ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালীন সকল আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান এবং রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙ্গালীর স্বাধীনতার দাবী দমন করার প্রয়াসে "অপারেশন সার্চলাইট" নামে গণহত্যার পরিকল্পনা করে, যা ২৫ মার্চ রাতে বাস্তবায়ন করা হয়।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে।[১]
২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়।[২]
অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। তার স্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করে। তারা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান, কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান।[৩] ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তার বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সন্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তার বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে কাজ সমাধা করে গেছে, তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি জানান যে, ওই ভবনে আরও একজন পূর্ব-পাকিস্তানি অধ্যাপক বাস করতেন, যিনি ২৫ মার্চের আগেই ঘর ছেড়ে যান। অন্যসব বাসায় অবাঙ্গালী কিছু পরিবার থাকতো, যারা অন্যদের কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়।[৪]
১২ নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্তানি আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। আর্মি তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তার মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয়া যায়। পরে তার আত্মীয়েরা তাকে পল্টনে সমাহিত করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ক ম মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে আহত হন। ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাসে আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করে।
তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে, সংগে তার মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তার পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[৩] হলের ইলেক্ট্রিশিয়ান চিত্রাবলী ও চাক্ষুস সাক্ষী রাজকুমারী দেবী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন এবং তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে সমাহিত করেন।
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও রাখা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়।[৫] অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস "রাইফেল, রোটি, অওরাত" থেকে এ তথ্য জানা যায়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন। তিনি তার এই জনপ্রিয় উপন্যাসটি ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন ৯ মাসে রচনা করেন।
অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের "স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ"কে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। অধ্যাপক ড. ক ম মুনিমের মতে, এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করে।
রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি। তারা উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। সেই আঘাতে ৩৪ জন ছাত্র প্রাণ হারান। জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র রমনা কালী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে ৫/৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের নাম পরবর্তীকালে জানতে পারা যায়, তার নাম রমণীমোহন ভট্টাচার্য্য। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোণার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর।[৩]
ছাত্রীহত্যা
আর্চার কে ব্লাড-এর বই "The Cruel birth of Bangladesh" হতে জানা যায় যে, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়।[৬]
• উপেন্দ্র নাথ রায়: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (গ্রাম: গুলিয়ারা, দিনাজপুর) • কার্তিক শিল : শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (কলাখালি, বরিশাল) • কিশোরী মোহন সরকার : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (পারাগ্রাম, ঢাকা) • কেশব চন্দ্র হাওলাদার : প্রথম বর্ষ গণিত (কাঁচাবালিয়া, বরিশাল) • গণপতি হাওলাদার: রসায়ন (ঘটিচরা, বরিশাল) • জীবন কৃষ্ণ সরকার : শেষ বর্ষ রসায়ন (কুলপাতক, ময়মনসিংহ) • নণী গোপাল ভৌমিক : দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (শ্যাম গ্রাম, কুমিল্লা) • নির্মল কুমার রায় : প্রথম বর্ষ এমকম • নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান • নিরঞ্জন হালদার: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (শিকড়পুর, বরিশাল) • প্রদীপ নারায়ন রায় চৌধুরী: প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ছাত্র
জহরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর গার্ডদের হত্যা করা হয়। তারপর হলের কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী ও আব্দুল মজিদকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লাউঞ্জে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় আহমেদ আলী, আব্দুল খালেক, নমি, মোঃ সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুদ্দিন ও মোঃ চুন্নু মিয়াকে।
শহীদ মিনার ও বাংলা অ্যাকাডেমী আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাদলটি শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন শিক্ষকনিবাসগুলোয় এবং মধুসূদন দে'র বাসভবনেও আক্রমণ করে। ১১ নং ভবনে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ সাদেককে হত্যা করা হয়। এখানে পাকবাহিনী প্রায় ৫০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যাদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ অফিসার (রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থেকে পালিয়ে আসা), রাষ্ট্রপতি ভবনের পাহারার দায়িত্বে থাকা ইপিআর সদস্যগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ নং আবাসিক ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়া নীলক্ষেত বস্তির কয়েকজন অধিবাসী।[৩]
মার্চের ২৫ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভিন্ন ধর্মালম্বীদের তিনটি উপাসনালয় ধ্বংস করে ফেলে - কলা ভবন সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানক শাহী, রমনা কালী মন্দির ও শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শিব মন্দির। রাতে দর্শণ বিভাগের কর্মচারী খগেন দে, তার ছেলে মতিলাল দে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, ডাক্কুরাম, ভিমরায়, মণিরাম, জহরলাল রাজবর, মনবরণ রায়, রাজবর ও সংকর কুরীকে হত্যা করা হয়ী[৩]
ঢাকার তৎকালীন কাউন্সিল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড তার বই 'The cruel birth of Bangladesh' এ লিখেছেন - "ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। এছাড়া, ১০ নভেম্বর ১৯৭১ এ কয়েকজন সশস্ত্র দুস্কৃতিকারী রোকেয়া হল আক্রমণ করে এবং ৩০ জনের মতো ছাত্রীকে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো অবরুদ্ধ করে রাখে। তারা প্রভোস্টের বাড়িও আক্রমণ করে"। ১৯৭১ এর সেই সময়ে রোকেয়া হলের কাছেই দু'টি শক্তিশালী সেনা ঘাটি ছিলো, তাদের অজ্ঞাতসারে ছাত্রীনিবাসে দুই ঘণ্টা ধরে এই আক্রমণ চালানো একেবারেই অসম্ভব ছিলো।[৬] তাই ধরে নেয়া যায় যে, এটা তাদেরই কারো অথবা তাদের সুবিধাভোগী বিহারীদের কাজ ছিলো।
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান আদেশ জারী করেন, ২১শে এপ্রিল থেকে বিভাগীয় প্রধানদের এবং ১লা জুন থেকে বাকি শিক্ষকদের কাজে যোগদান করতে হবে। তার আদেশ অনুযায়ী, আগস্টের ২ তারিখ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে শিক্ষার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখানোর জন্য সব ছাত্রাবাস থেকে সব ধরনের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করে ফেলা হয়। জাতীয় দুর্যোগের কারণে সকল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই সময় ক্লাসে ছাত্র উপস্থিতি ছিলো নগণ্য। কিন্তু সেপ্টেম্বর নাগাদ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো, তারা খুব দ্রুত গ্রেনেড ফাটিয়ে আবার ক্লাসে ঢুকে যেত। যে কারণে পাকবাহিনী কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি।[৪]
মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রমাণিত যোগাযোগের কারণে টিক্কা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে এবং কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। এদের মধ্যে ছিলেন ড আব্দুল খায়ের, ড রফিকুল ইসলাম, ড ক আ ম সালাউদ্দিন, আহসানুল হক, গিয়াসুদ্দিন আহমেদ, জহরুল হক ও ম শহীদুল্লাহ। মার্শাল ল জারীকারী গভর্নর লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান দাপ্তরিকভাবে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং অধ্যাপক এনামুল হককে সতর্ক করে। ড আবু মোহাম্মাদ হাবিবুল্লাহ চাকরি হারান। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে (রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক সম্মানভূষিত) ১৪ বছর জেলের সাজা দেয়া হয়।[৭]
১৯৭১ এ যুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খালি রাখা হয়েছিলো। মার্চের গোড়ার দিকে তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভায় অবস্থান করছিলেন "United Nation’s Humanitarian Conference" এ অংশগ্রহণের জন্য। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পত্রিকা মারফত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রাদেশিক শিক্ষাসচিবের কাছে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন এবং জেনেভা থেকে পালিয়ে লন্ডনে আত্মগোপন করেন। সেখানে থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য কাজ করে যান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি পরবর্তীকালে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড সাইয়িদ সাজ্জাদ হুসেইনকে তুলে আনে এবং তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যারা পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ড হাসান জামান, ড মোহর আলী, ড আ ক ম আব্দুর রহমান, ড আব্দুল বারী, ড মুকবুল হোসেন, ড সাইফুদ্দিন জোয়ার্দার প্রমূখ। রাজাকার এবং উপাধ্যক্ষ ড সাইয়িদ সাজ্জাদ হুসেইন, ড হাসান জামান এবং ড মোহর আলীকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গ্রেফতার করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়[৮]।
১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকারের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে যে তারা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। ২রা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খোলার পর, পাকিস্তানি দোসর শিক্ষকেরা নওয়াব আব্দুল গণি রোডে মিলিত হন এবং একটি তালিকা তৈরি করেন, যাতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাথে জড়িত শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিদের নাম তালিকাবদ্ধ করা হয়। এর আগে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাকিস্তানপন্থী কিছু ছাত্রদের দল গড়ে গোপনে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এদের নাম দেয়া হয় আল-বদর। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এই আল-বদর দলের সদস্যরা মাঠে নামে। তারা তালিকা অনুসারে বাঙ্গালী অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং আরো অনেক মেধাবী বুদ্ধিজীবিদের বেছে বেছে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।