হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
শ্রী কল্কি পুরাণ (সংস্কৃত: कल्कि पुराण) হলো সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি ভবিষ্যৎবাণী ভিত্তিক ধর্মগ্রন্থ যেখানে বিষ্ণুর দশম ও শেষ অবতার কল্কির জীবনের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সৌতি দ্বারা উন্মোচিত এই কাহিনী কলি যুগ এর শেষের দিকে ভিত্তি করে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিদ্যমান ধর্মগ্রন্থটি তিনটি অংশে বিভক্ত যেগুলো যথাক্রমে ৭, ৭ ও ২১টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত।[১] এটিকে উপপুরাণ বা 'গৌণ পুরাণ' হিসেবে ধরা হলেও এর অনুচ্ছেদগুলো ১৮টি মুখ্য পুরাণ, যেমন বেদব্যাস কর্তৃক বর্ণিত বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। কল্কি পুরাণের তারিখ নবম শতাব্দী বা এর পরে নির্ধারিত হয়েছে।[২][৩]
ভবিষ্যৎবাণীর বই হিসেবে, কল্কি পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার কথা লিখিত রয়েছে যেগুলো ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে বলে হিন্দু ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করে। এই পুস্তকটি বিভিন্ন পুরাণের একই বিষয় সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোর সংগ্রহের ফলাফল। কল্কি পুরাণ প্রাথমিকভাবে কলি যুগের সময় জগতে অধর্ম ও পাপ বৃদ্ধি এবং কলি যুগের বিনাশকারী ও সত্য যুগের আরম্ভকারী কল্কির জীবন বর্ণনা করে।
এই ধর্মগ্রন্থটি হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণবধর্মের ঐতিহ্যের অংশ যেখানে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারা কলি যুগের অধর্ম থেকে সুরক্ষার জন্য বিষ্ণুর কাছে যায়।[৪] দেবতাদের নিকট থেকে নির্যাতনের বিবরণ শোনার পর শম্ভল গ্রামে বিষ্ণু সুমতি ও বিষ্ণুযশার পরিবারে কল্কি নামে জন্মানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।[৪] তিনি বেদ ও অন্যান্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন তারপর সিংহল সাম্রাজ্যের রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করেন। কল্কি ও তার বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে লড়াই করে এবং ধর্মকে নিপীড়ন ও ভূমি থেকে বিতাড়িতকারীদের ধ্বংস করে। অধর্ম বিনাশ ও ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর কল্কি সম্ভলে ফিরে যায়। এরপর কলিযুগের সমাপ্তি হয় এবং সত্যযুগের শুরু হয়। কল্কি পুরাণ মতে এরপর কল্কি স্বর্গে ফিরে যায়।[৪] এরপর শুরু হয় নতুন যুগ। পুরাণে লেখা রয়েছে পরবর্তী যুগটি হবে আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ের যুগ।[৪]
কল্কির উল্লেখ বৌদ্ধ ধর্মের বইগুলোতেও, যেমন কালচক্র তন্ত্রে পাওয়া যায়।[৫][৬] বৌদ্ধদের পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে শম্ভলের কল্কি নামক এক রাজা ধাম্মার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী নেতৃত্ব দেবে। তারপর অধর্মের উপর ধর্মের বিজয় অর্জন সহ ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জনের পরে কল্কি নতুন যুগের সূচনা করবে।[৭][৮][৯] পরবর্তী যুগ বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থ বিমলাপ্রভায় কালচক্র তন্ত্র ও কল্কির উল্লেখ পাওয়া যায়।[১০]
কল্কি পুরাণের শুরুতে কলির বংশের বর্ণনা রয়েছে তার প্রপিতামহ ব্রহ্মা থেকে শুরু করে যা তাঁর সন্তানদের জন্মের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে দুধের সমুদ্র মন্থনের বিষ থেকে জন্ম নেওয়ার পরিবর্তে, তিনি ব্রহ্মার পিঠ থেকে জন্ম নেওয়া অজাচারী দানবদের দীর্ঘ সারির সন্তান। কলি হলো ব্রহ্মার প্রপৌত্র। তিনি ক্রোধ এবং তার বোন থেকে পরিণত হওয়া স্ত্রী হিংসার পুত্র। তিনি দম্ভ ও তার বোন মায়ার পৌত্র। তিনি অধর্ম এবং তার স্ত্রী মিথ্যার প্রপৌত্র। অধর্ম মূলত ব্রহ্মার পিঠ থেকে একটি মলিনপাতক (খুব অন্ধকার এবং মারাত্মক পাপী বস্তু) হিসাবে উৎপন্ন হয়েছিল। কলি এবং তার পরিবারকে ব্রহ্মা তৈরি করেছিলেন প্রলয় সময় শেষ হওয়ার পরে মহাজগৎকে দ্রবীভূত করার জন্য। যখন তার পরিবার পৃথিবীতে মানব রূপ ধারণ করে, তখন তারা দ্বাপর যুগের সমাপ্তি এবং কলিযুগের সূচনা কালে মানবজাতির হৃদয় ও মনকে আরও কলঙ্কিত করে। [১১]
কালানুক্রমিকভাবে কৃষ্ণকে ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলা হয়। পুরাণ অনুযায়ী কলি যুগের সূচনালগ্নে দ্বাপর যুগে বর্ণ ব্যবস্থার অবনতি ঘটবে। এরপর শীঘ্রই কলি যুগের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায় শুরু হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের সময় মানুষ ঈশ্বরের নাম ভুলে যাবে এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে আর যজ্ঞ করবেনা। চতুর্থ পর্যায়ে স্বজাতি ভক্ষণ প্রথা সারা বিশ্বে মানুষদের মধ্যে প্রচলিত হবে। এই সমস্যার সমাধান করতে দেবতারা ব্রহ্মার কাছে সমাধানের জন্য একত্রিত হবে। এই যুগের শেষে দেবতারা বিষ্ণুর কাছে সাহায্য পাওয়ার জন্য বৈকুণ্ঠে ভ্রমণ করবে। তারপর কলি যুগ শেষ করার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুর পৃথিবীতে পুনর্জন্ম হবে।
শ্রী কল্কি হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরিভ্রমণকারী ভগবান বিষ্ণুর অবতার। তিনি তাঁর চিরন্তন সহধর্মিণী লক্ষ্মীর অবতার পদ্মাবতীকে বিয়ে করবেন। কল্কি রাজা শশীধ্বজ (কল্কি পুরাণ মতে সত্রাজিতের পুনর্জন্ম) এর কন্যা রমাকে বিবাহ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তারপর তার কলি যুগ শেষ করার উদ্দেশ্যের জন্য কাজ শুরু করবেন এবং পৃথিবী থেকে সব অসৎ রাজা, অশুভ ব্যক্তিদের বিনাশ করবেন তারপর সত্য যুগের সূচনা করবেন। ভবিষ্যৎবাণীতে প্রলয় বা কলি যুগ সমাপ্তির উল্লেখ রয়েছে।
ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম কল্কি অবতারের আচার্যের গুরু (শিক্ষক) হবেন বলে পুরাণে ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। এই পুস্তকে পরশুরাম কল্কিকে বেদ শিক্ষা দেন যাতে কল্কি অধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগে নৈতিকতা ও ধর্মের শিক্ষা পায়। এর সাথে পরশুরাম তাকে ধনুর্বেদ শেখান যাতে কল্কি যুদ্ধের সময় সঠিক কৌশলে অশুভদের মোকাবেলা করতে পারে।
ভগবান বিষ্ণুর কল্কি রূপে পৃথিবীর আগমনের অন্যতম প্রধান কারন হলো অশুভ শক্তিকে পরাজিত ও ধ্বংস করা। এই সময় সূর্যবংশীয় মরু, চন্দ্রবংশীয় মহারাজ শান্তনুর ভাই দেবাপি, বিভিন্ন মুনি-ঋষি যেমন বামদেব, অত্রি, বশিষ্ঠ, গালব, ভৃগু, পরাশর, নারদ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, ত্রিত, দুর্বাসা, দেবল, কণ্ব—প্রভৃতি কল্কির সাথে দেখা করেন। তিনি তার যুদ্ধ শুরু করেন কীকটপুরে শূন্যবাদীদের বিরুদ্ধে যারা মানুষদের বিপথে এনেছে। পরবর্তীতে একটি যুদ্ধ কলি ও দেবতাদের মধ্যে সংঘটিত হয়। কলির সেনাপতি কোক-বিকোক কল্কির হাতে নিহত হবে। তারপর কলি অশুভের বিপরীত মূর্তিমান সত্যযুগ ও ধর্মের হাতে পরাজিত হবে। [১২]
পৃথিবীতে অধর্মের পরাজয়ের পর সত্যযুগের সূচনা হবে। কল্কি এক সোনালী যুগ নিয়ে আসবে। কল্কি সাম্রাজ্যকে তার দুই সেনাপতির মাঝে ভাগ করে দিবে। তার অভিভাবক সুমতি ও বিষ্ণুযশ তারপর তীর্থস্থান বদ্রিকাশ্রমে গমন করবে এবং সেখানে তারা বসবাস করবে। তাদের কোন মৃত্যু নেই। তারা কল্কির সাথে বৈকুণ্ঠে প্রত্যাবর্তন করবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর কল্কি বিশ্ব শাসন করবে।
Emil Abegg based on the reference to struggles between Visnuism and Buddhism, suggests that parts of the Kalki-Purana might date back to the 9th century
Then in all probability the Kalki-Purana may have been composed during the ninth and tenth century A.D