হিমস বিজয় | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: মুসলিমদের সিরিয়া বিজয় (আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ) | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
রাশিদুন খিলাফত | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ খালিদ বিন ওয়ালিদ | হারবিস | ||||||
শক্তি | |||||||
১৫,০০০ | ৮,০০০ | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
২৩৫ | ৪,৯০০ |
হিমস বিজয় (হিমস অবরোধ বা এমেসা অবরোধ নামেও পরিচিত) ৬৩৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ৬৩৬ সালের মার্চ পর্যন্ত অবরোধের পর সম্পন্ন হয়। এর ফলে মুসলিমরা সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের একটি প্রধান বাণিজ্যিক শহর হিমস অধিকার করতে সক্ষম হয়।
আজনাদায়নের যুদ্ধে বিজয়ের পর মুসলিমরা ৬৩৪ সালে দামেস্ক অধিকার করে। মুসলিম বাহিনী উত্তরের দিকে যাত্রা করে এবং ৬৩৫ সালের শেষদিকে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ খালিদ বিন ওয়ালিদকে তার মোবাইল গার্ডদের নিয়ে হিমস অবরোধের জন্য প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে তিনি মূল বাহিনী নিয়ে খালিদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। হিমস ও কিন্নাসরিনের বাইজেন্টাইন ঘাঁটি মুসলিমদের সাথে সন্ধিতে উপনীত হয়। ১০,০০০ দিনার ও ব্রোকেডের ১০০ আলখাল্লা পরিশোধের শর্তে মুসলিমরা এক বছর হিমস আক্রমণ করবে না সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাশাপাশি সহায়তার জন্য কোনো রোমান বাহিনী এগিয়ে আসলে সন্ধি ভঙ্গ হবে বলে উল্লেখ করা হয়। সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর হিমসের ফটক খুলে দেয়া হয় ফলে মুসলিমরা শহরে অবাধে চলাচল করতে সক্ষম হয়। কিন্নাসরিনের সামরিক ঘাঁটি একইরকম শর্তে সন্ধিতে উপনীত হয়। তবে এই দুই শহরের গভর্নররা সন্ধিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাদের আশা ছিল সম্রাট হেরাক্লিয়াস তাদের সহায়তার জন্য সেনা পাঠাবেন।[১] মুসলিম সেনারা হামা, শাইজার, আফামিয়া ও আল মাআরাসহ উত্তর সিরিয়ার অনেক শহরে অভিযান চালায়। এসকল একের পর এক মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং জিজিয়া দিতে সম্মত হয়।
মুসলিমরা শাইজারে অবস্থান করার সময় কিন্নাসরিন থেকে হিমসে সেনা প্রেরণের খবর পায়। এর ফলে হিমসের তরফ থেকে সন্ধি ভঙ্গ হয়ে যায়। আরব মুসলিমরা অত্যধিক শীতে অভ্যস্ত ছিল না বিধায় শীতের আগমনের ফলে বাইজেন্টাইন সেনারা কিছুটা সুবিধা পেয়েছিল। শীতের প্রকোপ থেকে সুরক্ষার জন্য মুসলিমদের কাছে তাবু ছাড়া কিছু ছিল না।[২] হিমসের সামরিক গভর্নর হারবিসকে সম্রাট হেরাক্লিয়াস চিঠি লিখে জানান, "এই লোকদের খাবার হল উটের মাংশ এবং তারা এর দুধ পান করে। তারা শীত সহ্য করতে পারে না। শীতের প্রতিটি দিন তাদের সাথে লড়াই কর যাতে বসন্তের আগে তাদের কেউ টিকে না থাকে।"
আবু উবাইদা প্রথমে হিমস হস্তগত করার সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে উত্তর সিরিয়ায় অভিযানের পূর্বে মুসলিম বাহিনীর পেছনের অংশ শত্রুমুক্ত হয়ে যেত। এরপর মুসলিমরা হিমসের দিকে যাত্রা করে। শহরে পৌছার পর খালিদের মোবাইল গার্ডের সাথে বাইজেন্টাইন সেনাদের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়। মুসলিমরা বাইজেন্টাইন সেনাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। বাইজেন্টাইনরা এর ফলে দুর্গের ভেতর অবস্থান নিয়ে ফটক বন্ধ করে দেয়। আবু উবাইদা এসে পৌছার পর তিনি পুরো বাহিনীকে চারটি অংশে বিভক্ত করে শহরের চারটি ফটকে মোতায়েন করেন:
হিমসের চারপাশ বৃত্তাকার দেয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল। এর ব্যাস ছিল এক মাইলের কম। এছাড়া দেয়ালের চারপাশ পরিখা দ্বারা ঘেরা ছিল। দেয়ালের ভেতরে পাহাড়ের উপরে একটি দুর্গও ছিল। শহরের বাইরে ছিল উর্বর সমভূমি এবং পশ্চিমে ছিল আসি নদী।[৩] আবু উবাইদা ও খালিদ উভয়ে শহরে উত্তরে রাস্তান ফটক থেকে অল্প দূরত্বে শিবির স্থাপন করেন। আবু উবাইদা খালিদের হাতে অবরোধের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে শীত তীব্র হয়ে উঠে। এসময় অবরোধ চলতে থাকে। উভয়পক্ষের মধ্যে তীর বিনিময় হলেও কোনো বড় আকারের সংঘর্ষ হয়নি। মুসলিমরা শীত সহ্য করতে পারবে না বলে বাইজেইন্টাইনদের ধারণা পুরোপুরি সঠিক হিসেবে দেখা দেয়নি।[৪] ৬৩৬ সালের মার্চের মধ্যভাগে শীত শেষ হওয়ার পর হারবিস অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুসলিমদেরকে পরাজিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাস্তান ফটক দিয়ে বের হয়ে ৫,০০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। আক্রমণের তীব্রতার কারণে এই অংশে অবস্থানকারী মুসলিমরা কিছুটা পিছিয়ে আসে।[৫] এরপর মুসলিমরা নিজেদের পুনরায় সংগঠিত করে বাইজেন্টাইন আক্রমণ প্রতিহত করে। খালিদ মোবাইল গার্ড বাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে এসে যুদ্ধের নেতৃত্ব নেন। তিনি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন ফলে রোমানরা পিছিয়ে যায়।
পরদিন সকালে আবু উবাইদা একটি যুদ্ধ সভায় খালিদের পরিকল্পনা জানতে চান। প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এর পরের দিন মুসলিমদের পিছু হটে আসার সিদ্ধান্ত হয়। মুসলিমরা অবরোধ তুলে নিচ্ছে ধারণা করে বাইজেন্টাইনরা মুসলিম বাহিনীর পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। সিদ্ধান্ত হয় যে ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলিমরা বাইজেন্টাইন বাহিনীকে ঘিরে ফেলবে।[৬]
পরিকল্পনামাফিক পরদিন সকালে মুসলিমরা অবরোধ তুলে নিয়ে দক্ষিণ দিকে সরে আসে। এরপর হারবিস সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য ৫,০০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমদের পিছু নেন। শহরের কয়েক মাইল দূরে তারা মুসলিমদের দেখা পায়। তারা অগ্রসর হওয়ার পর মুসলিমরা আচমকা অবস্থান পরিবর্তন করে তাদের উপর আক্রমণ করে। মুসলিমরা চারপাশ থেকে বাইজেন্টাইনদের ঘিরে ফেলে। জানা যায় যে খালিদ অল্প কয়েকজন আরোহী সৈনিক নিয়ে বাইজেন্টাইন বাহিনীর মধ্যভাগে উপস্থিত হয়ে হারবিসকে লড়াই করতে দেখেন। তিনি হারবিসের দিকে অগ্রসর হন কিন্তু সেসময় এক বাইজেন্টাইন সেনাপতি তার মুখোমুখি হন। খালিদ তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করেন। মুসলিমরা বাইজেন্টাইনদের ঘিরে ফেলার সময় কেউ পালিয়ে হিমসে ফিরে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্য মুয়াজ ইবনে জাবাল ৫০০ অশ্বারোহী নিয়ে হিমসের দিকে রওয়ানা হন। তাদের দেখে শহরে অবস্থানকারী রোমানরা ফটক বন্ধ করে দেয়। ফটক দিয়ে কেউ যাতায়াত করতে না পারার জন্য মুয়াজ তার সৈনিকদেরকে ফটকে মোতায়েন করেন।[৭] লড়াই শেষ হওয়ার পর মুসলিমরা হিমসে ফিরে এসে পুনরায় অবরোধ করে। স্থানীয় অধিবাসীরা এরপর শর্তের বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়। আবু উবাইদা শর্তে সম্মতি দেন। অধিবাসীরা জনপ্রতি এক দিনার জিজিয়া হিসেবে দিতে সম্মত হয়।[৮]
হিমসের আত্মসমর্পণের পর মুসলিমরা পুনরায় উত্তরের দিকে অগ্রসর হয়। তারা শাইজারে এসে পৌছায়। খালিদ এখানে কিন্নাসরিনের দিকে অগ্রসর হওয়া একটি ক্ষুদ্র রোমান বাহিনীকে গ্রেপ্তার করেন। বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের পরিকল্পনা ও এন্টিওকে একটি বৃহৎ বাইজেন্টাইন বাহিনী সমাবেশের তথ্য মুসলিমরা জানতে পারে। ৬৩৬ সালের আগস্টে এই বাহিনী ইয়ারমুকে মুসলিমদের মুখোমুখি হয়। এখানে সংঘটিত ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিমরা জয়ী হয়।