়।[৪] ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং বিভ্রান্তি আতপাঘাতের প্রধান কিছু লক্ষণ-উপসর্গ।[২] চিরাচরিত আতপাঘাতে সাধারণত ঘাম হয় না, তবে পরিশ্রমজনিত আতপাঘাতে শরীর থেকে ঘাম নিঃসৃত হয়।[৫] আতপাঘাতের শুরু হঠাৎ করে বা ধীরে ধীরে হতে পারে।[৩] আতপাঘাত জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ একট পরিস্থিতি, কারণ এর ফলে বহুসংখ্যক অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।[৬] আতপাঘাতজনিত জটিলতার মধ্যে খিঁচুনি, ডুরেপেশী লোপ (র্যাবডোমায়োলাইসিস) ও বৃক্ক বৈকল্য খুবই সাধারণ।[৩]
পরিবেশের উচ্চ তাপমাত্রা অথবা শারীরিক পরিশ্রমের কারণে আতপাঘাত ঘটে।[৩][৪] এটি সাধারণত চরম পরিবেশে অবস্থান করা ও পরিশ্রমমূলক কাজের জন্য বা দীর্ঘ সময় তাপের সংস্পর্শে থাকার জন্য ঘটে থাকে।[৬] তবে কিছু স্বাস্থ্যগত অবস্থাও আতপাঘাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বংশগত প্রবণতার কারণে কিছু রোগীর, বিশেষ কিছু শিশুর জন্য তুলনামূলকভাবে মৃদু পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও আতপাঘাতের ঝুঁকিপ্রবণতা বেশি থাকতে পারে।[৭]
আতপাঘাতের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত তরল পানীয় পান করা এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রাযুক্ত পরিবেশ এড়িয়ে চলা।[৮] শরীর দ্রুত ঠাণ্ডা করে এবং সার্বিক যত্নের মাধ্যমে আতপাঘাতের চিকিৎসা করা হয়।[৪] অন্যান্য প্রস্তাবিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে ভুক্তভোগী ব্যক্তির দেহে পানি ছিটানো, তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করা, তাকে বরফশীতল পানিতে নিমজ্জিত রাখা, ইত্যাদি।[৪][৪]
আতপাঘাত (হিট স্ট্রোক) সাধারণত ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রাবিশিষ্ট অতিজ্বর (হাইপারথার্মিয়া) হিসেবে প্রকাশ পায়।[৫][৯] তবে শরীরের তাপমাত্রা অত্যন্ত উচ্চ হলেই যে আতপাঘাত হয়েছে, এমনটি বলা যায় না।[১০][১০] আতপাঘাতের চিরায়ত রূপটিতে সাধারণত ঘামের অভাব থাকে, তবে পরিশ্রমজনিত আতপাঘাতে ঘাম উপস্থিত থাকতে পারে।[৫]
আতপাঘাতের প্রাথমিক লক্ষণ-উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে আচরণগত পরিবর্তন, বিভ্রান্তি, প্রলাপ, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, শরীরের দুলুনি, কথাবার্তা জড়িয়ে আসা, বমি বমি ভাব এবং বমি।[৫] পরিশ্রমজনিত আতপাঘাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে খিঁচুনি এবং প্রস্রাব ও মলত্যাগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতারও প্রতিবেদন পাওয়া গেছে।[৫] উপরন্তু পরিশ্রমজনিত আতপাঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অতিরিক্ত ঘামতে পারে।[১১] এক্ষেত্রে চিকিৎসা বিলম্বিত হলে রোগীদের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গসমূহের ক্ষতি, চেতনালোপ এবং এমনকি অঙ্গবৈকল্য ঘটতে পারে। অবিলম্বে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে আতপাঘাত মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে।[১২]
আতপাঘাত বা "হিট স্ট্রোক" তখনই ঘটে যখন শরীরের তাপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অতিরিক্ত বিপাকের ফলে উৎপন্ন তাপ, বাহ্যিক পরিবেশে অত্যধিক তা অথবা শরীর তাপ হারাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। অ্যালকোহল, উদ্দীপনা, কিছু ঔষধ এবং জরাগ্রস্ততা আতপাঘাতকে ত্বরান্বিত করে।[১৩]
যখন বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, তখন সরাসরি সূর্যালোকে দাঁড় করিয়ে রাখা মোটরগাড়ির অভ্যন্তরের তাপমাত্রা দ্রুত ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে যেসব অল্পবয়সী শিশু বা অধিক বয়স্ক ব্যক্তি ঐসব মোটরযানে একা বসে থাকে, তাদের আতপাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার বিশেষ ঝুঁকি থাকে। "শিশু এবং অধিক বয়স্কদের মধ্যে আতপাঘাত কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটতে পারে, এমনকি যদি গাড়ির জানালা সামান্য খোলাও থাকে।"[১৪] যেহেতু এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজ থেকে গাড়ির দরজা খুলতে পারে না বা বন্ধ গাড়িতে থেকে উচ্চগলায় বাইরের লোকের আছে তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে পারে না, তাই তাদের দুর্দশা আশেপাশের লোকজন অবিলম্বে বুঝতে পারে না।[১৫]
গাড়িতে বন্দী কুকরদের আতপাঘাতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি মানুষের চেয়েও বেশি, কেননা তারা সারা দেহ ঘামিয়ে নিজেদের শীতল রাখতে পারে না। একারণে গরমের দিনগুলিতে কুকুরদেরকে বাসায় রেখে আসতে ও তাদেরকে প্রচুর পানি পানের সুযোগ দিতে সুপারিশ করা হয়। আর যদি কোনও কুকুরকে সাথে আনতেই হয়, তাহলে সেটিকে কোনও ছায়াযুক্ত স্থানে দড়ি বেঁধে রেখে দিতে হয় ও একটি পূর্ণ করা পানির পাত্র সাথে দিতে হয়।[১৬]
আতপাঘাতের শারীরবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল এরূপ: প্রথমে দেহের উপরে তাপের তীব্র ভার সৃষ্টি হয়, এরপর দেহের তাপনিয়ন্ত্রক কার্যপদ্ধতিগুলি বিকল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আতপাঘাতের কারণের দেহে প্রদাহজনিত ও রক্ততঞ্চনজনিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যার কারণে রক্তবাহ নালীগুলির অন্তঃআবরণী কলা (ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াম) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে রক্তের অণুচক্রিকাগুলিতে (প্লাটিলেট) বহুসংখ্যক জটিলতার সৃষ্টি হয়। যেমন অণুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস পায়, সেগুলি জমাটবদ্ধ হতে শুরু করে এবং অস্থিমজ্জা থেকে নিঃসরণ অবদমিত হয়ে যায়।[১৭]
দেহের ভেতরে আতপাঘাতের দ্বিতীয় যে একটি ক্রিয়াপথের পক্ষে প্রমাণ ভারী হচ্ছে, সেটি হল উত্তাপ ও শারীরিক পরিশ্রমের কারণে রক্তাভ্যন্তরে বিষক্রিয়া (এন্ডোটক্সিমিয়া।[১৮] যদিও এই ক্রিয়াপদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অনুধাবন করা সম্ভব হয় নি, তা সত্ত্বেও এই প্রতিমানে (মডেল) অনুমান করা হয় যে চরম শারীরিক পরিশ্রম ও তাপের কারণে আন্ত্রিক শ্লৈষিক প্রতিবন্ধকটি ক্রিয়া বিঘ্নিত হয় ও সেটি অধিকতর ভেদ্য হয়ে পড়ে, ফলে অন্ত্রে অবস্থিত গ্রাম-ঋণাত্মক ব্যাকটেরিয়াগুলি দ্বারা উৎপাদিত লাইপোপলিস্যাকারাইড অণুগুলি রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে।[১৮] রক্তে লাইপোপলিস্যাকারাইডের উচ্চ ঘনমাত্রা একটি তন্ত্রব্যাপী প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া সংলক্ষণ (Systemic inflammatory response syndrome সিস্টেমিক ইনফ্লেমেটরি রেসপন্স সিন্ড্রোম) উসকে দিতে পারে এবং এর পরিণতিতে জীবাণুদূষণ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরিণাম যেমন রক্ত জমাট বাঁধা, বহু-অঙ্গ বৈকল্য, দেহকলার মৃত্যু ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াবিকার ঘটতে পারে।[১৮]
আতপঘাত বা হিট স্ট্রোক নির্ণয়ের জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি সম্পাদন করা হয় (তবে এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়):[১৯]
অতিরিক্ত গরম এবং পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্য সাবধানতা অবলম্বন করে আতপাঘাতের (হিট স্ট্রোক) ঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরলে শরীরের ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সুযোগ পায় এবং এভাবে শরীর শীতল থালে। হালকা রঙের চ্যাপ্টা বড় টুপি সূর্যের উত্তাপ থেকে মাথা ও ঘাড় উত্তপ্ত হওয়া রোধ করতে সহায়তা করে। গরম আবহাওয়ার সময় কঠোর ব্যায়াম করা পরিত্যাজ্য। পাশাপাশি সূর্যের প্রচণ্ড তাপদাহের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা পর্যাপ্ত বায়ুচলাচলের সুবিধাযুক্ত স্থান ব্যতীত যেকোনও বদ্ধ স্থানে অবস্থান (যেমন মোটরগাড়ীর ভেতরে থাকা) এড়িয়ে চলা উচিত।[২০]
|pmid=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। পিএমসি 7547078 |pmc=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)।