হেলাল হাফিজ

হেলাল হাফিজ
ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’তে কবিতা পড়ছেন হেলাল হাফিজ
ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’তে কবিতা পড়ছেন হেলাল হাফিজ
জন্ম(১৯৪৮-১০-০৭)৭ অক্টোবর ১৯৪৮
নেত্রকোণা, বাংলাদেশ
মৃত্যু১৩ ডিসেম্বর ২০২৪(2024-12-13) (বয়স ৭৬)
পেশাকবি, সাংবাদিক
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
সময়কালবিংশ শতাব্দী
ধরনকবিতা
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিযে জলে আগুন জ্বলে
কবিতা ৭১
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারআবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১৩)

হেলাল হাফিজ (৭ অক্টোবর ১৯৪৮ — ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪) একজন বাংলাদেশী আধুনিক কবি। প্রেম ও দ্রোহের কবি[][] হিসেবে সুপরিচিত হাফিজ বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কবিতা সংকলন যে জলে আগুন জ্বলে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।[] ২৬ বছর পর ২০১২ সালে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কবিতা একাত্তর। তার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’;- এ কবিতার দুটি পঙ্‌ক্তি ‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’ বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে।[] তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।[]

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ই অক্টোবর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[] তার পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার ও মাতা কোকিলা বেগম। হাফিজের যখন তিন বছর বয়স, তখন তার মাতা মারা যান।[] তার ছেলেবেলা কেটেছে নেত্রকোনায়। তিনি ফুটবল, ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ছিলেন। শহরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লন টেনিস খেলা দেখতে যেতেন এবং এর থেকে এই খেলার ভক্ত হয় ওঠেন।[]

হাফিজ ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিদ্যালয়ের দেয়াল পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ডাক্তার হওয়ার আগ্রহ নিয়ে কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু কলেজের পাঠ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।[]

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।[]

মুক্তিযুদ্ধের সময়

[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।

সাহিত্য কর্ম

[সম্পাদনা]

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" কবিতা লিখেন। এই কবিতার প্রথম দুইটি ছত্র "এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়"। হাফিজ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, "কবিতাটি কোনো পত্রিকা প্রকাশ করতে সাহস পায়নি।" আহমদ ছফাহুমায়ুন কবির কবিতাটির প্রথম দুটি ছত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক এই কবিতা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং এই ছত্র দুটি সেসময় রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়।[] ১৯৮৬ সালে হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে প্রকাশিত হয়। এটি বিপুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তীকালে বইটির ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।[] এই বইয়ের একাধিক কবিতা বিভিন্ন আবৃত্তিশিল্পী আবৃত্তি করেছেন। দীর্ঘ আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কবিতা একাত্তর প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালে তার তৃতীয় ও সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ বেদনাকে বলেছি কেঁদো না প্রকাশিত হয়। পরের দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রথম কাব্যগ্রন্থের মত আলোচিত হয়নি।[১০]

কাব্যগ্রন্থ

[সম্পাদনা]
  1. যে জলে আগুন জ্বলে (১৯৮৬)
  2. কবিতা ৭১ (বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়, একুশে বইমেলা ২০১২)
  3. বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা (২০১৯)

কবিতা

[সম্পাদনা]
  1. নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
  2. নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল
  3. দুঃসময়ে আমার যৌবন
  4. অস্ত্র সমর্পণ
  5. অগ্নুৎসব
  6. বেদনা বোনের মতো
  7. ইচ্ছে ছিলো
  8. প্রতিমা
  9. অন্যরকম সংসার
  10. নিখুঁত স্ট্রাটেজি
  11. আমার সকল আয়োজন
  12. হিরণবালা
  13. দুঃখের আরেক নাম
  14. প্রত্যাবর্তন
  15. তীর্থ
  16. অনির্ণীত নারী
  17. অশ্লীল সভ্যতা
  18. কবিতার কসম খেলাম
  19. পরানের পাখি
  20. বাম হাত তোমাকে দিলাম
  21. উপসংহার
  22. শামুক
  23. আমার কী এসে যাবে
  24. ইদানীং জীবন যাপন
  25. পৃথক পাহাড়
  26. অহংকার
  27. কোমল কংক্রিট
  28. নাম ভূমিকায়
  29. সম্প্রদান
  30. একটি পতাকা পেলে
  31. মানবানল
  32. যার যেখানে জায়গা
  33. কবি ও কবিতা
  34. ফেরিঅলা
  35. উৎসর্গ
  36. যেভাবে সে এলো
  37. রাডার
  38. যাতায়াত
  39. যুগল জীবনী
  40. লাবণ্যের লতা
  41. তোমাকেই চাই
  42. ভূমিহীন কৃষকের গান
  43. কবুতর
  44. নেত্রকোণা
  45. তুমি ডাক দিলে
  46. হিজলতলীর সুখ
  47. রাখাল
  48. ব্যবধান
  49. কে
  50. অমীমাংসিত
  51. সন্ধি
  52. ক্যাকটাস
  53. তৃষ্ণা
  54. হৃদয়ের ঋণ
  55. প্রস্থান
  56. ঘরোয়া
  57. রাজনীতি
  58. ডাকাত

পুরস্কার

[সম্পাদনা]

কবিতার জন্য পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্‌যাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ, কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা,বাসাসপ কাব্যরত্ন - ২০১৯ প্রভৃতি।[] কবিতায় তিনি ২০১৩ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

হেলাল হাফিজ ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গ্লুকোমায় আক্রান্ত ছিলেন। ঢাকার শাহবাগের এক হোস্টেলে বসবাস করতেন। সেই হোস্টেলের বাথরুমেই তিনি পড়ে যান। প্রায় ৩০ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরে বাথরুমে তার সাড়াশব্দ না পাওয়ায় হোস্টেলের নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।[১১] হেলাল হাফিজ কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও স্নায়ু রোগে ভুগছিলেন।[১২]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "চলে গেলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ"বাংলা ট্রিবিউন। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ 
  2. "হেলাল হাফিজ: একটিমাত্র কবিতা লিখে যিনি ছাত্রাবস্থায় তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন"বিবিসি নিউজ বাংলা। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ 
  3. মাহফুজ, ইমরান (২০২১-০৯-১৬)। "শেষ বেলায় মন তো চায়, কেউ একজন পাশে থাকুক: হেলাল হাফিজ"দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-১৬ 
  4. ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না'।
  5. "পুরস্কৃত হল পুরস্কার নিজে"। ১১ আগস্ট ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৪ 
  6. "কবি হেলাল হাফিজের বর্ণাঢ্য জীবন"দৈনিক যুগান্তর। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ 
  7. "দ্রোহ ও ভালোবাসার কবি হেলাল হাফিজ না ফেরার দেশে"দৈনিক যুগান্তর। ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ 
  8. হাসান, মাহমুদ। "তারুণ্যের ভালোবাসা ও হেলাল হাফিজ"বাংলাদেশ প্রতিদিন। ২১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মার্চ ২০১৪ 
  9. দৈনিক যুগান্তর; ৮ অক্টোবর, ২০১৩
  10. আহসান, কামরুল (১৪ ডিসেম্বর ২০২৪)। "কবির মৃত্যুতে কাঁদতে নেই"ভিউজ বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ 
  11. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০২৪-১২-১৩)। "শৌচাগারে পড়ে যান কবি হেলাল হাফিজ, আধা ঘণ্টা পর অচেতন অবস্থায় করা হয় উদ্ধার"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-১৩ 
  12. নিউজ, সময়। "কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন | বাংলাদেশ"Somoy News। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-১৩ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]