নারীবাদ |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
![]() |
নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গ একটি বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় নারীবাদী কর্মকাণ্ড এবং আলোচনা নিয়ে পরিবেষ্টিত। যদিও তৃতীয় তরঙ্গের সঠিক সীমানা কী সেটি একটি বিতর্কের বিষয়, তবু সাধারণত নব্বই এর দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালকেই তৃতীয় তরঙ্গের ব্যাপ্তিকাল হিসেবে ধরা হয়। একে একটি ইন্ডিভিজুয়াল মুভমেন্ট বা "একক আন্দোলন" বলা হয়, কারণ নারীবাদীকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করাও এর আওতায় পড়ে।
তৃতীয় তরঙ্গের উত্থানের আংশিক কারণ হল দ্বিতীয় তরঙ্গের ব্যর্থতা, এবং ষাট, সত্তর ও আশির দশকে তৈরি হওয়া আন্দোলন ও কর্মপ্রচেষ্টাগুলোর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। তৃতীয় তরঙ্গে নারীবাদকে বিস্তৃত করে আরও অনেক পরিচয়কে এর আওতাভুক্ত করা হয়[১][২] এবং আরও অনেক বর্ণ, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকে এখানে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এভাবে একে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রতিক্রিয়া ও অবিচ্ছিন্নতা হিসেবে দেখা যায়। এতে দ্বিতীয় তরঙ্গের কনস্ট্রাক্ট বা অবকাঠামোর একটি আংশিক অস্থিতিশীলতাও বিদ্যমান। তৃতীয় তরঙ্গ শুরুর কয়েক বছর পূর্বে, ১৯৮৯ সালে একটি সম্পর্কযুক্ত ধারণা ইন্টারসেকশনালিটির জন্ম হয়। কিন্তু এই তৃতীয় তরঙ্গেই এই ধারণাটিকে গ্রহণ করা হয়।
রেবেকা ওয়াকার কুইয়ার (এলজিবিটি) এবং অশ্বেতাঙ্গ নারীদের উপর অধিক দৃষ্টি দেবার জন্য প্রথম "তৃতীয় তরঙ্গ" শব্দটিকে ব্যবহার করেন।
১৯৯২ সালে তিনি এনিটা হিল কেসের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। যেসব পুরুষ নারীদের উপর যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতন করে, এবং এরকম অবিচার করেও তাদের প্রিভিলেজ বা সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করে তারা বিচারের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়, সেইসব পুরুষের দ্বারা নারীদেরকে চুপ করিয়ে রাখার যে ঘটনাগুলো তার চোখে পড়ে, তার বিরুদ্ধে রেবেকা ওয়াকার কলম ধরেছিলেন, এবং বলেছিলেন, "আমি উত্তর-নারীবাদ নারীবাদী নই। আমি হলাম তৃতীয় তরঙ্গ"।[৩] ওয়াকার যে তৃতীয় তরঙ্গের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা কেবল একটি প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং ছিল একটি আন্দোলন। কেননা নারীদের সমস্যাগুলোর সমাপ্তি ছিল অনেক দূরবর্তী। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীগণ তাদের লক্ষ্যকে বিস্তৃত করেন। তারা কুইয়ার তত্ত্বের উপর দৃষ্টি স্থাপন করেন, দৃষ্টি স্থাপন করেন জেন্ডার রোল বা লৈঙ্গিক ভূমিকা নিয়ে প্রত্যাশা ও স্টেরিওটাইপগুলোর উপর।[৪] পর্নোগ্রাফি, যৌনপেশা এবং পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের যেরকম একটি স্থির নির্ধারিত অবস্থান দেখা গিয়েছিল,[৫] তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের বেলায় তেমনটি দেখা যায় না। এসব বিষয় নিয়ে তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের অবস্থান অনির্ধারিত, এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে তারা বিভক্ত (নারীবাদী যৌনতা বিতর্ক বা ফেমিনিস্ট সেক্স ওয়ারস)।[৬] কেউ কেউ যেখানে এই যৌনতা সম্পর্কিত কার্যসমূহকে নারীদের অধঃপতন ও নির্যাতনের কারণ হিসাবে দেখেন, সেখানে কেউ কেউ আবার এগুলোকেই নারীদের নিজস্ব যৌনতার উপর কর্তৃত্বকারী অবস্থান ও অধিকার লাভের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন হিসাবে দেখেন। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদে বিভিন্ন মতামত দেখা যায়। আর তাই এই নারীবাদ সকলের একটি একক অভিন্ন অবস্থান ও কার্যাবলি প্রতিষ্ঠার বদলে বরং সেই মতামতগুলোর ভিন্নতা, সকলের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ এবং সকলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিতাবাদকে আলিঙ্গন করে নেয়। তবে ধর্ষণ সংস্কৃতি এবং সমপারিশ্রমিক সহ বিভিন্ন বিষয়ে সকল তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের অবস্থান অভিন্ন। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ রাজনৈতিক পরিবর্তনের চাইতে ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিতাবাদী পরিচয়ের উপরে অধিক দৃষ্টিনিক্ষেপ করে।[৭]
দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ থেকে স্থানান্তর হবার সাথে সাথে নারীদের জন্য অনেক আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত ও বর্ধিত হয়। এইসব প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন ছাড়াও তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীগণ বিশ্বাস করেন, যেসব স্টেরিওটাইপ, মিডিয়া পোর্ট্রেয়াল বা গণমাধ্যম চিত্রায়ন, এবং ভাষা নারীদেরকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করে রেখেছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও আরও পরিবর্তন দরকার। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের উদ্দেশ্য হল বিচিত্র ও বিবিধ পরিচয়গুলোকে উদযাপন করা এবং দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের ক্ষেত্রে যে "শিকার নারীবাদ" বা "ভিক্টিম ফেমিনিজমের" প্রচার করা হয়েছিল তা পরিত্যাগ করা। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ জেন্ডার এবং যৌনতার পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট ব্যাখ্যাগুলোয় অধিক দৃষ্টি স্থাপন করে। জোয়ান ডব্লিউ. স্কট তার "ডিকনস্ট্রাক্টিং ইকুয়ালিটি ভারসাস ডিফারেন্স: অর, দ্য ইউজেস অব পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট থিওরি অব ফেমিনিজম" শীর্ষক রচনায় বর্ণনা করেছেন কীভাবে ভাষা এই জগৎকে বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। পোস্টস্ট্রাকচারালিস্টগণ বলেন, শব্দ এবং রচনাগুলোর কোন নির্দিষ্ট এবং স্থির অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে না, এই সব শব্দ ও রচনার সাথে এদের অর্থের কোন স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও স্বতঃসিদ্ধ বা স্বতঃপ্রমাণিত সম্পর্ক থাকে না, ভাষা এবং জগতের মাঝে কোন মৌলিক ও চূড়ান্ত সম্পর্ক থাকে না।[৮] ভাষা আমাদের চিন্তনে বিভিন্ন দ্বিপার্শ্বিকতা, বিভেদ বা বাইনারি সৃষ্টি করে (যেমন নারী ও পুরুষের মাঝে)। পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট নারীবাদীগণ এই বিভেদকে সমাজের প্রভাবশালী ও কর্তৃত্ববাদী দলের ক্ষমতাকে রক্ষার জন্য একটি কৃত্রিম কাঠামো বলে মনে করেন।[৯] "দ্য লোকাল ইজ গ্লোবাল: থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম, পিস, এন্ড সোশ্যাল জাস্টিস" গ্রন্থে রচয়িতাগণ ব্যাখ্যা করেছেন তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদে পাঁচটি প্রাথমিক শক্তি কাজ করে, যথা: (১)বক্তব্যের দায়িত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও নির্বাচন, (২) অভিজ্ঞতা এবং গতিশীল জ্ঞানের উপলব্ধি এবং এর প্রতি সম্মান, (৩) "ব্যক্তিগত ব্যাপার মাত্রই রাজনৈতিক" মতকে সমর্থন করা যা অনুসারে, অবকাঠামোগত বা স্ট্রাকচারাল সমস্যায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মূল নিহিত থাকে, এবং ব্যক্তিগত কাজের সামাজিক ফলাফল থাকে, (৪) তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উভয় এক্টিভিজমেই ব্যক্তিগত ন্যারেটিভ এর ব্যবহার, (৫) স্থানীয় রাজনৈতিক একটিভিজম বা সক্রিয়তার সাথে বৈশ্বিক যোগাযোগ এবং ফলাফল।[১০]
রায়ট গার্লকে (Riot grrrl) কেউ কেউ তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের সূচনা বলে মনে করেন। এই আন্দোলনটি হার্ডকোর পাংক রক ভিত্তিক ছিল যেখানে ধর্ষণ, পুরুষতন্ত্র, যৌনতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অন্যান্য নারী ও নারীবাদ বিষয়ে কথা বলা হয়। তারা এনিটা হিল এবং ক্ল্যারেন্স থমাস এর কেস নিয়েও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীগণ যেমন এলি গ্রীন প্রায়ই "মাইক্রো-পলিটিক্স"-এ মনোযোগ দেন, এবং নারীদের জন্য কোন জিনিসগুলো খারাপ, কোন জিনিসগুলো ভাল এগুলো নিয়ে দ্বিতীয় তরঙ্গের জগৎকে চ্যালেঞ্জ করেন।[১১][১২][১৩][১৪]
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের প্রস্তাবনাগুলোতে বলে হয়, এই নারীবাদে নারীদেরকে নিজেদের মত নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করার স্বাধীনতা দেয়া হয়, যেখানে তারা তাদের নারীবাদের উপর তৈরি বিশ্বাসব্যবস্থায় নিজের পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। মেনিফেস্টা নামক রচনায় তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের ধারণার ভূমিকায় লেখক জেনিফার বমগার্ডনার এবং এমি রিচার্ডস বলেন, নারীবাদ প্রতিটি প্রজন্ম এবং ব্যক্তির সাথে পরিবর্তিত হতে পারে:
কিছু তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদী নিজেদেরকে নারীবাদী বলতে চান না, কারণ তাতে নারীবাদী শব্দটি জেন্ডারের তরল ধারণায় বা ফ্লুইড নশনের ক্ষেত্রে (এর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গও অন্তর্ভুক্ত) এবং সকল জেন্ডার রোল বা লৈঙ্গিক ভূমিকায় সাম্ভাব্য নির্যাতনের ব্যাপারে অসংবেদনশীল - এই ভুল ব্যাখ্যা জন্মাতে পারে, অথবা সমালোচকগণ শব্দটিকে একচেটিয়া এবং অভিজাত বলে দাবী করতে পারেন।[১৫] অন্যেরা নিজেদেরকে নারীবাদী বলতে চান এবং এই ধারণাগুলোকে শব্দটিতে যুক্ত করে শব্দটিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে চান। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ নারীত্বের যেকোন বিশ্বজনীন সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। টু বি রিয়াল: টেলিং দ্য ট্রুথ এন্ড চেঞ্জিং দ্য ফেস অব ফেমিনিজম নামক রচনায় তৃতীয় তরঙ্গের জনক এবং নেতা রেবেকা ওয়াকার লেখেন:
আগের মত নারীবাদকে যেভাবে দেখা হত নারীবাদ আর সেরকম গণ্ডি যেমন- NOW (ন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর উইমেন), Ms.(ম্যাগাজিন), উইমেন স্টাডিজ, এবং লাল স্যুট পরিহিতা কংগ্রেসউইমেনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নারীবাদ যে বীজ রোপন করেছিল তরুণী নারীগণ সম্ভবত তার ফসল ফলিয়ে কেটে ফেলেছে। "Title IX" এবং "উইলিয়াম ওয়াটস এ ডল" এর পর কলেজ বা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অথবা দুই বছরের বিবাহিতা অথবা প্রথম চাকুরি করা তরুণীরা বিগত দশ বা বিশ বছরের নারীবাদ থেকে অর্জিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করছে। সত্তরের দশকের নারীবাদীরা যেভাবে কাজ করত আমরা সেভাবে কাজ করছি না। স্বাধীন হওয়া মানে এই নয় যে পূর্বে মেনে আসা নিয়মগুলোকে মেনে চলতে হবে, বরং এর মানে হল কারও নিজের জন্য নতুন পথ খুঁজে বের করা; একটি পথ যা তার নিজের প্রজন্মের ক্ষেত্রে যথার্থ।[১৬]
কিছু তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদী নিজেদেরকে নারীবাদী বলতে চান না, কারণ তাতে নারীবাদী শব্দটি জেন্ডারের তরল ধারণায় বা ফ্লুইড নশনের ক্ষেত্রে (এর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গও অন্তর্ভুক্ত) এবং সকল জেন্ডার রোল বা লৈঙ্গিক ভূমিকায় সাম্ভাব্য নির্যাতনের ব্যাপারে অসংবেদনশীল - এই ভুল ব্যাখ্যা জন্মাতে পারে, অথবা সমালোচকগণ শব্দটিকে একচেটিয়া এবং অভিজাত বলে দাবী করতে পারেন।[১৫] অন্যেরা নিজেদেরকে নারীবাদী বলতে চান এবং এই ধারণাগুলোকে শব্দটিতে যুক্ত করে শব্দটিকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে চান। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ নারীত্বের যেকোন বিশ্বজনীন সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। টু বি রিয়াল: টেলিং দ্য ট্রুথ এন্ড চেঞ্জিং দ্য ফেস অব ফেমিনিজম নামক রচনায় তৃতীয় তরঙ্গের জনক এবং নেতা রেবেকা ওয়াকার লেখেন:
তরুণ নারীগণ নারীবাদী লেবেলকে প্রত্যাখ্যান করুক বা নাই করুক, ক্ষমতায়িত নারীকে কিরকম দেখতে হবে, তারা কীভাবে কাজ করবে অথবা চিন্তা করবে এই ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আদর্শ নারীর ধারণায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা স্বীকৃতি দেয়। এটি যথার্থ নারীত্বেরই আরেকটি কৌশল, জীববিজ্ঞান ও বৈশিষ্ট্যের নামে আরেকটি স্ক্রিপ্টে লেখা ভূমিকা।[১৭]
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করে যেগুলো নারীদের নির্যাতন ও সীমাবদ্ধতার কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয় এবং সেই সাথে তাদের পরিচয়কেও প্রান্তীয়করণ করে। এখানে সচেতনতা তৈরি সংক্রান্ত কার্যাবলিকে বলা হয় "নারী যে সামাজিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে তার অর্থের সামষ্টিক সমালোচনামূলক পুনর্গঠন"।[১৮] জেনিফার বমগার্ডনার এবং এমি রিচার্ডস তাদের মেনিফেস্টা: ইয়ং উইমেন, ফেমিনিজম এন্ড দ্য ফিউচার রচনাটিতে লিখেছেন:
শিরা টেরান্টের মত নারীবাদী পণ্ডিতগণ "ওয়েভ কনস্ট্রাক্ট" বা এরকম তরঙ্গ অবকাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কারণ এখানে তথাকথিত ওয়েভ বা তরঙ্গগুলোর মধ্যবর্তী উন্নয়নগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়। অধিকন্তু যদি নারীবাদ বৈশ্বিক আন্দোলন হয় তাহলে শিরা টেরান্ট মনে করেন, নারীবাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় তরঙ্গগুলোর সময়কাল যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী উন্নয়নের সাথেই সবচাইতে বেশি ঘনিষ্ট। সেই সাথে এটি আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করে যেখানে নারীবাদ সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক সমস্যার ইতিহাসকে বুঝতে ব্যর্থ হয়।[১৯]
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের কার্যাবলির প্রতি আসা সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জটি হল, অনেকের দাবী অনুসারে এই "পোস্ট-ফেমিনিস্ট" বা "উত্তর-নারীবাদী" যুগে নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং এই নারীবাদের উপর থাকা জনসমর্থন কমে যাওয়া। ম্যানন টেম্বলে একে পাশ্চাত্যের "এন্টিফেমিনিস্ট আন্ডারকারেন্ট" বা "প্রতিনারীবাদী অন্তঃপ্রবাহ" নাম দিয়েছেন। এমি ফ্রিদম্যান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের "রেডিকেল ফ্যানাটিসিজম" বা "চরমপন্থী গোঁড়ামি" প্রকাশিত হয়ে গেছে।[২০] এক্ষেত্রে দাবীটি হল, লৈঙ্গিক সমতা ইতিমধ্যেই প্রথম দুই তরঙ্গের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য আরও বেশি চাপ দেয়াটা হয় অপ্রাসঙ্গিক, না হয় পুরুষের চাইতে নারীদের অধিক সুবিধা আদায়ের জন্য চাপ প্রদান এবং আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে নারীর অবস্থাকে অতিরঞ্জিত করা। এই তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের ইতিবাচক কর্মপ্রচেষ্টাসমূহ আসলেই সামাজিক লৈঙ্গিক সমতা তৈরি করছে, নাকি এটি শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত পুরুষদেরকে তাদের উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা জীববিজ্ঞানগত ইতিহাসের কারণে আসলে তাদেরকে ক্ষতি করা হচ্ছে বা শাস্তি দেয়া হচ্ছে - এটা নিয়ে চলা বিতর্কগুলোতে এই সমস্যাটি অনেক বেশি করে প্রকাশিত হচ্ছে।[২১] যাই হোক, মিজ. ম্যাগাজিন -এ প্রকাশিত রেবেকা ওয়াকারের লেখা একটি প্রবন্ধ এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সেখানে রেবেকা ওয়াকার লেখেন, "সুতরাং আমি এটা সকল নারীর হয়ে , বিশেষ করে আমার প্রজন্মের নারীদের হয়ে লিখছি: থমাসের বিজয়ী হবার ঘটনাটি থেকে পুনরায় স্মরণ করে নিন (যেমনটা আমি নিয়েছি), এই যুদ্ধ শেষ হতে এখনও অনেক দেরি। একজন নারীর এই তৃতীয় তরঙ্গের প্রত্যাখ্যানের ঘটনা দেখে আপনি বরং রাগান্বিত হন। এই রাগকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিণত করুন।"[৩]
"নারীদের মাঝে জাগ্রত সচেতনতাই এই পরিবর্তনটি নিয়ে এসেছে। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে পুরুষ আধিপত্য এই প্রজন্মের নারীদেরকে প্রভাবিত করে, আর তাদের এই সচেতনতাকেই আমরা চাই... নারীবাদের উপস্থিতিকে ধ্রুব বা সতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের প্রজন্মে এটি ফ্লুরাইডের মত। আমরা খুব কমই লক্ষ্য করি যে এটা আমাদের কাছে আছে- সরলভাবে দেখলে এটা কেবলই পানির মত একটি উপাদান।"[১৬]
এরকম অনুভূতির প্রতিক্রিয়ায়, অনেক স্বঘোষিত নারীবাদীদেরকে তাদের স্থান পরিত্যাগ করে স্বঘোষিত উত্তর-নারীবাদী বা পোস্ট-ফেমিনিস্ট হতে দেখা যায়। তারা দাবী করেন, নারীদের অর্জনের সাফল্যমণ্ডিত গল্পের বাস্তবতার সাথে আজকের নারীবাদী চিন্তার কোন সংগতি নেই।[২২] পপুলার মিডিয়া বা জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলো রেডিকেল ফেমিনিস্ট বা আমূল-সংস্কারবাদী নারীবাদের এই ভাবমূর্তিটি তৈরি করতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে।[২৩] ডোনা লাফ্রামবয়েস তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদকে সমালোচিত করার জন্য সুপরিচিত। তিনি দাবী করেন, তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ "নারীর শহীদ হবার মিথকে (দ্য মিথ অব ফিমেল মারটারডম) চিরস্থায়ী করে রেখেছে", এবং নারীবাদীগণ ইচ্ছা করে এই কল্পকাহিনীটিকে বাঁচিয়ে রাখে যাতে সেই নারীবাদটি টিকে থাকতে পারে, এবং "কারও মতামতকে অবহিত করার নারীবাদের সাথে কীভাবে একজনকে চিন্তা করতে হবে তা ঠিক করে দেয়া নারীবাদের মধ্যে" একটি পার্থক্য সৃষ্টি করে।[২৪]
দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের ব্যর্থতাগুলোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে নব্বই এর দশকের প্রথম দিকে তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের সূচনা হয়। এটি দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের আন্দোলন ও কর্মপ্রচেষ্টাগুলোর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলোকে সামনে তুলে ধরে। তবে দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদী কার্যক্রমগুলোর দ্বারা অর্জিত মৌলিক অধিকার এবং সুবিধাসমূহ তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই অর্জিত মৌলিক অধিকার ও সুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে - পারিবারিক নির্যাতনের ফলে ভূক্তভোগী নারী ও শিশুদের জন্য আবাসস্থলের ব্যবস্থা, পাবলিক লেভেলে নারীদেরকে করা অবমাননা ও ধর্ষণের স্বীকৃতি, জন্মনিরোধক এবং অন্যান্য প্রজনন সংক্রান্ত সেবার পথ করে দেয়া (যার মধ্যে গর্ভপাতের বৈধকরণও একটি), কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য সেক্সুয়াল-হ্যারাসমেন্ট পলিসি বা যৌন-হয়রানি নীতির সৃষ্টি ও প্রয়োগ, চাইল্ড-কেয়ার সারভিস, শিক্ষা এবং পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তরুণ নারীদের জন্য সমান অথবা অধিক তহবিলের ব্যবস্থা, উইমেন্স স্টাডিজ প্রোগ্রাম (নারীদের নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম) ইত্যাদি। দ্বিতীয় তরঙ্গের অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদী নেত্রীগণ যেমন গ্লোরিয়া এনজালদুয়া, বেল হুকস, কেরি এন কেন, শেরি মরাগা, অদ্রে লর্ডে, ম্যাক্সিন হং কিংস্টন, রিনা ওয়াকার এবং আরও অনেকে বর্ণ ও জাতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে নারীবাদী চিন্তাধারায় বিবেচনায় আনবার একটি জায়গা খুঁজছিলেন।[১৩][২৫]
১৯৮১ সালে শেরি মরাগা এবং গ্লোরিয়া ই. আনজালদুয়া দিস ব্রিজ কলড মাই ব্যাক নামে একটি রচনাসমগ্র প্রকাশ করেন। এই রচনাসমগ্রটি ও সেই সাথে অল দ্য উইমেন আর হোয়াইট, অল দ্য ব্ল্যাকস আর মেন, বাট সাম অব আস আর ব্রেভ: ব্ল্যাক উইমেনস স্টাডিজ (১৯৮২) নামক গ্রন্থগুলো দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদের সমালোচনা করা শুরু করে, কারণ এই দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ প্রধানত শ্বেতাঙ্গ নারীদের সমস্যা এবং রাজনৈতিক অবস্থানের উপরেই দৃষ্টিস্থাপন করেছিল।
যাইহোক, তৃতীয় তরঙ্গের মূলের সূচনা হয় আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদী নেত্রীগণ একটি নতুন বিষয়ের ডাক দেন। তারা নারীবাদী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে বর্ণ ও জাতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় আনার পথ খোঁজেন। তারা রেস এবং জেন্ডারের মধ্যবর্তী সম্পর্কে মনোযোগ দেন যা হিল-থমাস কেসে আরও বেশি প্রাধান্য পায়। পরবর্তীতে রেবেকা ওয়াকার ফ্রিডম রাইড ১৯৯২ নামে একটি থার্ড ওয়েভ ডিরেক্ট একশন করপোরেশন ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করেন, যা ছিল গরিব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের লোকদেরকে ভোটারতালিকায় রেজিস্ট্রেশন করানোর একটি কার্যক্রম। এখানে তরুণ নারীদের প্রতি মনোযোগ দেয়া হয়েছিল।[২৬]
ক্লারেন্স থমাস যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের মার্শালের আসনের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে এটর্নি এনিটা হিল ক্লারেন্স থমাসকে যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত করেন। থমাস এই অভিযোগকে অস্বীকার করেন। প্রচণ্ড বিতর্কের পর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের রায় ৫২-৪৮ ভোটে থমাসের পক্ষে যায়।[১৭][২৫][২৭]
এই কেসের প্রতিক্রিয়ায় রেবেকা ওয়াকার "বিকামিং দ্য থার্ড ওয়েভ" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যেখানে তিনি লিখেছিলেন, "আমি উত্তর-নারীবাদ নারীবাদী নই। আমি হলাম তৃতীয় তরঙ্গ।"[৩] থমাস এই অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেন। অনেকে বলেন, থমাসকে দোষমুক্ত করা উচিত কারণ তার একজন সুপ্রিম কোর্ট বিচারক হওয়াটা অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিগণের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করবে। যখন ওয়াকার তার সঙ্গীকে এ ব্যাপারে তার মতামত কী তা জিজ্ঞেস করলেন, তিনিও একই কথা বললেন। ওয়াকার জিজ্ঞাসা করেন, "কখন প্রগতিশীল কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষগণ আমার অধিকার ও কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবেন?"[৩] ওয়াকার বর্ণ বা জাতিগুলোর মধ্যে সমতা চেয়েছিলেন, কিন্তু নারীদের অপসারিত না করে। ক্লারেন্স থমাস সুপ্রিম কোর্টের বিচার পরিচালনাকারী শেষ ব্যক্তি হতে যাচ্ছেন না যিনি নাগরিক অধিকারকে হেও করছেন, তাহলে কেন এমন কাউকে আনা হচ্ছে না যিনি নারীদেরকে সম্মান দেন?
১৯৯২ সালকে "ইয়ার অব দ্য উইম্যান" বলা হয়। এই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে পূর্বে থাকা দুজন নারীর সাথে আরও চারজন যুক্ত হন। পরের বছরে আরেকজন নারী, কে বেইলি হাচিনসন একটি বিশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় এই সংখ্যাটি দাঁড়ায় সাতে। নব্বই এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নারী এটর্নি জেনারেল এবং সেক্রেটারি অব স্টেট দেখা যায়, সেই সাথে সুপ্রিম কোর্টে দ্বিতীয় নারী রুথ বেডার জিন্সবার্গকে দেখা যায়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র দেখে প্রথম ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনকে, যার একটি স্বাধীন রাজনৈতিক, আইনগত, করপোরেট এক্সেকিউটিভ, এক্টিভিস্ট এবং পাবলিক সারভিস কর্মজীবন ছিল। যাইহোক, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের সমর্থিত সম অধিকার সংশোধন ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সম্প্রতি তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীগণ তাদের আন্দোলনকে বর্ধিত করতে ইনটারনেট এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছেন। এর ফলে তাদের বার্তা এবং তথ্যগুলো বিশাল সংখ্যক শ্রোতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
"ইন্টারনেটে প্রচার করার সহজসাধ্যতার অর্থ হচ্ছে ই-জিনগুলো (ইলেক্ট্রনিক ম্যাগাজিন) সর্বব্যাপী হয়ে যাচ্ছে। অনেক আন্তরিক স্বাধীন লেখক এবং প্রতিষ্ঠান দেখেছে যে, ইন্টারনেট তথ্য আদানপ্রদান এবং রচনা ও ভিডিও প্রকাশের একটি মাধ্যম হতে পারে যা তাদের যুক্তি, দাবী ও বক্তব্যকে প্রচুর পরিমাণ শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেবে। ইন্টারনেট নারীবাদী আন্দোলনের বিষয়বস্তুগুলোকে সর্বস্তরের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার প্রক্রিয়াটিতে একটি আমূল পরিবর্তন এনেছে।"[২৮]
জেন্ডার ভায়োলেন্স বা লৈঙ্গিক অত্যাচার তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের জন্য কেন্দ্রীয় সমস্যা। জেন্ডার ভায়োলেন্স হল যেকোন ধরনের অত্যাচার যা প্রাথমিকভাবে নারীর উপর প্রযুক্ত হয়, যেমন ধর্ষণ, পারিবারিক অত্যাচার এবং যৌন হয়রানি। ভি-ডে (V-Day) এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো জেন্ডার ভায়োলেন্সকে সমাপ্ত করবার উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত হয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন শিল্প প্রকাশ যেমন দ্য ভাজাইনা মনোলগস নারীর যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি করেছে। তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ যৌনতার চিরাচরিত ভূমিকার পরিবর্তন আনতে চায় এবং যৌনতা সংক্রান্ত নারীর অনুভূতির উদ্ঘাটনকে আলিঙ্গন করে যাতে যোনি-কেন্দ্রিক বৈচিত্র্যময় বিষয়গুলো যেমন অরগাজম, জন্ম এবং ধর্ষণের বিষয়গুলো উপস্থিত।
নারীবাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্যগুলোর একটি হল সকলকে এটা দেখানো যে, গর্ভনিরোধক ব্যবহার এবং গর্ভপাত হল নারীদের প্রজননগত অধিকার। বমগার্ডনার এবং রিচার্ডসের মতে, "কোন নারীর উর্বরতাকে নিয়ন্ত্রণ করা নারীবাদের উদ্দেশ্য নয়, নারীবাদ কেবল তাদেরকেই স্বাধীন করতে চায় যারা নিজেদের উর্বরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান"।[১৬] ২০০৬ সালে সাউদ ডাকোটায় মায়ের জীবনের ঝুঁকি ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার চেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে পার্শাল বার্থ এবরশন (ইনট্যাক্ট ডিলেশন এন্ড এক্সট্র্যাকশন) এর নিষিদ্ধকরণকে সমর্থনের জন্য সাম্প্রতিক ভোটকে অনেক নারীবাদীই নারীর নাগরিক ও প্রজননগত অধিকারের প্রতি বাঁধা হিসেবে দেখেন।[২৯][৩০][৩১] যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের উপর নিষিদ্ধকরণ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১৯৭৩ সালের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে নেয়া হয়েছিল, তা সমস্ত দেশেই বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে। এধরনের নিষেধাজ্ঞায় একটি বাধ্যতামূলক অপেক্ষার সময়,[৩২] পিতামাতার সম্মতির আইন,[৩৩] এবং স্বামীর সম্মতির আইন রয়েছে।[৩৪]
ইংরেজিভাষীগণ স্পিনস্টার (spinster), বিচ (bitch), হোর (whore) এবং কান্ট (cunt) শব্দগুলোকে নারীদেরকে অপমানজনক বা মর্যাদাহানিকর সম্বোধনে ব্যবহার করেন। লেখক ইনগা মুসিও লেখেন, "আমি সত্য হিসেবে মেনে নিচ্ছি যে, আমরা একটি শব্দকে বাজেয়াপ্ত করতে স্বাধীন যাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং এরপর একটি ব্যাথাপূর্ণ অতীতে প্রয়োগ করা হয়েছে যার ফলে আমাদের পিতামহী-মাতামহীদেরকে তাদের স্বাধীনতা, সন্তান, ঐতিহ্য, গৌরব এবং ভূমি দিয়ে এর মূল্য দিতে হয়।"
বিচ (bitch) শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করার আন্দোলনটি বেগ পায় ১৯৯৪ সালের অল-উইমেন ব্যান্ড ফিফথ কলামের গান "অল উইমেন আর বিচেস" ও এরপর ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এলিজাবেথ উর্জেল এর বই "বিচ: ইন প্রেইজ অব ডিফিকাল্ট উইমেন" এর মধ্য দিয়ে। উর্জেল তার দর্শনকে এভাবে ব্যক্ত করেন, "আমি চিৎকার করতে চাই, ইঞ্জিন চালু করতে চাই, যখন আমার ইচ্ছা হয়, ব্লুমিংডেলসে আমার দুর্বার ক্রোধ নিক্ষেপ করতে চাই যদি আমার ইচ্ছা হয়, আমার ইচ্ছা হলে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিকে বলতে চাই আমার জীবনের খুটিনাটিগুলো। আমি তাই করতে চাই যা আমার ইচ্ছা হয়, তাই হতে চাই যা আমার ইচ্ছা হয়, আর কেবল নিজের কাছেই দিতে চাই সব কৈফিয়ত। আর এটাই সোজাসাপ্টা বিচ ফিলোসফি।"[৩৫]
স্লাটওয়াক (SlutWalk) এর সূচনার মধ্য দিয়ে ২০১১ সাল থেকে,[৩৬] তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীদের কাছে পুনরুদ্ধার কৌশলের কার্যকারিতা একটি হট টপিকে পরিণত হয়। প্রথম স্লাটওয়াক শুরু হয় টরন্টোতে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিলে, টরন্টোর একজন পুলিস অফিসার, মাইকেল সানগুইনেত্তির বিবৃতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তার বিবৃতি ছিল, "পুরুষের শিকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য নারীদেরকে স্লাটদের (বেশ্যার) মত পোশাক পড়া থেকে বিরত থাকা উচিত।"[৩৭] স্লাটওয়াক আন্দোলন খুব দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশে নারীরা এই "স্লাট" শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য স্লাটওয়াক আন্দোলনের অংশ হিসেবে কুচকাওয়াজ করেন। এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ছিল এরকম, যদি ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা স্লাট হয়, তাহলে সকল নারীই স্লাট, কারণ যেকোন নারী যেকোন পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই ধর্ষণের শিকার হতে পারে।[৩৮] "স্লাট" ব্যানার নিয়ে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে আন্দোলনকারীগণ নারীর শরীর সম্পর্কে সামাজিক ভাবমূর্তির পরিবর্তন এবং নারীর নিজেদের যৌনতার সম্ভাবনাময়তাকে নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এই শব্দটির ক্ষেত্রে এরূপ অবস্থান গ্রহণ করেন।[৩৯] এই আন্দোলনটি নারীদেরকে নিজেদের যৌনতার অধিকার অর্জনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করতে চায়। এখানে বলা হয়, যদি আপনি "স্লাট" হতে চান, তাহলে "স্লাট" হন। আর একই সাথে ভিক্টিম ব্লেইমিং বা ভুক্তভোগীর উপরেই দোষ চাপানোর জন্য এই আন্দোলনে সানগুইনেত্তির তীব্র সমালোচনা করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ৬০টি শহরে স্লাটওয়াক কার্যক্রম চলে, যার মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটি, বারলিন, সিয়াটল, ওয়েস্ট হলিউড এবং লন্ডন উল্লেখযোগ্য। স্লাটওয়াকের এই "স্লাট" শব্দটির পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদী ব্লগারদের অনেকে প্রশংসা করেন, আবার অনেকে সমালোচনা করেন। সমালোচনার কারণ ছিল, "স্লাট" শব্দটি কিছু সাংস্কৃতিক দলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।[৪০][৪১][৪২]
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ জাতি, সামাজিক স্তর, তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার অধিকার এবং যৌনতার স্বাধীনতাকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। আবার সেই সাথে কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয় যেমন গ্লাস সিলিং, যৌন হয়রানি, অন্যায্য মাতৃত্বকালীন ছুটির নীতি,[৪৩] ওয়েলফেয়ার (আর্থিক সাহায্য ও অন্যান্য ব্যবস্থা) এবং চাইল্ড কেয়ারের মাধ্যমে একক মা বা সিংগেল মাদারদের মাতৃত্ব সহায়তা, কর্মজীবী মায়েদের প্রতি এবং যেসব মা পূর্ণ-সময় সন্তান প্রতিপালনের জন্য কর্মজীবন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ মনোযোগ দেয়।[৪৪]
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের সমালোচকগণ তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদকে প্রায়ই তথাকথিত "লিপস্টিক" অথবা "নারীসুলভ" নারীবাদীদের আগমণ এবং "রাঞ্চ কালচারের" উত্থান এর জন্য সমালোচনা করেন। এটা করা হয় কারণ নতুন নারীবাদীগণ "অবজেক্টিফিকেশনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নারীত্ব ও নারী যৌনতার প্রকাশকেই" সমর্থন করেন।[৪৫] এই তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের নতুন নারীবাদীগণ যেকোন ধরনের বাঁধাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তা সেই বাঁধা পুরুষতান্ত্রিক বাঁধাই হোক, আর নারীবাদী বাঁধাই হোক। কীভাবে নারীদেরকে পোশাক পরতে হবে, কাজ করতে হবে ও নিজেদেরকে প্রকাশ করতে হবে এসবকিছুর উপর পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদী নিয়ন্ত্রণকে তারা বর্জন করেন।[৪৫] নারীবাদের এন্টি-পর্নোগ্রাফি চেতনার বিপরীতে নারীবাদীদের এই নতুন অবস্থান আশির দশকে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ "ভিক্টিম ফেমিনিজম" বা "শিকার নারীবাদের" ধারণাকে গ্রহণ করেছিল, যেখানে পর্নোগ্রাফিকে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন হিসেবে দেখা হত। এই নতুন নারীবাদীগণ বললেন, নিজেকে প্রকাশ করার স্বেচ্ছা ও স্বাধীন ইচ্ছা নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হতে পারে, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যম হতে পারে, এগুলো অভ্যন্তরীন দমন (internalized oppression) নয়।
যাই হোক, এধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষমতায়ন এবং স্বায়ত্বশাসনের ব্যক্তিবাচক বৈশিষ্ট্যের জন্য সমালোচিত হয়েছে। পণ্ডিতগণ অনিশ্চিত যে, ক্ষমতায়ন "ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অভ্যন্তরীন উপায়" নাকি "ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বহিঃস্থ উপায়"।[৪৬] এছাড়াও সমালোচকগণ পরিচয় এবং ধারণার ক্ষেত্রে "স্বাধীন ইচ্ছা এবং পছন্দের" অতিরিক্ত প্রয়োগেরও সমালোচনা করেন।[৪৬] যাইহোক, "নারীসুলভ" নারীবাদীগণ সমসাময়িক জগতের নারীত্ব এবং আত্মপরিচয় এর অর্থ বজায় রেখে সকল "আত্ম" বা সত্তার প্রতি উন্মুক্ত থাকার চেষ্টা করে।
তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীরা দাবী করেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিকে (নিয়ন্ত্রণ বর্জনকারী) "নারীসুলভ" নারীবাদ অথবা সরলভাবে "রাঞ্চ কালচার" বলে সীমাবদ্ধ করা উচিত না, বরং তারা নারীদের পালন করা বৈচিত্র্যময় সম্পর্কগুলো এবং ভূমিকাকে নারীবাদে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তারা তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের এরকম নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ববাদ বর্জনকারী ও স্বাধীন ইচ্ছার মধ্যে নারীর "নারীসুলভ" পরিচয় ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ে এসে তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদকে আরও বেশি ব্যাপক, বিস্তৃত ও পরিবেষ্টক বা ইনক্লুসিভ রূপ দিতে চান। জেন্ডার স্কলার লিন্ডা ডুইটস এবং লিয়েসবেট ভ্যান জুনেন নারীর পোশাকের স্বাধীনতার রাজনৈতিকীকরণ এবং কীভাবে "নারীদের বিতর্কিত পোশাক সম্পর্কিত পছন্দ" নাগরিক আলোচনায় "প্রয়োজনীয় নীতি" হিসেবে সংবিধিবদ্ধ হয় এসম্পর্কিত আলোচনার দ্বারা এই ব্যাপকতার বিষয়টিকে তুলে ধরেন।[৪৫] এভাবে তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদে ড্রেস চয়েজ বা পোশাকের ইচ্ছা হিসেবে হিজাব এবং বেলি শার্ট উভয়ই প্রয়োজনীয় নীতি হিসেবে শনাক্তকৃত হয়েছে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কারণে। নারীদের এই দুটো পোশাক একটি বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে যাকে প্রাথমিভাবে আত্ম-প্রকাশের দুটো বিরোধী ধরন বলে দেখা হয়। যাইহোক, "নারীসুলভ" নারীবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ব্যক্তি এই দুটোকেই "অবজেক্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের" প্রতীক হিসেবে দেখতে পারেন।[৪৬] হিজাবকে ইসলামিক পরিচয়ের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য বিরোধের প্রতি একটি প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে দেখা যায়, যেখানে বেলি শার্টকে দেখা হয় নারী যৌনতার উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। দুটোকেই আত্ম-প্রকাশের বৈধ ধরন হিসেবে দেখা হয়।[৪৬]
লায়লি মিলার-মুরো ১৯৯৭ সালে একটি এসাইলাম কেসের পর তাহিরিহ জাস্টিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে তিনি একজন স্টুডেন্ট এটর্নি হিসেবে নারী খৎনা নিয়ে কাজ করেন।[৪৭] মিলার-মুলো পরবর্তীতে তার ক্লায়েন্টের সাথে মিলে (যাকে তিনি সাহায্য করেছিলেন) একটি বই লেখেন এবং তার নিজের উপার্জনের ভাগটি তিনি তাহিরিহর নামে নামকরণ করা সেন্টারটির প্রাথমিক তহবিলের জন্য দান করেন। ২০১২ সালে এই সংগঠনটি বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসা ১৩,০০০ এরও বেশি নারী ও শিশুকে সাহায্য করে।[৪৮] এই সংগঠনটি ইন্টারন্যাশনাল মেরিজ ব্রোকার রেগুলেশন এক্ট (IMBRA) পাশের জন্য গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে। এই আইনটি ২০০৬ সালের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট বুশ কর্তৃক সাক্ষরিত হয় এবং ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন এক্ট (VAWA) এ যুক্ত হয়। IMBRA আইন বিদেশী নারীদেরকে তাদের প্রত্যাশিত আমেরিকান স্বামী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দান করত।
তৃতীয় তরঙ্গের সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গের একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে তৃতীয় তরঙ্গের প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে নারীবাদীগণ তাদের নিজেদের সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জনের জন্য আন্দোলন করতে শুরু করে। তুরস্কে নারীবাদী আন্দোলনকে প্রায়ই তিনটি আলাদা তরঙ্গের ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম তরঙ্গটি ছিল বিংশ শতকের প্রথম দিকে যখন ১৯২০ সালে নারীরা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।[৪৯] সুলে টকটাসের মতে, "পাশ্চাত্য সমাজ তৈরির জন্য কামালবাদী আদর্শের (কেমালিস্ট বা কামাল পাশার আদর্শ) বাস্তবায়ন করতে জেন্ডার নির্বিশেষে সকল নাগরিকের আইনগত সমতার দরকার ছিল"। এতে তুরস্কের নারীবাদীগণ সেই সময়ের নারীবাদী আদর্শের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হন।[৫০] তুরস্কে দ্বিতীয় তরঙ্গ অনেক পরে আসে। এটি এসেছিল ১৯৮০ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের পর।[৫১] তুরস্কের নারীরা সেইসব আচরণের স্বীকার হন যাকে অন্যান্য দেশে সেক্সিস্ট বিহেভিয়র বা লিঙ্গবাদী আচরণ বলা হয়: গণমাধ্যমে তুরস্কের নারীদের অবস্থার তদন্তের পর, পর্যবেক্ষকদের চোখে তুরস্কের নারীদের উপর নির্যাতন আরও বেশি সামনে আসে।[৫০]
ষাট ও সত্তরের দশকের বামপন্থী আন্দোলনের সময় কুর্দিশ নারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাথে ও সমাজে সমান হবার জন্য তাদেরকে লড়াই করতে হয়।[৫২] সেই সাথে কুর্দিশ নারীগণ বলতেন, "তাদের যৌনতা এবং ব্যক্তিবাদিতাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।"[৫২] তুরস্কে যেসব নারীরা কাজ করত তাদেরকে তুরস্কের সমাজ যৌনতাহীন সংগ্রামী (সেক্সলেস মিলিট্যান্টস) হিসেবে বর্ণনা করত। আশির দশকের আন্দোলনে সমাজতন্ত্রের সাথে জাতিগত সমস্যাগুলোতেও মনোযোগ দেয়া হয়।[৫২] কুর্দিশ নারীদের বিশাল অংশ চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকত যাকে তাদের স্বামীর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য হিসেবে বিবেচনা করা হত। এই নারীরা অধিকার আদায়ের জন্য তাদের বাড়িতে ও সমাজে ঘুরে দাঁড়ান এবং যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।[৫২] তারা তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।[৫২] এই সংরাম কুর্দিশ নারীদের আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।[৫২] নারীবাদের এই আন্দোলনটি তুরস্কের নারীদেরকে জেন্ডার বিষয়ে সচেতন হতে, তাদেরকে পুরুষদের সংগঠন থেকে পৃথক হতে এবং নারীবাদী হয়ে তাদের নিজেদের পরিচয় নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে উদ্দীপিত করে।[৫২] আজ ইসলামিক নারীগণ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এবং পরিচয়ের জন্য দাঁড়ান যাদের সব কিছুই তাদেরকে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি এবং তাদেরকে নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দান করে।[৫২]
তুরস্কে তৃতীয় তরঙ্গ এসেছিল ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে, আর এখনও এই তরঙ্গটি তুরস্কে বর্তমান। টার্কিশ রিপাবলিক এই নতুন তরঙ্গকে "কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী নারীবাদ" বা "কুর্দিশ ন্যাশনালিস্ট ফেমিনিজম" নামে নামকরণ করেছে।[৫১] জার্নাল অব বলকান এবং নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ অনুসারে, "কুর্দিশ নারীদের সংগঠনগুলো তুলে ধরে, তাদের উপর নির্যাতন দ্বিমুখী। তারা কুর্দিশ সংস্কৃতিতে থাকা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রযুক্ত নানান নির্যাতনের স্বীকার হন, আবার সেন্ট্রালিস্ট টার্কিশ স্টেট বা কেন্দ্রের তুর্কী রাজ্যের দ্বারা তাদের উপর চাপানো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনেরও স্বীকার তারা হয়ে থাকেন।"[৫০] ইসলামিক নারীবাদ খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকে ঘৃণা করা শুরু করল। এর কারণ ছিল তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ধারণা এবং মুসলিম সমাজের উপর সেগুলোর মিশ্রণ ও প্রভাব।[৫৩] ইসলামিক নারীগণ তাই তাদের ইসলাম ধর্মের সাথে সংলগ্ন থেকেই নারীবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার উপায়গুলোকে বেছে নেয়।[৫০]
কুর্দিশ নারীদের একটি সংগঠন, কামের (KAMER) হল বৃহত্তম নারীবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি।[৫০] এই সংগঠনটির বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যই পুরুষ কর্তৃক, বিশেষ করে স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন।[৫০] কামেরের প্রতিষ্ঠাতাগণ কুর্দিশ সমাজে অন্যান্য নারীদের নির্যাতন ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হবার সমস্যাগুলোকে বোঝেন।[৫০] কামের দেখে, গৃহে এইসব নারীদের এরকম অত্যাচারিত হবার ঘটনা খুবই সাধারণ। কেমারের লক্ষ্যকে শুধুমাত্র নারীদের সাহায্য করা থেকেও আরও বর্ধিত করা হয়, তারা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে চায় যা মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং গতানুগতিক ধারার নির্যাতনের সমাপ্তি চান যার ফলে নারী ও শিশু উভয়ই উপকৃত হবে।[৫০] কামের, চাগলা ডিনের (Cagla Diner) এবং সুলেসিটেস টোকলাস (Şulecites Toktaş) ছাড়াও অন্যান্য কুর্দিশ নারী সংগঠনগুলো হল দিকাসুম, কারদেলেন, সেলিস এবং ভাকাদ, যেগুলো নারীরা সম্মুখীন হন এরকম সমস্যার দিকে মনোযোগ দেয়।[৫০]
তুরস্কের সমগ্র নারীবাদী আন্দোলন জুড়েই, নতুন যুগের নারীবাদীগণ বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ে নারীদের উপর করা অসম আচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। এই সময়, নারীবাদীগণ অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন চাকরি সমস্যা সহ বিভিন্ন জেন্ডার সমস্যায় মনোযোগ দেন, যেসব সমস্যার কারণে সমাজে নারীগণ কম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেন এবং স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়ে কম জড়িত থাকেন।[৫১] এডাম লিক তার প্রবন্ধ এ ব্রিফ হিস্টোরি অব দ্য ফেমিনিস্ট মুভমেন্টস ইন টার্কি -তে লেখেন, "যেখানে এই জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলো অনুসারে নারীদেরকে পরিবারমুখী মা হয়ে সন্তানকে পালন করার কাজই সবসময় করতে হয়, সেখানে এগুলোকে অতিক্রম সমান মর্যাদা অর্জন করার উদ্দেশ্যে সামনে পা রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।"[৫১] ১৯৯০ এর দশক থেকে তুরস্কের নারীবাদী সংগঠনগুলো নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য এক বছর পর পর একত্রে মিলিত হন।[৫০] এই বার্ষিক সভাগুলোতে নতুন নতুন বিষয়, যেমন নারীদের জন্য আবাসস্থল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।[৫০] কুর্দিশ এবং তুর্কী নারীবাদী দলগুলোর একত্রে কাজ করা সত্ত্বেও এখনও নারীরা বৈষম্য ও লিঙ্গবাদের সমস্যাগুলোর স্বীকার হন।[৫০]
সমালোচকগণ প্রায়ই তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের একটি সমস্যা তুলে ধরেন, তা হল তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের একটি একক কারণের অভাব। প্রথম তরঙ্গ নারীদের ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছিল এবং এই অধিকারটি অর্জন করেছিল। দ্বিতীয় তরঙ্গ কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমাধিকার এবং আইনগত লিঙ্গবৈষম্যের সমাপ্তির জন্য লড়াই করেছিল।[৫৪]
নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গে এরকম কোহেসিভ বা সংযোগশীল লক্ষ্যের অভাব দেখা যায়, আর একে প্রায়ই দ্বিতীয় তরঙ্গের একটি বর্ধিতাংশ হিসেবে দেখা হয়।[৫৪] এছাড়াও তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের কোন নিরধারিত সংজ্ঞা নেই যা তাদেরকে দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ থেকে পৃথক করতে পারে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান, যখন নারীবাদের রাজনীতির কথা চিন্তা করা হয় তখন তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদকে "দ্বিতীয় তরঙ্গ - পার্ট ২" বলা যেতে পারে, আর "কেবলমাত্র তরুণ নারীবাদী সংস্কৃতিই সত্যিকারের তৃতীয় তরঙ্গ"।[১৬] কেউ কেউ দাবী করেন যে, তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের সাথে ব্যক্তিবাদ বা ইন্ডিভিজুয়ালিজমের সম্পর্কই এই আন্দোলনকে বৃদ্ধি পাবার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ক্যাথলিন পি. ইয়ানেলো তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদ নিয়ে তার চিন্তাধারা এভাবে ব্যক্ত করেছেন:
এমি রিচার্ডস এই প্রজন্মের নারীবাদী সংস্কৃতিকে তৃতীয় তরঙ্গ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন "কারণ, এটি নারীবাদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বা পরিণত একটি প্রকাশ।"[৫৪] দ্বিতীয় তরঙ্গ সেখানেই বৃদ্ধি পেয়েছিল যেখানে এই সংস্কৃতিতে রাজনীতি জড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন "কেনেডি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মানবাধিকার এবং নারী অধিকার"। তুলনায়, তৃতীয় তরঙ্গের উদয় ঘটেছে "পাংক রক, হিপ-হপ,'জাইন ('zines - ম্যাগাজিনের সংক্ষিপ্ত রূপ), পণ্য, কনজিউমারিজম এবং ইন্টারনেট" থেকে।[১৬]
ডাইয়ান এলাম তার একটি প্রবন্ধ জেনারেশনস, একাডেমিক ফেমিনিস্টস ইন ডায়ালগ -এ লিখেছেন:
রেবেকা ওয়াকার তার মা (লেখিকা অ্যালিস ওয়াকার) এবং গডমাদার বা ধর্মমাতার (গ্লোরিয়া স্টেইনেম) দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়কে ব্যক্ত করেন তার টু বি রিয়েল রচনায়:
"চয়েস ফেমিনিজমের (কর্ম এবং গৃহের মধ্যে) ধারণাগত এবং বাস্তব বিশ্বের "ফাঁদ" এর কারণে নারীগণ পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ না করে, নিজেরা নিজেদেরকেই চ্যালেঞ্জ করছে। ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিবাদিতাকে "চয়েস" হিসেবে গ্রহণ করায় নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। এটা তাদেরকে বরং চুপ করিয়ে রাখছে এবং নারীবাদকে সম্পদ বণ্টনের বাস্তব সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নারীবাদকে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হতে বাঁধা প্রদান করছে।"[৮০]
এমি রিচার্ডস এই প্রজন্মের নারীবাদী সংস্কৃতিকে তৃতীয় তরঙ্গ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন "কারণ, এটি নারীবাদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বা পরিণত একটি প্রকাশ।"[৫৪] দ্বিতীয় তরঙ্গ সেখানেই বৃদ্ধি পেয়েছিল যেখানে এই সংস্কৃতিতে রাজনীতি জড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন "কেনেডি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মানবাধিকার এবং নারী অধিকার"। তুলনায়, তৃতীয় তরঙ্গের উদয় ঘটেছে "পাংক রক, হিপ-হপ,'জাইন ('zines - ম্যাগাজিনের সংক্ষিপ্ত রূপ), পণ্য, কনজিউমারিজম এবং ইন্টারনেট" থেকে।[১৬] ডাইয়ান এলাম তার একটি প্রবন্ধ জেনারেশনস, একাডেমিক ফেমিনিস্টস ইন ডায়ালগ -এ লিখেছেন:
"এই সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠে যখন জ্যেষ্ঠ্য নারীবাদীগণ কমবয়সী নারীবাদীদেরকে ভাল মেয়ে (good daughters) হয়ে থাকতে জোড়াজুড়ি করে; আর তাদের মায়েরা যেরকম নারীবাদকে সমর্থন করে এসেছিল তাকেই সমর্থন করতে বলে। প্রশ্ন এবং সমালোচনা করা অনুমোদিত, কিন্তু তা তখনই অনুমোদন করা হবে যদি এই কমবয়সীরা নারীবাদীরা কেবল অনুমোদিত ধারার মধ্যে থেকেই অগ্রসর হয়। মেয়েদেরকে চিন্তার নতুন উপায় আবিষ্কার করার এবং তাদের নিজেদের জন্য নারীবাদ করার কোন অনুমতি দেয়া হয় না। জ্যেষ্ঠ নারীবাদীদের মতে, নারীবাদীদের রাজনীতিকে একই আকারে চালিত হতে হবে যেমনটা সবসময় ধরে নেয়া হয়েছে।"[১৬]
রেবেকা ওয়াকার তার মা (লেখিকা অ্যালিস ওয়াকার) এবং গডমাদার বা ধর্মমাতার (গ্লোরিয়া স্টেইনেম) দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়কে ব্যক্ত করেন তার টু বি রিয়েল রচনায়:
"তরুণ নারীবাদীরা তাদের কথা এবং গলার স্বরের দিকে এমনভাবে নজর রাখে যাতে তা তাদের বয়স্ক নারীবাদী মাদেরকে মর্মাহত না করে। যেসব নারীবাদীরা নিজেদেরকে দ্বিতীয় তরঙ্গ বলে মনে করেন তাদের সাথে নিজেদের তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদী মনে করা নারীবাদীদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ব্যবধান রয়েছে। এই দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ এবং তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদের ব্যবধানটি খুব স্পষ্ট হলেও, তরুণ নারীবাদীদের নিজেদেরক মূল্যবান, নারীবাদী স্কলার এবং সমাজকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক বেশি বেগ পেতে হচ্ছে।"[১৭]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; :32
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; :4
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি