ওয়ালপেপার হচ্ছে ঘর, অফিস, ক্যাফে, সরকারী ভবন, জাদুঘর, পোস্ট অফিস এবং অন্যান্য বিল্ডিং এর অভ্যন্তরস্থ প্রাচীরকে আবৃত এবং সজ্জিত করার একটি উপাদান; এটি অভ্যন্তরস্থ সজ্জার ই একটি অংশ। এটি সাধারণত রোলের মধ্যে করে বিক্রি করা হয়; এবং দেয়ালে লাগানোর সময় ওয়ালপেপার পেস্ট লাগানো হয়। ওয়ালপেপার "পাতলা কাগজের" ন্যায়ও হতে পারে। (যাতে করে একে চিত্রায়িত করা যায় অথবা সংকীর্ণ বা ত্রুটিযুক্ত দেয়ালকে ভালোভাবে প্রদর্শিত করা যায়), টেক্সচারড (যেমনঃ এনাগলিপটা), যেখানে নিয়মিত বিন্যাস দেখা যায়। এখন অবশ্য একটাই নকশা বিস্তৃতপরিসরে দেখা যায়। ছোট চতুর্ভুজ করে, একই বিন্যাস, যদি ওয়ালপেপারে বারবার পুনরাবৃত্ত করা হয়, তবে এটি পুনরাবৃত্ত ওয়ালপেপার নামে পরিচিত হয়।
ওয়ালপেপার প্রিন্টিং কৌশলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ক্ষেত্রীয় প্রিন্টিং, গ্রাভেয়ার প্রিন্টিং, সিল্কস্ক্রিন প্রিন্টিং, ঘুর্ণীয় প্রিংটিং, এবং ডিজিটাল প্রিন্টিং। ওয়ালপেপার লম্বা রোলের মধ্যে তৈরী হয়; যা দেওয়ালে উলম্বভাবে ঝুলানো হয়। বিন্যাসের যে ওয়ালপেপার তা এমনভাবে নকশা করা হয় যে; যা দেখে তার নিয়মিত অবস্থা বুঝা যায় এবং অংশ একই রোল থেকে এমনভাবে কাটা হয় ও, পাশাপাশি উভয়কে এমনভাবে সংযোগ করা যায়; যাতে দেখে সহজে বুঝা না যায় সংযোগ অংশটা কোথায়। জটিল বিন্যাসিত চিত্র সংক্রান্ত ওয়ালপেপারের ক্ষেত্রে প্রথমে অর্ধেক থেকে শুরু হয়। অর্থাৎ ওয়ালপেপারের চিত্রের আকার যদি ২৪ ইঞ্চি হয়, এবং তারপর ২৪ ইঞ্চি পরে নতুন করে আবার পুনরাবৃত্ত হয়, তাহলে প্রথমে ১২ ইঞ্চি থেকে তা শুরু হয়। এমনটাই সাধারনত দেখা যায়।[১] একই প্যাটার্ন নানান রংয়ের হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ওয়ালপেপার হলো 'লেস গুয়েরেস ডি'ইন্ডিপেন্ডেন্স' (স্বাধীনতা যুদ্ধ), যার মুল্য £২৪,৮৯৬.৫০ ($৪৪,০৯১, অথবা €৩৬,৩৫০) ; যা ৩২ প্যানেলের সেট। এই ওয়ালপেপার জুবার দ্বারা নকশা করা হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রে খুবই জনপ্রিয়।[২]
ওয়ালপেপার তৈরীতে ইতিহাসে যে সব কৌশল গুলো দেখা যায়;- তা হলোঃ হাতে তৈরী চিত্র, উডব্লক প্রিন্টিং, স্টেইনসিলিং, এবং বিভিন্ন ধরনের মেশিন প্রিন্টিং। এরমধ্যে প্রথম তিনটাই ১৭০০ সালের পুর্বে দেখা যেত।[৩]
ওয়ালপেপার, যা উডকাটের কৌশল প্রিন্টমেকিং; তা ইউরোপের রেনেসার সময় মধ্যবিত্ত সমাজের উথ্থানের সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সমাজের উচ্চবিত্তরা তাদের গৃহের দেয়ালে লম্বা ট্যাপেস্ট্রিকে ঝুলাতেন। এই ট্যাপেস্ট্রি ঘরে ভিন্ন মাত্রার রং নিয়ে আসত; একই সাথে এই ট্যাপেস্ট্রি ঘরের তাপ বাইরে যেতে দিত না বলে ঘর গরম থাকত। যাইহোক; ট্যাপেস্ট্রির অনেক মুল্য ছিল; তাই মধ্যবিত্তরা একে এড়িয়ে চলতেন।
প্রথমদিককার ওয়ালপেপারে ট্যাপেস্ট্রির ন্যায় দৃশ্য দৃশ্যায়িত হত। যা মাঝেমধ্যে দেয়ালে ঝুলানো হত এবং আজকের ন্যায় সেখানেই আঠালো হিসেবে লাগানো হত। প্রিন্টকে দেয়ালে ঝুলানোর পরিবর্তে দেওয়ালেই আঠারো মত করে লাগানো হত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কলাকৌশলী যেমনঃ আলবার্ট দুরের যিনি বৃহৎ আকৃতির প্রিন্ট ও কারুকার্যময় প্রিন্টের উপর কাজ করেছিলেন, তিনি দেয়ালেই ওয়ালপেপার ঝুলাতেন। সবচেয়ে বড় রঙিন প্রিন্ট হলো, ১৫১৫ সালে রোমান সম্রাট প্রথম ম্যাক্সিমামের পৃষ্ঠপোশকতায় নির্মিত দ্য ট্রিয়াম্ফাল আর্চ। এই প্রকান্ড প্রিণ্ট দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৩.৫৭ মিটার ও ২.৯৫ মিটার ছিল। প্রথম সংস্করণে এটি ৭০০ কপি তৈরী হয়েছিল। যা প্যালেসে নির্মাণের জন্যই নির্মিত হয়েছিল।
প্রথমদিকের বিন্যাস থাকা খুব কম ওয়ালপেপারই এখন পর্যন্ত টিকে আছে; তবে অধিক সংখ্যক পুরাতন মাস্টার প্রিন্ট ও খোদাই করা নিয়মিত বিন্যাস, যুক্ত সজ্জিত ওয়ালপেপারের অস্তিত্ব আছে।
ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স; ওয়ালপেপার কারখানাগুলোর মধ্যে সেরা ছিল। ১৫০৯ খ্রিষ্ঠাব্দের পূর্বে সেখানে ওয়ালপেপার নির্মিত হত। ৮ম হেনরীর পরে ইংল্যান্ডে তা খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ইংরেজ অভিজাতরা সবসময় ট্যাপেস্ট্রি ফ্ল্যান্ডার ও এরাস থেকে আমদানী করত, কিন্তু হেনরীর সাথে ক্যাথলিক গীর্জার বিরোধ বাধে। ফলে ইউরোপে এর চল পরে যায়। ট্যাপেস্ট্রি না থাকায়, ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ ওয়ালপেপার ব্যাবসার দিকে ঝুকে পরে।
অলিভার ক্রোমওয়েলের অভিভাবকত্বকালীন সময়ে পুরিটান সরকার দ্বারা ওয়ালপেপারের ব্যবসায় ইচ্ছাকৃতভাবে নানা বাধাবিঘ্ন দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় চার্লসের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময়, উচ্চবিত্তরা ওয়ালপেপারের প্রতি পুনঃপুন আগ্রহ প্রকাশ করে। ক্রোমওয়েল কিছু বিরক্তিকর সংস্কৃতি তার রাজ্যের মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর, মানুষ এ সব বিষয়কে প্রত্যাখান করে, এবং নিজেদের পছন্দমত গৃহস্থালী আসবাব ক্রয় করা শুরু করে।
১৭১২ সালে কুইন এনির শাসনামলে ওয়ালপেপার ট্যাক্সের ব্যবস্থা করা হয়; যা ১৮৩৬ অবধি বজায় থাকে। ১৮ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপে ব্রিটেন প্রচুর পরিমাণ ওয়ালপেপার রপ্তানী করে। যাইহোক, এই বাণিজ্য ১৭৫৫ সালে সাত বছরের যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যায়।
১৭৪৮ সালে প্যারিসে ব্রিটিশ এম্বাসেডর তার বৈঠকখানা নীল ফ্লক ওয়ালপেপার দ্বারা আবৃত করে; যা তৎকালীন সময়ে খুবই কেতাদুরস্থ ছিল। ১৭৬০ সালে ফরাসি কারখানা মালিক জিন ব্যাপটিস্টে রিভিলিয়ন নকশাকারীকে ভাড়া করেন যাতে করে তৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সূক্ষ্ম ওয়ালপেপার তৈরী করা হয়। তার ফ্লেউরস-ডি-লাইস সহযোগে আকাশী নীল ওয়ালপেপার; ১৭৮৩ সালে মনটগোলফাইয়ার ভাইয়ের দ্বারা প্রথম বেলুনে ব্যবহৃত হয়।[৩] ভূদৃশ্য চিত্রকর জিন ব্যাপটিস্ট পিলমেন্ট ১৭৬৩ সালে দ্রুত রঙ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
হস্ত-ব্লকড ওয়ালপেপারে বিভিন্ন দৃশ্য মানুষ এবং পশুপাখির চিত্র পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলা হয়। ১৮ শতকের দিকে এই ওয়ালপেপারে প্রাচীন দৃশ্য, যাজকসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আসা হয়।
১৭৮৫ সালে ক্রিস্টোফি-ফিলিপ ওবারক্যম্ফ প্রথম মেশিন উদ্ভাবন করেন; যা ওয়ালপেপারের চাদরের উপর রঙিন ছোঁপ ফেলতে পারে। ১৭৯৯ সালে লুইস নিকোলাস রবার্ট একটি মেশিন প্যাটেন্ট করেন; যা ক্রমাগত পেপারের ব্যপ্তি তৈরো করে, যা ফোরড্রিনার ম্যাশিনের পুর্বসুরী ছিল। এই সক্ষমতা ইউরোপের উপন্যাসের নকশায় এবং চিত্রাঙ্কন ক্লাসে প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়।[৪]
ওয়ালপেপার কারখানা ইংল্যান্ডে ১৮ শতকে সক্রিয় হয়।[৩][৫] ১৮ শতকে আমেরিকায় যেসব সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জে.এফ. বামস্টিড & কর্পোরেশন (বোস্টন), উইলিয়াম পয়েনটিল (ফিলাডেলফিয়া), জন রুগার (নিউ ইয়র্ক)।[৩]
উচ্চ-গুণসম্পন্ন ওয়ালপেপার; ১৭ শতকের পর থেকে চীনে সহপজলভ্য হয়ে যায়। তবে তা সম্পুর্ণভাবে হাতে তৈরী ছিল এবং বহুমুল্য ছিল। এটা এখনো প্যালেসের রুম এবং রাজবাড়ির ন্যায় বাড়িগুলোতে দেখা যায়। যেখানে, নিয়ামফেনবার্গ প্যালেস, ল্যাযিনকি প্যালেস, চ্যাটসওর্থ হাউস, টেম্পল নিউসাম, ব্রওটন ক্যাসেল, লিসান হাউস, এবং এরডিগ উল্লেখযোগ্য। এটি ১.২ মিটার প্রশস্ত। ইংরেজ, ফরাসী ও জার্মানিরা একে অনুকরণ করত। এটার প্রাথমিকভানে প্রিন্টেড আউটলাইন থাকত; তারপর তা হাতে রঙ করা হত।
১৮ শতকের শেষদিকে, ইংল্যাণ্ডে এবং ফ্রান্সে দৃশ্যমুলক ওয়ালপেপারের ফ্যাশন চালু হয়েছিল। ১৮ শতকের শেষে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে প্রচুর দৃশ্যসংবলিত ওয়ালপেপার বিক্রি হত। এসংক্রান্ত ওয়ালপেপারের পুনর্জীবন ঘটেছিল। চিত্রশিল্পী জিন-গ্যাব্রিয়েল চার্ভার্ট প্রস্তুতকারক জোসেফ ডুফোর এট চাইয়ের জন্য সেভেজ অব দ্য প্যসিফিক নকশা করেন; যেখানে ক্যাপ্টেন কুকের জলযাত্রার দৃশ্য ফুটে উঠেছিল।[৬] এই প্রখ্যাত তথাকথিত "পেপার পেইন্ট" ওয়ালপেপার ম্যাসাচুসেটসের পিবডির অভ্যন্তরে; পুর্বের ন্যায় অবস্থিত[৭] এটা সেসময়ের বৃহত্তর প্যানোরমিক ওয়ালপেপার এবং একে ফ্রান্সের ইন্ড্রাস্টিতে প্যানোরমিক ওয়ালপেপারের সুচনা শিল্প বলে ধরা হয়। ডিউফোর বুঝতে পেরেছিলেন, এই ধরনের পেপারের বিক্রি আমেরিকার একটা ঐতিহ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। আধুনিক ধ্রুপদী স্টাইল ফেডারেল পিরিয়ডের সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৮ শতকে, দৃশ্যকে ড্যাডোর উপরে ঝুলানো হত।
জোসেফ ডিউফোরের (১৭৯৭- ১৮৩০) পাশাপাশি অন্যান্য ফরাসী প্রস্তুতকারকরা দৃশ্য সংবলিত চিত্র ও ট্রম্পে আইওয়েল ওয়ালপেপার, জুবায়ের এট চাই (১৭৯৭–বর্তমান) এবং আর্থুর এট রবার্ট তাদের পন্য ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রপ্তানী করত। জুবায়ের এট চাইয়ের ১৮৩৪ সালের নকশা, ভিউস অব নর্থ আমেরিকা (উত্তর আমেরিকার দৃশ্য)[৮] হোয়াইট হাউজের কুটনীতিক রুমে ঝোলানো হয়েছিল।
১৮৩০ সালে যখন জোসেফ ডুফোর চাই বন্ধ হয়ে যায়, জুবার চাইয়ের তখনো অস্তিত্ব ছিল এবং ইংল্যান্ডের কলে ও পুত্র এবং এটেলিয়ার ডি অফার্ড (১৯৯৯- বর্তমান) এর সাথে একত্রে ফ্রান্সে অবস্থান করছিল। এরা ছিলেন পশ্চিম ইউরোপের উডব্লক প্রিন্ট ওয়ালপেপারের শেষ উৎপাদনকারী। এর উৎপাদনের জন্য জুবায়ের এক লক্ষ কাঠ সংগ্রহ করে ১৯ শতকে ঐতিহাসিক ভাস্কর্য নির্মান করেন। এখানে নানা দৃশ্য যেমন "ভুয়ে ডি এমেরিক নর্ড", "এলদোরাদো হিন্দুস্থান" অথবা "ইসোলাবেলা" কে স্থান দেওয়া হয় এবং তাকে জমিয়ে হস্ত নির্মত ওয়ালপেপারের ন্যায় সিলিং য়ে ঝুলানো হত।
১৯ শতকে শুরু হওয়া ওয়ালপেপারের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ ফ্রান্সের ডেসফোসে এন্ড কার্থ[৩] যুক্তরাষ্ট্রে জন বেলরোজ, ব্ল্যানচার্ড এন্ড কারি, হওয়েল ব্রাদার্স, লংস্ট্রিট এন্ড সনস, ফিলাডেলফিয়াএ আইজ্যাক পুগ, মাসাচুসেটসের বিগেলো, হাইডেন এন্ড কর্পোরেশন, নিউ ইয়র্কের ক্রিস্টি এন্ড কন্সট্যান্ট, এ. হাওয়ার্ড, আর. প্রিন্স।[৯]
ওয়ালপেপারের ঐতিহাসিক সংগ্রহ গুরুত্ব বিবেচনায় বিভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে। যেমন জার্মানির দ্বৈচেস টিপটেনজাদুঘরে[১০] ফ্রান্সের মুসে দেস আর্টস ডেকোরাটিফস (প্যারিস) এবং মিউসে দ্যু প্যাপিয়ার পেইন্টে [৩] যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্টে;[১১] স্মিথসোনিয়ানের কপার হিউইটে,[১২] ঐতিহাসিক নিউ ইংল্যান্ডে,[১৩] মেট্রোপলিস মিউজিয়াম আর্টে,[১৪] যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পার্ক সার্ভিসে,[১৫][১৬] এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইন্টারহুরে[১৭] তা রাখা আছে। উইলিয়াম মরিস এবং ওয়াল্টার গ্রিনব্যাংক দ্বারা পরিচালিত বেশকিছু ইংরেজ ওয়ালপেপার কোম্পানী সাধারণ নকশা তৈরী করে।
নেপোলীয় যুদ্ধের সময়, ইউরোপ এবং ব্রিটেন জুড়ে ওয়ালপেপারের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। যাইহোক, যুদ্ধের পর এই ওয়ালপেপারের চাহিদা বেড়ে যায়। ১৮১৩ সাল থেকে বাষ্পীয় প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে ওয়ালপেপার প্রকাশের চল শুরু হয়; দামে সস্তা হওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণিও এটি লাগানো শুরু করে। ওয়ালপেপার ১৯ শতকে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কারণ এটা একদিকে সস্তা এবং বিশেষ করে অন্ধকার রুমগুলোতে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য তৈরী করে। এটি যফিও সাধারণ মধ্যবিত্ত বাসা বাড়িতে অনেক ব্যবহার হয়; তবে সরকারী বিল্ডিংগুলোতে ততটা ব্যবহৃত হয় না। পরের অর্ধশতকে লিঙ্ক্রাস্টা এবং এনাগ্লিপটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে যায়। যদিও এগুলো দামী তবে তা পুনঃরঙিন এবং বারবার ধৌত করা যায়।
ওয়ালপেপার ম্যানুফেকচারিং ফার্ম ১৯ শতকে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়ঃ-জেফরি &কো; স্যান্ড কিড লিমিটেড[৩] লাইটবৌন, এসপিনাল & কো.;[৩] জন লাইন & সনস;[৩] পটার এন্ড কর্পোরেশন;[১৮] আর্থার স্যান্ডারসন &সনস; টাউনসেন্ড & পার্কার উল্লেখযোগ্য।[১৯] নকশাকারী অউয়েন জোনস, উইলিয়াম মরিস এবং চার্লস ভয়সে ছিলেন সেইসময়ের ডিজাইনার।
২০ শতকের শুরুতে ওয়ালপেপার পাশ্চাত্য সমাজের গৃহগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায়।[২০][২১] ওয়ালপেপার ১৯৩০ সাল থেকে ফ্যাশনের জায়গায় পৌছে গিয়েছিল।
২১ শতকে, ওয়ালপেপার বিভিন্ন আলোকময় ওয়ালপেপারে বিবর্তিত হয়; যেখানে আলোর উপস্থিতিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডন ভিত্তিক কোম্পানি মেয়স্টাইল এলইডি ইনকর্পোরেটেড ওয়ালপেপার উদ্ভাবন করেন।[২২] ডিজিটাল প্রিন্টিং এর ফলে, ওয়ালপেপার সংক্রান্ত ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যায়, নব নব প্রযুক্তির ব্যবহার ওয়ালপেপারের জনপ্রিয়তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।[২৩]
কিছু ওয়ালপেপারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে; তা সংগ্রহ করে রাখা আছে। যেমন জার্মানীর ডিউটসেচেস টেপ্টেনমিউজিয়াম (ক্যাসেল);[১০] দ্য মুসেদেস আর্ট ডেকোরেট (প্যারিস) এবং মুসে দে পেপার পেইন্ট (ফ্রান্স)[৩] যুক্তরাজ্যের দ্য ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট;[১১] স্মিথসোনিয়ানের কুপার হেউইট,[১২] ঐতিহাসিক নিউ ইংল্যান্ড,[১৩] মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট,[১৪] মার্কিন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস[১৫][১৬] এবং যুক্তরাষ্ট্রের উইন্টার থুর।[১৭] উইলিয়াম মরিস ও অন্যান্য কোম্পানি ওয়ালপেপার গ্রিনব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হত।
ওয়ালপেপার নানা প্রকারের হতে পারে। হস্তচালিত ব্লকউড ওয়ালপেপার, হস্তচালিত প্রিন্টেড ব্লকউড ওয়ালপেপার, মেশিন প্রিন্টেড ওয়ালপেপার এবং ফ্লক ওয়ালপেপার।[৩]
আধুনিক ওয়ালপেপার বৈচিত্র্যময়, এবং এটি বাস্তবে কাগজ থেকে তৈরী হয় না। মুলত ওয়ালপেপারগুলো পাশ্চাত্যে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় রোল হিসেবে বিক্রি হয়। আমেরিকান রোল করা ওয়ালপেপার দৈর্ঘ্যে ২৭ ইঞ্চি (৬৯ সেমি) বাই ২৭ ফুট (৮.২ মি)। ইউরোপীয় রোল করা ওয়ালপেপার ৫২ সেন্টিমিটার (২০ ইঞ্চি) প্রস্থ বাই ১০ মিটার (৩৩ ফু) দৈর্ঘ্যে[২৪] যা প্রায় ৫.২ বর্গমিটার (৫৬ ফু২)। বেশিরভাগ ওয়ালপেপার বর্ডারই দৈর্ঘ্যের আকার হিসেবে হিসাবে বিক্রি হয়।
কাপড় দ্বারা আছাদিত ওয়ালপেপারের উপরের স্তরে থাকে ভিনাইল এবং পিছনের স্তর কাপড় দ্বারা বোনা থাকে।[২৫] এটি বর্তমানে অনেক প্রচলিত এবং টেকসই। পাতলা ভিনাইলকে ঝুলানো অপেক্ষাকৃত সহজ। কাগজ আচ্ছাদিত ভিনাইলের অনেক মুল্য হয় এবং তা ঝুলানোও কষ্টসাধ্য। ফয়েল ওয়ালপেপারের পিছনের অংশে কাগজ থাকে। টেক্সটাইল ওয়ালপেপারে সিল্ক, শণজাত কাপড়, ঘাসীয় কাপড়, বেত এবং পাতার ন্যায় কিছু উপাদান থাকে। কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক ওয়ালপেপার আছে; যা শব্দ শোষণ করে। কাস্টোমাইজ ওয়াল প্রচ্ছদ অনেক উচ্চমুল্যে পাওয়া যায়।
কাপড় দ্বারা আচ্ছাদিত ভাইনাল,বাণিজ্যিকভাবে বর্তমানে অনেক বেশি প্রচলিত [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] যা কারখানা থেকে কোনোধরনের কর্তন ব্যতীত আনা হয়। এটি প্রায় ৫৪ ইঞ্চি (১৪০ সেমি) হয়।
ওয়ালপেপারে নানাবিধ সীমানা থাকে, এটি সাধারণত অনুভুমিকভাবে রাখা হয়। সীমানাবিশিষ্ট ওয়ালপেপার নানা বিন্যাসের ও প্রস্থের হয়।
অ-বোনা ওয়ালপেপার: এখানে পিছনের অংশে বিভিন্ন ধরনের উপাদান (রাসায়নিক সজ্জ্বা এবং টেক্সটাইল তন্তু) থাকে। এই ওয়ালপেপার যখন দেয়ালে ঝুলানো হয়, তখন এর পেস্ট সরাসরি দেয়ালে স্প্রে করা হয়।[২৬]
কাগুজে ওয়ালপেপার: পুনঃশোধিত পেপার। এটি অন্যান্য ওয়ালপেপারের পিছনের অংশে ব্যবহৃত হয়।
ছবি এবং ধাতব ওয়ালপেপার: এইজাতীয় ওয়ালপেপারের পিছনের অংশে কাগজ থাকে। ছবিকে কাগজে প্রিন্ট করা হয়। এলুমিনিয়ামের ন্যায় ধাতুকে ধাতব ফয়েল দ্বারা আবরণ দেওয়া হয়।[২৭]
নতুন ডিজিটাল ইঙ্কজেট প্রিন্টিং টেকনোলজি আল্ট্রাভায়োলেট (UV) কালি ব্যবহার করে কাস্টম বা প্রথাগত ওয়ালপেপার তৈরী করা হয়। আলোকচিত্রীর ছবি বা ডিজিটাল আর্ট এই ওয়ালপেপার এর ছবিতে ব্যবহার করা হয়।
২১ শতকের প্রথমদিক থেকে নব ধারার ওয়ালপেপার বাজারে প্রবেশ শুরু করেছে। এই ধরনের ওয়ালপেপার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য মোবাইল ফোন এবং ওয়াইফাই সিগন্যালকে আটকে দেয়। এই ধরনের ওয়ালপেপার সিলভার কালি দ্বারা আবৃত থাকে; যা মুলত ক্রিস্টাল গঠন করে; এরফলে সিগন্যাল বাইরে যাওয়াকে তা রোধ করে।[২৮]
থিংক বিগ নামক স্প্যানীয় ফার্ম ঘোষণা দিয়েছে যে; তারা এমন একটি ওয়ালপেপার তৈরী করতে চলেছে; যা কম্পিউটার ইন্টারফেস হিসেবে কাজ করবে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত; থিংক বিগ ফ্যাক্টরীর মতে এর হার্ডওয়ারের কাজ সম্পুর্ণভাবে সমাপ্ত হয়েছে তবে সফটওয়্যারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০ শতাংশ।[২৮]
২০১২ সালে কার্লশুরে ইন্সটিউট অব টেকনোলজির সলিড কনস্ট্রাকশনের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা এমন এক ওয়ালপেপার তৈরী করছে; যা ম্যাসনারী দেয়ালকে ভুমিকম্পের ফলে ধ্বসে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে। এই ওয়ালপেপারে গ্লাস ফাইবার বিভিন্ন দিক থেকে ব্যবহৃত হয় এবং এক প্রকার আঠালো দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয় যা ইটের তৈরী বাসভবনকে সুরক্ষা দেয়।[২৯]
স্যাং কিং ওয়াহ হংকং এর প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী,[৩০] সৃষ্টি করেছে বৃহত্তর স্কেলীয় ওয়ালপেপার; যা উইলিয়াম মরিসের ফ্লোরাল নকশারই একটি রুপ; যা দেয়াল শিল্প হিসেবে পরিচিত।[৩১]
চিত্রাঙ্কনের মতই, ওয়ালপেপার স্থাপনে পর্যাপ্ত জায়গার প্রয়োজন। উপরন্তু ওয়ালপেপার সবজায়গার জন্য উপযুক্ত নয়। উদাহরণস্বরুপ, বাথরুমের কথা বলা যাক। বাথরুমে ওয়ালপেপার খুব দ্রুতই অধিক সিক্ততার জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সাথে প্রয়োজন শুষ্ক দেয়ালের ত্রুটিপূর্ণ স্থানে ওয়ালপেপার লাগাতে হয়। ঘরের পর্যাপ্ত মাপ (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা) এবং জানালার সংখ্যা এবং দরজার অবস্থান হিসাব করে ওয়াল পেপার ক্রয় করা উচিত।[৩২]
ওয়ালপেপার লাগানোর পুর্বে পেস্ট করা হয় দেওয়ালে। এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা হয়, যাতে করে আঠা সক্রিয় হয়; যাকে বলা হয় বুকিং ওয়ালপেপার।[৩৩]
অভ্যন্তরণী ঘর ও সিলিংয়ে ওয়ালপেপার লাগানো হয়। এটাই প্রচলিত। তবে এর পাশাপাশি জানালার পর্দা, বইয়ের তাক, হ্যান্ডবক্স, ব্যান্ডবক্সের কাভার হিসেবেও ওয়ালপেপার লাগানো হয়।[৩৪]
বেশিরভাগ ওয়ালপেপার বেশিরভাগ ওয়ালপেপার স্টার্চ অথবা মিথিলিসেলুলোজ ভিত্তিক হয়।
ওয়ালপেপার অপসারণের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, পানি দিয়ে ব্রাশ করা। কাগজে পানি শোষিত হয়ে যায় এবং তা গ্লুকে আলগা করে দেয়। যার ফলে পেপারটি আলাদা হয়ে যায়।
তবে এই পদ্ধতি অ-অপসারীয় প্লাস্টিকের (non-peelable vinyls) ক্ষেত্রে কাজ করবে না। যেহেতু এই বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক রন্ধ্রীয় নয়, তাই এটিতে পানি শোষিত হয় না।
৩:১ অনুপাত বা ১:১ অনুপাতে পানি ও হোয়াইট ভিনেগার এর মিশ্রণ আঠাকে দ্রবীভুত করতে সাহায্য করে। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ওয়ালপেপার পরিষ্কারকারী যে রাসায়নিক উপাদান; তা রঙ ও বাসস্থানের দ্রব্য বিক্রিকারী দোকান থেকে ক্রয় করা যায়। এটি গরম পানির সাথে অথবা গরম পানি ও ভিনেগার সহযোগে মিশ্রিত করে দেয়ালের পৃষ্ঠতলে স্প্রে করতে হয়। অন্যান্য অনেক কিছুই ওয়ালপেপার পরিষ্কারকরণে আলাদা আলাদা সংযুক্ত করা যায়। পারফোরেশন এর মিশ্রণ ওয়ালপেপারকে দূর করতে সাহায্য করে। একবার মিশ্রণকে ওয়ালপেপারে ভালোভাবে স্প্রে করার পর সহজে ছুরি দিয়ে একে অপসারণ করা যায়।
আরো একটি পদ্ধতি ওয়ালপেপার অপসারণে ব্যবহার করা যায়; আর তা হলো বাষ্পের ব্যবহার
ওয়ালপেপার বাষ্পীয়করণ পানি, তড়িৎ তাপীয় উপাদান এর আধার। এই বাষ্প ওয়ালপেপারের পেস্টকে দ্রবীভুত করে, যার ফলে ওয়ালপেপার দেয়াল থেকে অপসারিত হয়ে যায়। যাইহোক, শুষ্ক দেয়ালের পৃষ্ঠতল যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, এজন্য সতর্ক থাকা জরুরী। কখনো কখনো এই বাষ্প দেওয়ালকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। যা পুনঃমেরামত করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য);