২১ মার্চ, ২০১২ তারিখে মালির সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্যদের দ্বারা দেশটির রাষ্ট্রপতির বাসভবন, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র ও সেনানিবাস আক্রমণের মধ্য দিয়ে এই সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়। অভ্যুত্থানের পর বিদ্রোহী সৈন্যরা ঘোষণা দেয় যে তারা দেশটির রাষ্ট্রপতি আমাদু টুমানি টোরেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং বর্তমানে ন্যাশনাল কমিটি ফর দ্য রিস্টোরেশান অফ ডেমক্রেসি অ্যান্ড স্টেট অর্ডার নামক একটি কমিটি তৈরি করে তার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছে।
অভ্যুত্থানের সময় বাসভবনে হামলা চলাকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি টোরে সেখানে ছিলেন না। অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। একাধিক সূত্রমতে তিনি তার অনুগত সৈন্যদের হেফাজতে কোন গোপন স্থানে রয়েছেন।
অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহ আগে মালির উত্তরাঞ্চলে যাযাবর ও আদিবাসীদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহ দমনে সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়োজিত করলে সেনা সদস্যরা সরকারের কাছ থেকে আরও বেশি কারিগরি সাহায্য ও অস্ত্রশস্ত্রের জন্য দাবী জানাতে থাকে। সংশ্লিষ্ট দাবী সমূহ না মেটার ফলে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সরকারবিরোধী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যার ফলশ্রুতিতে সামরিক অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটে।[৩]
এপ্রিল ২০১২-তে মালিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, যার আগে সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি আমাদু টোরের মেয়াদ শেষ হয়ে যেত।
২১ মার্চ তারিখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল সাদিও গাসসামা রাজধানী বামাকোর ১৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত কাটি সামরিক ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।[৪] তিনি মূলত পরদিনের জন্য নির্ধারিত একটি সেনা বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠান না করার জন্য সৈন্যদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে সেখানে যান।[৫] পরিদর্শনের সময়ে গাসসামা সৈন্যদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। তার গাড়ির উদ্দেশ্যে পাথর ছোঁড়া হয়। এর জবাবে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সৈন্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ সময় স্থানীয় সেনা অধিনায়ক সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে রক্ষা করে বের করে নিয়ে যান।[৬][৭]
মূলত এই ঘটনার পর থেকে অভ্যুত্থান দানা বাঁধতে শুরু করে। কাটি সেনা ক্যাম্প থেকে সারিবদ্ধ ভাবে সাঁজোয়া যান রাজধানী বামাকোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। এ সময়ে শহরে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্রের কাছে একটানা গুলিবর্ষণ বা গুলি বিনিময়ের শব্দে পুরো শহরে সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে যায়। একই সাথে সরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।[৮]
একই সময়ে আরেকদল সৈন্য রাষ্ট্রপতির বাসভবন দখলের উদ্দেশ্যে সেখানে যায়। কোন প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ছাড়াই তারা ভবন নিয়ন্ত্রণে নেয়। বিদ্রোহী এক সৈন্যের সাথে কথা বলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিনিধি জানতে পারেন, গুলিবর্ষণ করে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করার সময়ে তারা কোন বাধার মুখে পড়েনি। পরে তারা সেখানে ও আশপাশের এলাকায় রাষ্ট্রপতি আমাদু টোরের খোঁজে অভিযান চালালেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঐদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সম্প্রচারে ফিরে আসে। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে দেশীয় সংগীত প্রচার করা হয় এবং সাথে ঘোষণা দেয়া হয়, কিছুক্ষণের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ঘোষণা দিবে।[৮]
সেদিন রাতেই রাজধানীর সংলগ্ন গাও শহরের সেনা ক্যাম্পে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পরে। সেখান থেকে জানানো হয়, সশস্ত্র বাহিনীর অপেক্ষাকৃত তরুণ সদস্যরা অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া চালাচ্ছে ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করছে।[৯][১০]
এদিন সকালে আমাদু কোনারে নামক সামরিক অফিসার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিজেকে বিদ্রোহী সেনাদের মুখপাত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে ঘোষণা করেন, বিদ্রোহী সেনারা ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর দ্য রিস্টোরেশান অফ ডেমক্রেসি অ্যান্ড স্টেট অর্ডার’ (সিএনআরডিআর) নামক কমিটি গঠন করেছে। তিনি জানান এই কমিটির নেতৃত্বে সৈন্যরা ‘আমাদু টোরের অযোগ্য সরকার’-কে উৎখাত করে রাষ্ট্রের গ্রহণ করেছে এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকবে।[১১]
পরে আমাদু সানোগো নামক সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন নিজেকে সিএনআরডিআরের প্রধান হিসেবে উপস্থাপন করে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করেন।[১২]
পুরো সময়ে বিদ্রোহী সৈন্যরা রাষ্ট্রপতি টোরেকে খুঁজে পেতে অক্ষম হন।[১৩]
সকালে কেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোসেস ওয়েটাঙ্গুলা আফ্রিকান ইউনিয়নের একটি সভায় যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে মালিতে অবস্থান করছিলেন। তিনি জানান যে, বামাকো বিমান বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তিনি মালি ছাড়তে পারছেন না। তিনি তার অবস্থানের কাছাকাছি কোথাও গুলিবর্ষণের শব্দ শুনেছেন বলেও জানান।[১৪]
রাষ্ট্রপতি টোরের অনুগত সেনা অফিসারদের একজন জানান যে রাষ্ট্রপতি সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নিরাপত্তার কথাও তিনি নিশ্চিত করেন, যদিও প্রথমে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়েছেন। অবশ্য মালির পররাষ্ট্র মন্ত্রী অভ্যুত্থানের শুরুতে বিদ্রোহীদের হাতে আটক হন।[১৫]
এদিন শেষের দিকে জানা যায় রাষ্ট্রপতি টোরে তার অনুগত সেনা অফিসার অধ্যুষিত একটি সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন।[১৬]
সিএনআরডিআরের নেতা ক্যাপ্টেন আমাদু সানোগো তার ঘোষণায় দেশবাসীকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে জানান, দেশের সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।[১৭]
বিবিসির মালি প্রতিনিধি নিশ্চিত করেছেন, মাই সশস্ত্র বাহিনীর এলিট ফোর্স রেড বেরেটস রাষ্ট্রপতি টোরের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছে।
দিনের শেষভাগে বিদ্রোহী সৈন্যদেরকে রাষ্ট্রপতি ভবন লুটপাটে নিয়োজিত হতে দেখা যায়। জানা যায় তারা ভবনের টেলিভিশন-সহ অন্যান্য মূল্যবান আসবাবপত্রাদি নিয়ে যাচ্ছেন, যদিও তাদের নেতা ক্যাপ্টেন আমাদু সানোগো এমনকি বিজয়সূচক ফাঁকা গুলিবর্ষণ করতেও নিষেধ করেছেন। ২২ মার্চ রাত পর্যন্ত রাজধানীতে এ ধরনের গুলিবর্ষণের ফলে অন্তত ২০ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে।[১৮]
সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে জানা যায়, আমাদু টোরে রেড বেরেটস-দের হেফাজতে রাজধানীরই কোন অজ্ঞাত স্থানে অবস্থান করছেন ও ক্ষমতার ‘অনেকাংশেরই’ নিয়ন্ত্রণে আছেন।[২]
মালি সশস্ত্র বাহিনীর ৩১ প্যারাশুট রেজিমেন্টকে ‘রেড বেরেটস’, অর্থাৎ বিশেষ নিরাপত্তা সেনাদল বা স্পেশাল ফোর্সেস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি আমাদু টোরে, যিনি একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, নিজেও কর্মজীবনে ‘রেড বেরেটস’-এর একজন অফিসার ছিলেন।