কৃত্রিম তন্তু (ব্রিটিশ ইংরেজি তে Synthetic fiber বা synthetic fibre; বানানের পার্থক্য দেখুন) হল রাসায়নিক সংশ্লেষ এর মাধ্যমে মানুষের দ্বারা তৈরি ফাইবার বা তন্তু। এটি সরাসরি কোনও জীবন্ত জৈবদেহ থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক আঁশ নয়। এগুলি হল প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত প্রাণীজ তন্তু এবং উদ্ভিদ তন্তু উন্নত করার জন্য বিজ্ঞানীগণের ব্যাপক গবেষণার ফলাফল। সাধারণভাবে তন্তু গঠনকারী উপাদান থেকে কাটিন-অঙ্গ এর মাধ্যমে বহিষ্করণ করে এই তন্তু তৈরি করা হয়। এগুলিকে সিনথেটিক বা কৃত্রিম তন্তু বলা হয়। সিন্থেটিক তন্তু পলিমারাইজেশন নামে পরিচিত এক রকমের প্রক্রিয়া দ্বারা তৈরি করা হয় যার মধ্যে মনোমারের সাথে একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলা বা পলিমার জড়িত থাকে। পলিমার শব্দটি গ্রীক উপসর্গ "বহু" (poly) থেকে এসেছে যার অর্থ "অনেকগুলি" এবং অনুসর্গ "মার" (mer) এর অর্থ "একটি একক"। (দ্রষ্টব্য: পলিমারের প্রতিটি একককে মনোমোর বলা হয়)। দুই ধরনের পলিমারাইজেশন রয়েছে: লিনিয়ার পলিমারাইজেশন এবং ক্রস লিঙ্কযুক্ত পলিমারাইজেশন।
প্রথম সম্পূর্ণ কৃত্রিম তন্তু ছিল কাচ। [১] জোসেফ সোয়ান ১৮৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে প্রথম কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কার করেছিলেন; [২] আজ এটিকে যথাযথ ব্যবহারে আধা কৃত্রিম বলা হবে। তাঁর এই তন্তু সেলুলোজ তরল থেকে তৈরি হয়েছিল যা গাছের ছাল এ থাকা তন্তুকে রাসায়নিকভাবে সংশোধন করে গঠণ করা হয়েছিল। এই কাজের আগেই সোয়ান তাঁর উদ্ভাবিত কার্বন ফিলামেন্টকে তাঁর তৈরী ইনক্যান্ডিসেন্ট আলোর বাল্ব এ ব্যবহারের জন্য একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে ছিলেন। সোয়ান উৎপাদিত কৃত্রিম তন্তুর ঐ প্রক্রিয়ার সাথে সম্ভাব্য প্রয়োগগুলিতে রাসায়নিকভাবে তাঁর আলোক সংক্রান্ত কাজটি একই রকমের ছিল। সোয়ান শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিলেন এই তন্তুুর সম্ভাবনা বস্ত্র উৎপাদন এ বিপ্লব আনতে চলেছে। ১৮৮৫ সালে তিনি লন্ডন এর আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী প্রদর্শনী তে তাঁর কৃত্রিম উপাদান থেকে তৈরি কাপড়ের মোড়কের উন্মোচন করেছিলেন। [৩]
পরবর্তী পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন একজন ফরাসি প্রকৌশলী এবং শিল্পপতি হিলার ডি চারডোনেট। তিনি প্রথম কৃত্রিম সিল্ক আবিষ্কার করেছিলেন যাকে তিনি "চারডোনেট সিল্ক" বলে উল্লেখ করে ছিলেন। ১৮৭০ এর দশকের শেষের দিকে চারডনেট ফরাসিদের রেশমকীট ধ্বংসকারী মহামারী প্রতিকারের জন্য লুই পাস্তুর এর সাথে কাজ করছিলেন। ডার্করুমে ছড়িয়ে পড়েছে বলে পরিষ্কার করতে ব্যর্থতার ফলে চারডোনেট নাইট্রোসেলুলোজ কে প্রকৃত সিল্কের সম্ভাব্য পরিবর্ত হিসাবে আবিষ্কার করে ফেলেন। এই জাতীয় আবিষ্কারের মূল্য উপলব্ধি করে চারডোনেট তাঁর নতুন পণ্যটি বিকাশ করতে শুরু করেন [৪] যা তিনি ১৮৮৯ সালের প্যারিস প্রদর্শনী তে প্রদর্শণ করেন। [৫] চারডোনেটের উপাদানটি অত্যন্ত দাহ্য ছিল। এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য আরও স্থিতিশীল উপাদান তার পরিবর্ত হিসাবে উঠে এসেছিল।
১৮৯৪ সালে প্রথম সফল প্রক্রিয়াকরণের কাজটির উদ্ভাবন করেছিলেন ইংরেজ রসায়নবিদ চার্লস ফ্রেডেরিক ক্রস এবং তাঁর সহযোগী ছিলেন এডওয়ার্ড জন বেভান এবং ক্লেটন বিডল। তাঁরা ফাইবারটির নাম রেখেছিলেন "ভিসকোস (সান্দ্র)"। কারণ কার্বন ডিসালফাইড এবং সেলুলোজ এর মৌলিক অবস্থার মধ্যে জ্যান্থেট এর একটি উচ্চ সান্দ্র দ্রবণ পাওয়া যেত। [৬] প্রথম বাণিজ্যিক ভিসকোজ রেয়ন ১৯০৫ সালে যুক্তরাজ্য সংস্থা কোর্টাল্ডস দ্বারা উৎপাদিত হয়েছিল। "ভিসকোস" রেডিও এবং সেলোফেন উভয় পণ্যকে তৈরি করতে ব্যবহৃত সান্দ্র জৈব তরলের জন্য "রেয়ন" নামটি ১৯২৪ সালে গৃহীত হয়েছিল ও ব্যবহৃত হয়েছিল। সেলুলোজ অ্যাসেটেট নামে পরিচিত আর একটি একই ধরনের পণ্য ১৮৬৫ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। রেয়ন এবং অ্যাসিটেট উভয়েই কৃত্রিম তন্তু হলেও পুরোটাই সিন্থেটিক ছিল না। এগুলি কাঠ থেকে তৈরি হত।[৭]
নাইলন শব্দটি "সম্পূর্ণ কৃত্রিম" অর্থে ছিল প্রথম কৃত্রিম তন্তু। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৯৩০ এর দশকে রাসায়নিক সংস্থা ডুপন্ট -এর আমেরিকান গবেষক ওয়ালস ক্যারোদার্স এটি উদ্ভাবন করেন। শীঘ্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর সময় যখন রেশন প্রবর্তিত হয় তখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এ রেশম এর পরিবর্তে এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল। মহিলাদের মোজার উপকরণ হিসাবে এর অভিনব ব্যবহার আরও অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন প্যারাসুট এর রেশমের পরিবর্ত এবং অন্যান্য সামরিক ব্যবহারের জন্য দড়ি তে ব্যবহারকে আড়াল করে দেয়।
১৯২৮ সালে ব্রিটেনে পলিয়েস্টার তন্তুর প্রথম পেটেন্ট করেছিল ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি।[৮] ১৯৪১ সালে ক্যালিকো প্রিন্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এর পক্ষে জন রেক্স হুইনফিল্ড এবং জেমস টেন্যান্ট ডিকসন নামের দুই ব্রিটিশ রসায়নবিদও এটির উৎপাদন শুরু করেন।[৯][১০] তাঁরা প্রথম পলিয়েস্টার তন্তুর উৎপান ও পেটেন্ট করেছিলেন যার নাম তাঁরা দেন টেরিলিন এবং এটি আবার ড্যাক্রন নামেও পরিচিত ছিল। নাইলন এর দৃড়তা এবং স্থিতিস্থাপকতার সাথে এটি সমান অথবা আরও উতকৃষ্ট ছিল।[১১] ওদিকে আইসিআই এবং ডুপন্টও তাদের তন্তুর নিজস্ব সংস্করণের উৎপাদন চালু রাখে।
২০১৪ সালে কৃত্রিম তন্তুর উৎপাদন ছিল ৫৫.২ মিলিয়ন টন।[১২]