মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া | |
---|---|
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দ/ ৬৩৫ হিজরি |
মৃত্যু | ৩ এপ্রিল ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ / ১৮ রবিউস সানি ৭২৫ হিজরি (বয়স ৮৬-৮৭) |
সমাধিস্থল | নিজামউদ্দিন দরগাহ |
ধর্ম | ইসলাম |
আখ্যা | সুন্নি |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
ধর্মীয় মতবিশ্বাস | মাতুরিদি[১] |
ক্রম | চিশতিয়া তরিকা |
মুসলিম নেতা | |
ভিত্তিক | দিল্লি |
কাজের মেয়াদ | তেরো শতকের শেষের দিকে এবং চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকে |
পূর্বসূরী | ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার |
উত্তরসূরী | নাসিরুদ্দিন চিরাঘ দেহলভী, আমীর খসরু, সৈয়দ জালালুদ্দীন হোসেন বুখারী ওরফে উচ শরীফের মখদুম জাহানিয়ান জাহাঙ্গশত, আখি সিরাজ আইনায়ে হিন্দ, বুরহানউদ্দিন গরীব প্রমুখ |
সুফিবাদ এবং তরিকা |
---|
প্রবেশদ্বার |
সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহি, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮ — ৩ এপ্রিল ১৩২৫) (উর্দু: حضرت شیخ خواجہ سیّد محمد نظام الدّین اولیاء), নিজামুদ্দিন নামেও পরিচিত, হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সূফি সাধক। ভারতে চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মহান সূফি সাধকদের মধ্যে তিনি একজন।[২] তার মূল ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী হয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির সাথে মিলিত হয়। এই অনুযায়ী তারা চিশতিয়া তরিকা মৌলিক আধ্যাত্মিক ধারাবহিকতা বা সিলসিলা তৈরী করেছেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, তার পূর্বসূরীদের ন্যায়, প্রেম বা ইশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা বা পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা মানবতার প্রতি ভালবাসার জন্ম দেয়। জিয়াউদ্দির বারানি নামে চৌদ্দ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের উপর তার প্রভাব এমন ছিল যে পার্থিব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিকতা এবং ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াবী চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে।[৩]
নিজামুদ্দিন আউলিয়া উত্তর প্রদেশের (দিল্লীর পূর্বে) বদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা সৈয়দ আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-হোসাইনী বদায়ুনীর মৃত্যুর পর তিনি তার মা বিবি জুলেখার সাথে দিল্লীতে চলে আসেন।[৪] ষোলতম শতাব্দীতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল মোবারক রচিত আইন-ই-আকবর-এ নিজামুদ্দিনের জীবনী উল্লেখ রয়েছে।[৫] বিশ বছর বয়সে, নিজামুদ্দিন আজোধানে (বর্তমানে পাকিস্তানের পাকপাত্তান শরীফ) যান এবং সুফি সাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, যিনি বাবা ফরিদ নামে অধিক খ্যাত। বাবা ফরিদ বর্তমান থাকা অবস্থায় তিনি প্রতি বছর রমজান মাস অতিবাহিত করতে আজোধানে যেতেন। তৃতীয়বার আজোধান সফরে গেলে বাবা ফরিদ তাকে তার উত্তরসূরি বা খলিফা মনোনীত করেন। এর কিছুদিন পরে, যখন নিজামুদ্দিন দিল্লিতে ফিরে আসেন, তিনি খবর পান যে, বাবা ফরিদ মৃত্যুবরণ করেছেন।
গিয়াসপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আগে, নিজামুদ্দিন দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতেন। তিনি সেখানে তার খানকা নির্মাণ করেছিলেন, যা একটি আধ্যাত্বিক স্থান যেখানে সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা হয় ও তিনি সেখানে অন্যদের আধ্যাত্বিক শিক্ষা প্রদান করতেন এবং তার নিজস্ব আবসস্থলও ছিল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই খানকাটি গরিব-ধনীসহ সকল প্রকারের মানুষের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তার অনেক শিষ্য আধ্যাত্বিকতার উচ্চ আসন অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে শেখ নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ চিরাঘ দেহলভী,[৬] এবং প্রখ্যাত সুফি/গায়ক ও দিল্লি সালতানাতের রাজ্যসভার কবি আমির খসরু।[৫] তিনি ১৩২৫ সালের ৩ এপ্রিল (১৮ রবিউস সানি ৭২৫ হিজরি) সকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মাজার নিজামুদ্দিনের দরগাহ দিল্লিতে অবস্থিত।[৭] এবং বর্তমানে স্থাপনাটি ১৫৬২ সালে নির্মিত হয়। মাজারটি সমস্ত ধর্মের লোকেরা সারা বছর ধরে পরিদর্শন করে, যদিও এটি নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং আমির খসরুর মৃত্যুবার্ষিকী বা উরসের সময় একটি মাহফিল বা ধর্মীয় সভায় পরিণত হয়,[৮] যাকে নিজামুদ্দিনের দরগাহতে সমাহিত করা হয়।
নিজামুদ্দিন যখন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের নাম প্রথমবারের মত শুনেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র বারো কি তেরো বছর এবং তখন থেকেই ফরিদউদ্দিনের প্রতি তার হৃদয়ে সম্মান ও ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। তিনি তার শিষ্যগণকে বর্ণনা করেন, বাবা ফরিদ এর নাম শোনার পর তার মনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোন সুফি সাধকের নাম শুনে এমনকি তাদের সাথে সাক্ষাতের পরও তার এ অবস্থা হয়নি। আগুনের ফুল্কির মত তার প্রেম বাড়তেই থাকে। যদি তার সহপাঠীরা তার দিয়ে কোন কাজ করাতে চেষ্টা করত তখন তারা বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিত এবং তিনি কখনও কেউ বাবা ফরিদের নামে দোহায় দিলে সে কাজে মানা করতেন না। তিনি তার জীবনে কারো জন্য এ ধরনের অনুভূতি অনুভব করেননি। বিশ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি বাবা ফরিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার জীবিত জীবনে তিনি বাবা ফরিদের দরবারে তিনবার গিয়েছিলেন।
তার প্রায় ৬০০ এর বেশি খলিফা (খলিফা হচ্ছে একজন শিষ্য যাকে বায়াত গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয় এবং স্বীয় মুর্শিদ বা পীরের বংশানুক্রমকে বিস্তার করার দায়িত্ব দেয়া হয়) আছে যারা বিশ্বময় তার আধ্যাত্বিক সাজরাকে বজায় রেখেছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত শিষ্যগণ হলেন:
তিনি ছিলেন তার পীর বা মুর্শিদের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য, তাঁর মুখপাত্র ও প্রধান খলিফা। তিনি তার পীরের জন্য নিজের বিপুল ধনরাশি ও রাজকীয় সম্মানের সর্বস্ব ত্যাগ করেন। তিনি তার মুর্শিদের এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, একদা নিজামুদ্দিন আউলিয়া বলেছিলেন, "যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সাথে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।"[৯] তিনি আরো বলেন, কেউ যদি আমার রওজা (সমাধিস্থল) জিয়ারত করতে আসে; তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে তারপর তার রওজা।[১০] পীরের পরলোক গমনের ছয় মাস পর তিনিও পরলোক গমন করেন। বিষয়টি হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পর তার প্রিয় কণ্যা ফাতেমার ইন্তেকালের সাথে মিলে যায়। যার সম্পর্কে আগেই হজরত মোহাম্মদ এর ভবিষ্যৎবাণী ছিল যা তিনি অন্তিমশয্যায় তার কণ্যা ফাতেমাকে ডেকে বলেছিলেন যে, তার এন্তেকালের পর সর্বপ্রথম ফাতেমাই তার সাথে মিলিত হবেন। তাকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। তার মাজার নয়াদিল্লির নিজামুদ্দিন দরগাহে অবস্থিত। নিজামুদ্দীন আউলিয়ার ওরশ মোবারকের ছয় মাস পর আমির খসরুর ওরশ মোবারক পালিত হয়।
তিনি ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি। তিনি ভারতের চিশতিয়া তরিকার পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে পঞ্চমতম বলে বিবেচিত হন (অন্যরা হলেন মঈনুদ্দিন চিশতী, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার,নিজামুদ্দিন আউলিয়া)। ভারতের নয়াদিল্লির চিরাগ দিল্লিতে তার মাজার রয়েছে।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাকে আয়নায়ে হিন্দ (ভারতের আয়না) উপাধি দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন তার সাথে বসবাস করেছিলেন। তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রথম দিকের শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি তাকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন। তার মাজার পশ্চিমবঙ্গের মালদা শহরের পীরানা পীর দরগাহে অবস্থিত।
তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার প্রথম দিকের শিষ্যদের মধ্যে একজন এবং তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুর্শিদ বা পীরের সাথে বসবাস করেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর পর তিনি দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং সেখানে তিনি যে স্থানে থাকতেন তা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে তার মাজার অবস্থিত।
প্রতি বছর হিজরি মাসের ১৭-১৮ রবিউস সানি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ওরশ (মৃত্যুবার্ষিকী) নিজামুদ্দিন দরগাহে পালিত হয় এবং ১৮ শাওয়াল আমির খসরুর ওরশও পালিত হয়।
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; khus
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি