হিন্দু দর্শন |
---|
![]() |
নাস্তিক্যবাদ |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
নিরীশ্বরবাদ হিন্দু দর্শনের একাধিক আস্তিক বা সনাতন শাখায় সুপ্রাচীন কাল থেকে স্বীকৃত হয়েছে।[১] ভারতীয় দর্শনের তিনটি শাখা বেদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছে। এই তিনটি শাখা হল জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও চার্বাক। এগুলিকেই ‘নাস্তিক’ দর্শন বলা হয়।[২][৩] নাস্তিক বা ব্যতিক্রমী ধারার দর্শনে যদিও ঈশ্বরে অবিশ্বাসের থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, বেদের কর্তৃত্ব অস্বীকার।[৪] তবে এই শাখাগুলি সৃষ্টিকর্তা দেবতার ধারণাটিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।
হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম হলেও একটি দর্শনও বটে।[৫][৬] হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সাংখ্য, যোগ ও মীমাংসা শাখা তিনটি বেদ ও ব্রহ্মের ধারণাটিকে অস্বীকার না করেও[৭] বিশেষভাবে এক ব্যক্তি ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা সগুণ ঈশ্বরের ধারণাটিকে অস্বীকার করেছে। সাংখ্য ও যোগ দর্শনে চিরন্তন, স্বয়ম্ভু ও সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। মীমাংসা দর্শনে বলা হয়েছে যে, বেদ কোনো একজন দেবতার দ্বারা রচিত হয়নি।
কোনো কোনো শাখার মতে, আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নাস্তিকের পথ অনুসরণ করা কষ্টকর। তবে নাস্তিক্যবাদ সেই শাখাগুলিতে স্বীকৃত মতবাদ।[৮] হিন্দু নাস্তিকেরা হিন্দুধর্মকে ধর্মের পরিবর্তের একটি ‘জীবনযাত্রা প্রণালী’ হিসেবে গ্রহণ করেন।
সংস্কৃত ভাষায় ‘আস্তিক’ (অর্থাৎ ‘পবিত্র, রক্ষণশীল’) শব্দটির দ্বারা সেই সব দার্শনিক শাখাগুলিকে বোঝায়, যেগুলি বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে।[৪] সংস্কৃতে ‘অস্তি’ শব্দটির অর্থ ‘আছে’ এবং ‘আস্তিক’ শব্দটি (পাণিনি ৪। ৪। ৬০ অনুসারে) এসেছে সেই ক্রিয়াপদটি থেকে যার অর্থ ‘যিনি বলেন ‘অস্তি’’। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু দর্শনে ‘আস্তিক’ শব্দটির দ্বারা শুধুমাত্র বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করাকে বোঝায়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করাকে নয়।[৯] যদিও কখনও কখনও বেদকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা ধরে নিয়ে ‘আস্তিক’ বলতে ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং ‘নাস্তিক’ বলতে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। তবে এই মত সার্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি।[১০]
স্বামী বিবেকানন্দ অন্য একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “বিশ্বের কোনো কোনো ধর্ম বলে যে, যে ব্যক্তি নিজের বাইরে এক ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন না, তিনি নাস্তিক। তাই বেদান্ত বলে যে, যে ব্যক্তি নিজেকে বিশ্বাস করেন না, তিনি নাস্তিক। বেদান্তের মতে, নিজের আত্মার গৌরবে বিশ্বাস না করার নামই নাস্তিক্যবাদ।”[১১]
বেদের প্রাচীনতম অংশ ঋগ্বেদে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর ও ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সংশয়বাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে নাসদীয় সূক্তে বলা হয়েছে:[১২][১৩]
সত্যই কে জানেন?
কে এটি এখানে ঘোষণা করবেন?
কোথা হতে এটির উৎপত্তি? কোথা হতে এই সৃষ্টি?
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পরে দেবতারা এসেছিলেন।
তবে কে জানেন যে কোথা হতে এটি উত্থিত হয়েছে?
বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ঈশোপনিষদ্, মুণ্ডকোপনিষদ্ (যাতে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে সব কিছু ও ‘কিছুই না’) এবং বিশেষত ছান্দোগ্যোপনিষদ্ গ্রন্থগুলিকেও নিরীশ্বরবাদী বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কারণ, এই সকল গ্রন্থে ব্যক্তিগত আত্মার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[১৪]
মীমাংসা দর্শন হল একটি বাস্তববাদী ও বহুত্ববাদী দার্শনিক শাখা। এই শাখায় বেদের ব্যাখ্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।[১৫] এই শাখার মূল গ্রন্থটি হল জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা সূত্র (খ্রিস্টপূর্ব ২০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দ)। মীমাংসাবাদী দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন, বেদের প্রকাশ পবিত্র। বেদ ‘অপৌরুষেয়’ (মানুষের রচিত নয়) এবং অভ্রান্ত। তাদের মতে, ধর্ম (ব্রহ্মাণ্ডের ক্রমপর্যায়) রক্ষা করতে হলে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের পবিত্রতা রক্ষা করা একান্ত জরুরি।[১৬][১৭]:৫২–৫৩ আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকাণ্ডের পবিত্রতায় বিশ্বাস রাখার ফলে মীমাংসা কোনো প্রকার সাকার ঈশ্বরের ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করে।[১৫] প্রভাকর (খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী) প্রমুখ পরবর্তীকালের মীমাংসা টীকাকারেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন।[১৮][১৯] প্রথম দিকের মীমাংসা ঈশ্বর ধারণাটি অনুমোদন করেনি। তবে বলেছে যে, মানুষের কাজই ঈশ্বর-বিশ্বাসের ফল উপভোগ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট।[২০]
ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য একটি নিরীশ্বরবাদী[২১] ও কঠোরভাবে দ্বৈতবাদী[২২][২৩] আস্তিক শাখা। ধ্রুপদী সাংখ্য দর্শনের যে প্রাচীনতম গ্রন্থটি পাওয়া গিয়েছে সেটি হল ঈশ্বরকৃষ্ণের লেখা সাংখ্যকারিকা (৩৫০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ)।[১৭]:৬৩ ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব নিয়ে সাংখ্যকারিকা নীরব। যদিও গৌড়পাদ প্রমুখ প্রথম সহস্রাব্দের টীকাকারের মনে করেন, এই গ্রন্থটি ঈশ্বর সংক্রান্ত কয়েকটি ধারণার অনুকূল। যদিও সাংখ্যসূত্র (খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী) ও তার টীকাকারেরা স্পষ্টভাবে যুক্তি দেখিয়ে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।[২৪]
চার্বাক হল ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ও নাস্তিক্যবাদী শাখা। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ এই শাখাটি একটি পদ্ধতিগত দার্শনিক শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চার্বাকপন্থীরা পুনর্জন্ম, মৃত্যুপরবর্তী জীবন, দেহাতীত আত্মা, ক্রিয়াকাণ্ডের যথার্থতা, অন্যান্য জগত (স্বর্গ ও নরক), ভাগ্য এবং নির্দিষ্ট কর্মের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্য বা মূল্যহীনতা অর্জনের মতো অধিবিদ্যামূলক ধারণাগুলি প্রত্যাখ্যান করেন। তারা প্রাকৃতিক শক্তিগুলির উপর অতিলৌকিক কারণ আরোপেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পর চার্বাক দর্শনের বিলুপ্তি ঘটে।[২৫]
আজীবক আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা মক্খলি গোসাল ছিলেন বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র গৌতম বুদ্ধ ও জৈনধর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র মহাবীরের সমসাময়িক। গোসল ও তার অনুগামীরা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর পর এই আন্দোলনের বিলুপ্তি ঘটে।[২৬]
মীমাংসাবাদীরা বলতেন, জগতের সৃষ্টিকর্তা কে তা চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। বেদের লেখক বা সংকলকেরও প্রয়োজন নেই। অনুষ্ঠানগুলি অনুমোদন করার জন্য ঈশ্বরেরও প্রয়োজন নেই।.[২৭] তারা আরও বলেছেন যে, বেদে যে সকল দেবতার নামের উল্লেখ আছে, শুধুমাত্র তাদের নামোল্লেখকারী মন্ত্রগুলির মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ। তাদের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। সেই অর্থে, মন্ত্রগুলির শক্তিকেই দেবতার শক্তি হিসেবে দেখা হয়।[২৮] মীমাংসাবাদীদের মতে, কোনো নিরাকার ঈশ্বর বেদের রচয়িতা নন। কারণ, কথা বলার জন্য তার কণ্ঠই নেই। কোনো সাকার ঈশ্বর বেদ রচনা করতে পারেন না। কারণ, এমন ঈশ্বর ইন্দ্রিয়গত জ্ঞানের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার আওতায় পড়েন। তাই তিনি বেদের মতো অতিলৌকিক প্রকাশিত বাক্য রচনায় অক্ষম।[২৯]
চিরন্তন ও স্বয়ম্ভু সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সাংখ্য দর্শনের যুক্তি নিম্নরূপ:[২৪]
এই কারণে সাংখ্য দর্শন মনে করে, বিভিন্ন বিশ্বতত্ত্ব-সংক্রান্ত, তত্ত্ববিদ্যা-সংক্রান্ত ও পরমকারণমূলক যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। শুধু তাই নয় সাধারণভাবে যে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান, অন্তর্যামী, করুণাময় সৃষ্টিকর্তা মনে করা হয়, তারও কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভারতীয় নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী অমর্ত্য সেন ক্যালিফোর্নিয়া ম্যাগাজিন-এর জন্য প্রণব বর্ধনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে (ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কেলে কর্তৃক জুলাই-অগস্ট ২০০৬ সংস্করণে প্রকাশিত) বলেন:[৩০]
কোনো কোনো ভাবে মানুষের ধারণা হয়েছে ভারতচ আধ্যাত্মিক ও ধর্মকেন্দ্রিক। এর ফলে ভারতের একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যার পথ খুলে গিয়েছে। যদিও সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি বৃহৎ নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যের সম্ভার রয়েছে, যা অন্য কোনো ধ্রুপদি ভাষায় নেই। ১৪শ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য দার্শনিক মাধব আচার্য সর্বদর্শনসংগ্রহ নামে একটি মহৎ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দু ধারণার মধ্যে সকল ধর্মীয় দার্শনিক মতের কথা আলোচনা করেন। প্রথম অধ্যায়টিই ‘নিরীশ্বরবাদ’ বিষয়ক – এখানে নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদের সপক্ষে জোরালো যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান তথা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুর মতে, “...ছয়টি ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন রয়েছে – ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। এছাড়া তিনটি সাধারণ ধারা রয়েছে – বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও চার্বাক। এই নয়টি ধারার মধ্যে আটটিই নিরীশ্বরবাদী। এগুলিতে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। একমাত্র নবম শাখা উত্তর মীমাংসা বা বেদান্তে ঈশ্বরের স্থান রয়েছে।”[৩১]
According to Hinduism, the path of the atheist is a very difficult one to follow in matters of spirituality, though it is a valid one.
|ইউআরএল=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। Times of India। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০৬-০৯।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ][স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
VD Savarkar was publicly an atheist. Even when he was the Hindu Mahasabha leader he used to publicly announce and advertise lectures on atheism, on why god is not there and why all religions are false. That is why when defining Hindutva, he said, Hindutva is not defined by religion and tried to define it in a non-religious term: Punyabhoomi.