ভাষার মর্যাদা পরিবর্তন | |
---|---|
ফারসির স্থলে হিন্দোস্তানী ভাষা প্রতিস্থাপন৷[১] | ১৮৩৭ |
মূল হিন্দোস্তানী ভাষাকে উর্দু নামকরণ করে, হিন্দোস্তানী ব্যাকরণের উপর নব গঠিত সংস্কৃতায়িত হিন্দী ভাষা দেবনাগরী হরফ সমেত তৈরি করে বৃটিশ ভারতের যুক্ত প্রদেশে সম মর্যাদা প্রদান৷[২][৩] | ১৯০০ |
উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণা৷[৪] | ১৯৪৮ |
ভারতে হিন্দিকে হিন্দোস্তানী সহ অন্যান্য ভাষার স্থলে বিশেষ মর্যাদা প্রদান৷[৫] | ১৯৫০ |
হিন্দি-উর্দু বিতর্ক হিন্দি ও উর্দুর সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রশ্নে ১৯শ শতাব্দীতে শুরু হওয়া একটি বিতর্ক। এই দুইটি ভাষা হিন্দুস্তানির দুটি রূপ। ১৯৫০ সালে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে এই বিতর্ক দাপ্তরিকভাবে শেষ হলেও এর রেশ রয়ে গেছে। মুসলিমদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে হিন্দুরা উর্দু ভাষা ত্যাগ করেছে। অন্যদিকে হিন্দুদের বক্তব্য হল মুসলিম শাসনামলে উর্দু কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।[৬]
আক্ষরিকভাবে হিন্দি ও উর্দু খাড়িবুলি ভাষার দুইটি রূপ। বিশেষত উত্তর ও মধ্য ভারতে এই ভাষার প্রচলন বেশি। খাড়িবুলি ভাষার ফারসি প্রভাবিত রূপ উর্দু বলে পরিচিত। দিল্লি সালতানাত (১২০৬-১৫২৬) ও মুঘল সাম্রাজ্যের (১৫২৬-১৮৫৮) সময়কালে উর্দু উপমহাদেশে গড়ে উঠে।[৭] ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন সরকারি ভাষা ফারসিকে বদলে ইংরেজি করার পর ফার্সি লিপিতে লিখিত উর্দু ভাষা ফারসির স্থলে অতিরিক্ত সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত।
উনিশ শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ এবং আওধে হিন্দি ও উর্দু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। হিন্দির পৃষ্ঠপোষকরা দেবনাগরী হরফে হিন্দুস্তানি ভাষা লেখার দাবি জানায়। উত্তর ভারতে দেবনাগরী হরফের সরকারি স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন গড়ে উঠে। বাবু শিব প্রসাদ ও মদন মোহন মালব্য ছিলেন এই আন্দোলনের প্রথমদিককার নেতা। এর ফলশ্রুতিতে উর্দুর সরকারি মর্যাদা রক্ষার জন্য পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে উর্দু আন্দোলন গড়ে উঠে। সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন উর্দুর পক্ষের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি।
১৯০০ সালে বৃটিশ সরকার উর্দু ও হিন্দির জন্য সমান মর্যাদা ঘোষণা করে ফরমান জারি করে। হিন্দুরা একে স্বাগত জানালেও মুসলিমরা এর প্রতিবাদ জানায়। উৎপত্তিগতভাবে এক হলেও হিন্দি সংস্কৃত থেকে এবং উর্দু আরবি ও ফারসি থেকে শব্দ গ্রহণের কারণে পৃথক রূপের ছিল। এই হিন্দি-উর্দু বিভক্তির কারণে মহাত্মা গান্ধী দেবনাগরী বা উর্দু হরফ ব্যবহার করে প্রথাগত নাম হিন্দুস্তানি ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। কংগ্রেস ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের সমর্থনপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৫০ সালের সংবিধান অনুযায়ী ভারতে দেবনাগরী লিপিতে লিখিত হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষিত হয় এবং মূল হিন্দোস্তানী ভাষা উর্দু হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়।[৮]
বিতর্ক সৃষ্টির পেছনে উভয় সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। মুসলিমরা বৈশ্বিক মুসলিম উম্মাহর ধারণ পোষণ করত। অন্যদিকে হিন্দুরা প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি গ্রহণে উৎসাহী ছিল। মুসলিম শাসনের সময় ইসলাম গ্রহণকারীরা শাসকদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে। এসময় মধ্য এশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক স্থানে ফারসি ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতারা জাতিগত দিক থেকে পারস্যের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন ফলে ফারসি এসময় সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হিন্দুদের কাছে এসব বিদেশি সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হয়। সময় পরিক্রমায় সংস্কৃত ভাষা, ধুতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি হিন্দুদের এবং ফারসি ভাষা, ইউনানি চিকিৎসা মুসলিমদের সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে গণ্য হওয়া শুরু হয়।[৯] এছাড়াও দুই সম্প্রদায়ের খাদ্যগ্রহণ ও সংস্কৃতিও ভিন্ন ছিল।
বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের দরবারের ভাষা হিসেবে উর্দু ব্যবহার হত। এর উৎপত্তি হয় দিল্লির খাড়িবুলি ভাষার সাথে আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার সংমিশ্রণে। মুসলিম শাসন উত্তর ভারতে বিস্তৃত হওয়া শুরু করলে এর মাধ্যমে স্থানীয় ভাষায় ফারসি শব্দ প্রবেশ শুরু হয়। সময়ের প্রেক্ষিতে উর্দু একটি স্বতন্ত্র ভাষা হয়ে উঠে। হিন্দি ভাষাও খাড়িবুলি থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তবে এর শব্দসমষ্টি উর্দুর মত আরবি, ফারসি না হয়ে সংস্কৃতের উপর নির্ভরশীল ছিল।
পার্থক্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করেছে। মুসলিম শাসকরা দেবনাগরী লিপির পরিবর্তে ফার্সি লিপি ব্যবহার করতেন। ফার্সি তথা উর্দু হরফে লেখা উর্দু ভাষা এসময় সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠে এবং ১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। উনিশ শতকের শেষভাবে গড়ে উঠা হিন্দি আন্দোলন বিতর্ক সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।[১০]
১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন প্রদেশে ফারসির স্থলে স্থানীয় ভাষার ব্যবহার শুরু করে। তবে উত্তর ভারতে ফারসির বদলে ফার্সি হরফে লিখিত উর্দু ভাষার ব্যবহার শুরু হয়।[১০][১১] সরকার হিন্দি ও উর্দু উভয় মাধ্যমকে শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চাইলেও সরকারি কারণে হিন্দি বা নাগরি ব্যবহারে নিরুৎসাহ দেখায়। ফলে প্রতিযোগীতামূলক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দি ও উর্দু শিক্ষিত ছাত্রদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয় এবং তা সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।[১২]
১৮৬৭ সালে যুক্ত প্রদেশের কিছু হিন্দু উর্দুর স্থলে হিন্দিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানায়।[১৩] বেনারসের বাবু শিব প্রসাদ ছিলেন নাগরির পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। ১৮৬৮ সালে লিখিত মেমোরেন্ডাম অন কোর্ট ক্যারেক্টারস এ তিনি ভারতের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ফারসি শিখতে বাধ্য করার অভিযোগ করেন। ১৮৯৭ সালে মদন মোহন মালব্য কোর্ট ক্যারেক্টার এন্ড প্রাইমারি এডুকেশন ইন নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সেস এন্ড আওধ নামে কিছু দলিল ও বিবৃতির সংগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে তিনি হিন্দির পক্ষে লেখেন।[১২][১৪]
১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে ও ২০শ শতাব্দীর প্রথমদিকে বেশ কিছু হিন্দি আন্দোলন গড়ে উঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৮৯৩ সালে বেনারসে গঠিত নাগরি প্রচারণা সভা, ১৯১০ সালে এলাহাবাদে গঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন, ১৯১৮ সালে গঠিত দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা ও ১৯২৬ সালে গঠিত রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি। ১৮৮১ সালে বিহারে ফারসি হরফে লিখিত উর্দুর পরিবর্তে নাগরি হরফে লিখিত হিন্দিকে সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হলে সব আন্দোলন উৎসাহিত হয়। হিন্দির পক্ষের লোকদের দাবি ছিল যে অধিকাংশ লোকেরাই হিন্দিতে কথা বলে তাই নাগরি হরফ শিক্ষার জন্য উৎকৃষ্ট।
আঞ্জুমান তরিকায়ে উর্দুর মত সংগঠন উর্দুর পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য গঠিত হয়। উর্দুর পক্ষের লোকদের দাবি ছিল যে হিন্দি হরফ দ্রুত লেখা যায় না এবং তাতে মানভাষা ও শব্দসম্ভারের বিচ্যুতি রয়েছে। তারা এও বলে যে উর্দু ভাষা ভারতেই উৎপত্তি লাভ করেছে এবং অধিকাংশ জনগণ সহজেই উর্দু বলতে পারে তাই তা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কার্যকরী।
এই ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি দেখা দেয়। সৈয়দ আহমদ খান একবার বলেছেন, "হিন্দু ও মুসলিম উভয়কেই আমি একই দৃষ্টিতে দেখি ও তাদের দুটি চোখ মনে করি। জাতি বলতে আমি হিন্দু ও মুসলিমদের বুঝি এর বাইরে কিছু না। আমরা হিন্দু ও মুসলিমরা একই মাটিতে একই সরকারের অধীনে বসবাস করি। আমাদের স্বার্থ ও সমস্যা একই এবং তাই আমি দুই সম্প্রদায়কে এক জাতি হিসেবে বিবেচনা করি।" ভাষা প্রশ্নে উত্তাপ সৃষ্টি হলে বেনারসের গভর্নর শেক্সপিয়ারের সাথে কথা বলার পর তিনি বলেন, "আমি এখন নিশ্চিত যে হিন্দু ও মুসলিমরা কখনো এক জাতি হতে পারবে না কারণ তাদের ধর্ম ও জীবনের পথ আলাদা এবং একে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি পৃথক।"
উনিশ শতাব্দীর শেষ তিন দশকে উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও আওধে বিতর্কে বেশ কয়েকবার উস্কে উঠে। শিক্ষার অগ্রগতি যাচাই করার জন্য ভারতের গভর্নর কর্তৃক নিযুক্ত হান্টার কমিশন এসব কারণে হিন্দি ও উর্দু উভয়ের ব্যবহারের সুপারিশ করে।
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত উভয় দিক থেকে হিন্দি ও উর্দু পৃথক ছিল। সাংস্কৃতিকভাবে উর্দু মুসলিমদের ও হিন্দি হিন্দুদের মধ্যে নিজস্ব গণ্য হয়। এসকল বিচ্ছিন্নতার কারণে গান্ধী প্রস্তাব করেন যাতে হিন্দি ও উর্দুকে মিশ্রিত করে নাগরি ও ফারসি উভয় লিপিতে লিখিত হিন্দুস্তানি হিসেবে নামকরণ করা হয়।[১০] হিন্দি ও উর্দুকে এক করার এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেও তিনি অহিন্দিভাষীদের কাছে হিন্দুস্তানিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।[১৪]
হিন্দি-উর্দু বিতর্ক উপমহাদেশে মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে দেয়। কারো কারো মতে বিতর্ক সৃষ্টির পূর্বেই সৈয়দ আহমদ এ ব্যাপারে ধারণা করেছিলেন।[১০]
ভাষাগত শুদ্ধতার প্রশ্নে দেখা যায় যে উর্দু ভাষার শব্দভাণ্ডার ফারসি, আরবি ও তুর্কি ভাষা প্রভাবিত। অন্যদিকে হিন্দিতে সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দগ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে হিন্দিতে ফারসি শব্দেরও অস্তিত্ব রয়েছে।
১৯০০ সালের এপ্রিলে উত্তর পশ্চিম প্রদেশের ঔপনিবেশিক সরকার নাগরি ও ফারসি-আরবি লিপি উভয়ের সমান সরকারি মর্যাদার আদেশ জারি করেন।[১৫] এই ফরমানের কারণে উর্দু সমর্থকরা প্রতিবাদ করে এবং হিন্দি সমর্থকরা উল্লসিত হয়। তবে এরপরও ফারসি-আরবি লিপি এই অঞ্চলে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত প্রধান হিসেবে টিকে থাকে।[১২]
চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দুস্তানিকে বাধ্যতামূলক করেন তবে পরে এই সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেয়া হয়।[১৬] ১৯৬৫ সালে মাদ্রাজে হিন্দি বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয়। বাল গঙ্গাধর তিলক জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের আবশ্যক উপাদান হিসেবে দেবনাগরী লিপির সমর্থন করেন। স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের সহায়তায় হিন্দি সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা, সমাজ সংস্কারক, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় হিন্দিকে সমর্থন দেন। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হয়।[১৪]
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা স্থান লাভ করে।