পঞ্চকন্যা (पञ्चकन्या, pañcakanyā) ভারতীয় মহাকাব্যের প্রবাদপ্রতিম প্রধান পাঁচ নারী চরিত্র। তাদের প্রশংসাসূচক স্তবগান ও নাম পঠনে সকল পাপ দূরীভূত হবে বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। তারা হচ্ছেন - অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী। রামায়ণ থেকে অহল্যা, তারা ও মন্দোদরী এবং মহাভারত থেকে দ্রৌপদী ও কুন্তীকে নেয়া হয়েছে।[১][২]
এক দৃষ্টিকোণে পঞ্চকন্যাকে আদর্শ নারী ও সতী-সাধ্বী স্ত্রীরূপে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। তাদের একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ভঙ্গের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যা অন্যরা অনুসরণ করেনি।
সুপরিচিত সংস্কৃত স্তব-স্তুতিতে পঞ্চকন্যার বিষয়ে বলা হয়েছে:
সংস্কৃত প্রতিবর্ণীকরণ
অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্।।
বঙ্গানুবাদ
অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী
- এই পঞ্চকন্যাকে নিত্য স্মরণ করলে মহাপাপগুলো দূরীভূত হয়।
কুন্তীর স্থলে সীতাকে বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে:[৩]
সংস্কৃত প্রতিবর্ণীকরণ
অহল্যা দ্রৌপদী সীতা তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্।।
পার্থক্য শব্দের নিচে দাগ দেয়ার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশেষতঃ হিন্দু গৃহিনীরা প্রত্যেক সকালে প্রার্থনার মাধ্যমে পঞ্চকন্যাকে নিত্য স্মরণ করে থাকেন। তাদের নাম প্রশংসাসূচক ও প্রার্থনা প্রাতঃস্মরণীয় হয়। সকালের শুরুতে তাদের নাম জপ করা একান্ত বাধ্যতামূলক।[১][২]
সাহিত্যে পঞ্চকন্যার অর্থ হচ্ছে পাঁচ কন্যা। কন্যাকে বালিকা, কন্যা, কুমারীরূপে অনুবাদ করা হয়।[১][৪][৫] যদিও তারা বিবাহিতা, তবুও কন্যা শব্দকে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু নারী বা সতী (সতী-সাধ্বী স্ত্রী) হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি যা প্রদীপ ভট্টাচার্যের কাছে কৌতূহল-উদ্দীপক হিসেবে মনে হয়েছে।[১]
অহল্যা, তারা ও মন্দোদরী - এ কন্যাত্রয়কে হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে দেখা যায়। এর প্রধান নারী চরিত্র সীতাকে মাঝে-মধ্যে পঞ্চকন্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সীতা প্রধান পঞ্চকন্যাদের অন্যতম।
‘আহিল্যা’ নামে পরিচিতা অহল্যা মুনি গৌতম মহর্ষির স্ত্রী। অহল্যাকে প্রায়শঃই পঞ্চকন্যাদের প্রধানারূপে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে মূলতঃ তার চারিত্রিক গুণাবলী, অসাধারণ সৌন্দর্য ও তার সময়কালীন ঘটনাপ্রবাহে প্রথম কন্যার স্থান পায়।[৬] অহল্যাকে দেবতা ব্রহ্মা’র সৃষ্টিকর্ম হিসেবে সমগ্র মহাবিশ্বের সেরা সুন্দরীরূপে প্রায়শঃই বর্ণনা করা হয়।[১] এছাড়াও তাকে মাঝে-মধ্যে চন্দ্র রাজবংশীয় পার্থিব রাজকন্যারূপে ডাকা হয়ে থাকে।[৭] গৌতমের আদর-যত্নে অহল্যা বয়ঃসন্ধিকালের পূর্ব পর্যন্ত বসবাস করতে থাকেন। অবশেষে বৃদ্ধ ঋষির সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র তার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন ও গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণের মাধ্যমে ঋষির অনুপস্থিতিতে অনুরোধ বা আদেশবলে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেন। রামায়ণের শুরুতে পূর্ণ আখ্যানে বর্ণিত রয়েছে, অহল্যা ইন্দ্রের কপটচারিতায় শিকারে পরিণত হন এবং তাকে চিনতে ব্যর্থ হন অথবা ধর্ষিত হন।[৮] তবে সকল বর্ণনায় অহল্যা ও তার প্রেমিক (বা ধর্ষক) ইন্দ্র গৌতমের অভিশাপের কারণ হন।[৮] তবে, গ্রন্থের শুরুতে অহল্যার বিশ্বে অদৃশ্য অবস্থায় থেকে অনেক দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয় এবং দেবতা বিষ্ণুর অবতার ও রামায়ণের প্রধান চরিত্র রামের আতিথেয়তা লাভে প্রায়শ্চিত্ত ঘটান। পরবর্তী সময়ে বিকাশমান প্রচলিত কাহিনীতে দেখা যায় যে, অহল্যা পাথরখণ্ডে পরিণত হন ও রামের চরণ স্পর্শের মাধ্যমে মানবরূপ ধারণ করেন।[১][৮] এছাড়াও কিছু সংস্করণে তাকে শুষ্ক নদীপ্রবাহে পরিণত হতে দেখা যায় ও প্রবাহ শুরু হয়ে তার পাপস্খলন গৌতমী নদীতে (গোদাবরী) মিলিত হলে সম্পন্ন হবার কথা তুলে ধরা হয়। ইন্দ্র খোজা হয়ে প্রায়শ্চিত্ত ঘটান বা সহস্র যোনীমুখে আবৃত অবস্থায় অভিসম্ভাবিরূপে সহস্র চক্ষুতে পরিণত হবার মাধ্যমে অভিশাপ মুক্ত হয়েছিলেন।[১][৭][৮]
তারা কিষ্কিন্ধ্যার রাণী ও বানররাজ বালী’র সহধর্মিনী ছিলেন। বিধবা হবার পর তিনি বালীর ভাই সুগ্রীবের রাণী হন। রামায়ণে বানর চিকিৎসক সূরসেনের কন্যা হিসেবে তারাকে চিত্রিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে অন্য উৎসে সমুদ্র মন্থনে অপ্সরারূপে (স্বর্গীয় জলপরী) তার জন্ম হয়েছে বলে দেখানো হয়।[১][৯] তিনি বালীকে বিয়ে করেন ও অঙ্গদ নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এক দৈত্যের সাথে বালীকে সম্ভাব্য মৃত ভেবে সুগ্রীব রাজা হন ও তারাকে নিজ অধিকারভুক্ত করেন।[৯] তবে বালী ফিরে আসেন ও তারাকে ফিরে পান এবং ভাই সুগ্রীব পালিয়ে যান; তার বিরুদ্ধে বালী বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। এছাড়াও সুগ্রীবের পত্নী রুমাকে নিজ অধিকারভুক্ত করেন। যখন সুগ্রীব বালীকে দ্বৈত যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানান তখন তারা বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে বালীকে প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেন। এর কারণ হিসেবে সুগ্রীবের রামের সাথে মিত্রতার কথা জানান। কিন্তু, বালী তার কথা অবহেলায় আনেন ও সুগ্রীবের মদদে রামের চাতুর্যময় তীরে বালীর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে বালী সুগ্রীবের সাথে পুনরায় মিলিত হন ও যাবতীয় বিষয়ে তারার বিজ্ঞতাসূচক পরামর্শ অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। কাহিনীর অধিকাংশ সংস্করণেই তারার বিলাপগাঁথা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ফুটে উঠেছে। তবে অধিকাংশ স্বদেশী সংস্করণে তারার সতীত্বের মহিমায় রামকে অভিশাপ প্রদান করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।[১] কিছু সংস্করণে রাম তারাকে জ্ঞানদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুগ্রীব সিংহাসন ফিরে পান। কিন্তু প্রায়শঃই হই-হুল্লায় মদ্যপানে বর্তমান প্রধান রাণী তারার সাথে সময় কাটান এবং রাবণ কর্তৃক অপহৃত রামের স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারকল্পে প্রতিশ্রুত সহায়তায় ব্যর্থ হন।[৫] তারা বর্তমানে সুগ্রীবের রাণী ও তৎকালীন স্মারকসূচক প্রধান কূটনীতিবিদ হিসেবে সুগ্রীবের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ কিষ্কিন্ধ্যা ধ্বংসে উদ্যত রামের ভাই লক্ষ্মণের সাথে কৌশলে পুনর্মিলন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।[১][৫]
লঙ্কার রাক্ষস (দৈত্য) রাজা রাবণের রাজমহিষী ছিলেন মন্দোদরী। হিন্দু মহাকাব্যে তাকে পরমা সুন্দরী, ধার্মিক ও ভগবভক্তরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। অসুরাজের (দৈত্য) রাজা মায়াসুর ও অপ্সরা (স্বর্গীয় জলপরী) হেমার কন্যা তিনি। কিছু কাহিনীতে অপ্সরা মধুরার ব্যাঙ হয়ে যাবার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে ও ১২ বছর নির্বাসিত থাকার কথা তুলে ধরা হয়। পরবর্তীতে তিনি তার সৌন্দর্য ফিরে পান বা ব্যাঙ থেকে সুন্দরী কুমারীতে পরিণত হন।[৪] উভয়ক্ষেত্রেই মায়াসুরের কন্যারূপে মন্দোদরী দত্তক কন্যা ছিলেন। একদা রাবণ মায়াসুরের গৃহে পদার্পণ ঘটান ও মন্দোদরীর প্রেমে পড়েন। এরপর তারা বৈবাহিকসম্পর্ক স্থাপন করলে মেঘনাদ (ইন্দ্রজিৎ), অতিকায় ও অক্ষয়কুমার নামের তিন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়।[১০] কিছু গৃহীত রামায়ণে মন্দোদরীকে রাবণ কর্তৃক ঘৃণ্য অপহরণে রামের পত্নী সীতারও মাতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[১১] স্বামীর দোষ-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মন্দোদরী তাকে ভালোবাসেন ও ধার্মিকতার পথ অনুসরণে পরামর্শ দিতে থাকেন। মন্দোদরী বারংবার সীতাকে রামের কাছে ফেরত দেয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেন। কিন্তু তার এ পরামর্শ বধির কানে অগ্রাহ্য হতে থাকে।[৪] রাবণের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যবোধ রামায়ণে উচ্ছসিতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।[১২] রামায়ণের পৃথক সংস্করণগুলোয় রামের বানর সেনাপতিদের হাতে তার নিগ্রহতার বিষয় চিত্রিত হয়েছে।[১] কিছু সংস্করণে তাদের হাতে অপদস্থ হতে হয়েছেন তিনি, রাবণের যজ্ঞ পণ্ড করে দেয়াসহ অন্যগুলোয় রাবণের জীবন রক্ষাকবচস্বরূপ তাদের হাতে সতীত্ব নাশের বিষয় এসেছে।[১] হনুমান কৌশলে তার কাছ থেকে ঐন্দ্রজালিক তীরের অবস্থান অবগত হয়ে রাবণকে বধের উদ্দেশ্যে রামের হাতে তুলে দেয়। রাবণের মৃত্যুর পর লঙ্কারাজ্যের বিশ্বাসঘাতক ও রাবণের ছোটভাই রামভক্ত ধর্মপ্রাণ বিভীষণ মন্দোদরীকে রামের পরামর্শক্রমে বিয়ে করেন।[১] কিছু সংস্করণে মন্দোদরী অভিশপ্ত করেন যে সীতাকে রাম পরিত্যাগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়।[১]
সীতা রামায়ণের প্রধান নারী চরিত্র। তিনি হিন্দু দেবতা রামের (বিষ্ণুর অবতার) সহধর্মিনী। এছাড়াও, বিষ্ণুর পত্নী এবং ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী’র অবতার হচ্ছেন সীতা। তিনি সকল হিন্দু মহিলার কাছে আদর্শবতী পত্নীসুলভ ও নারীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গীরূপে বিবেচিত হন।[১৩][১৪] বিদেহের রাজা জনকের পালিতা কন্যা তিনি। পৃথিবীতে পরিখা খননকালে তাকে খুঁজে পান।[১৫] অযোধ্যার রাজকুমার রাম স্বয়ংবর অনুষ্ঠানে সীতাকে জয় করেন। পরবর্তীতে রাম চৌদ্দবছরের জন্য নির্বাসনে যান, সীতাও রামের সাথে যোগ দেন। অযোধ্যায় অবস্থানের জন্য রামের ইচ্ছার বিপরীতে তার ভাই লক্ষ্মণ নির্বাসনকে বেছে নেন।[১৫]
দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন থাকাকালে তিনি রাবণের পাতানো শিকারে পরিণত হন ও রামকে সোনার হরিণের খোঁজে প্রেরণ করলে রাবণ চাতুর্যতার সাথে তাকে অপহরণ করেন। সীতাকে লঙ্কার অশোক বাটিকার কুঞ্জবনে আটকিয়ে রাখা হয়। রাবণকে যুদ্ধে পরাভূত করে সীতাকে উদ্ধার করে আনেন রাম।[১৫] অগ্নিপরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সীতা তার সতীত্বের প্রমাণ দেন। রাম ও সীতা অযোধ্যায় ফিরে আসেন ও রাম রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন।[১৫] এক ধোপা তার সতীত্বের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলে রাম গর্ভবতী সীতাকে বনে পাঠিয়ে দেন।[১৫] সীতা ঋষি বাল্মিকী’র তপোবনে লব ও কুশ নামে যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।[১৫] সন্তানেরা বড় হয়ে পিতা রামের সাথে পুনর্মিলিত হয়। রাম তাকে ফিরিয়ে আনার পূর্ব সীতাকে আবারো তার সতীত্বের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এবার সীতা তার মাতা পৃথিবীর কোলে ফিরে যেতে মত দেন।[১৫] স্বামী বিবেকানন্দের মতে, সীতা ভারতের প্রতিনিধিস্থানীয়া - ভারতের আদর্শ। স্বামী বিবেকানন্দ আশ্বস্ত করেন যে, অতীতের বিশ্বসাহিত্য ও ভবিষ্যতের বিশ্বসাহিত্য একীভূত হলেও আরকেটি সীতাকে খুঁজে বের করে আনা অসম্ভব। কারণ, সীতা অদ্বিতীয়, তার চরিত্র সকলের জন্য একবারই গঠিত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ রামকে অনেকভাবে দেখেছেন, কিন্তু কখনো সীতাকে একবারের বেশি দেখেননি।
হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে কন্যা দ্রৌপদী ও কুন্তীকে কখনো কখনো পঞ্চকন্যারূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দ্রৌপদী মহাভারতের প্রধান নারী চরিত্র। তিনি পঞ্চ পাণ্ডব ভাইদের স্ত্রী ও তাদের রাজ্য হস্তিনাপুরের রাণী। পাঞ্চলের রাজা দ্রুপদের হোমাগ্নি থেকে তার জন্ম। দ্রোণ ও কৌরবদের বিনাশে দ্রৌপদী নেতৃত্ব দেন।[১৬] যদিও মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন ব্রাহ্মণরূপে তার স্বয়ংবরে জয়ী হন; কিন্তু শাশুড়ী কুন্তীর নির্দেশে পাঁচ ভাইয়ের সকলকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। দ্রৌপদী সর্বদাই প্রধান স্ত্রী হবেন ও সর্বদাই সম্রাজ্ঞীরূপে আখ্যায়িত হবার শর্তে পাণ্ডবগণ পরিকল্পনায় সম্মত হন। তিনি প্রতি বছর এক ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করবেন ও তার সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন। কোন কারণে চার ভাইয়ের কেউ তাদের ব্যক্তিগত সময়ে ব্যাঘাত ঘটালে তাকে অবশ্যই ১১ মাসের জন্য তীর্থযাত্রায় গমন করতে হবে।[১৬] তিনি স্বয়ংবরে কৌরবদের সেনাপতি কর্ণকে অপমান করেন[১৭] এবং ইন্দ্রপ্রস্থে অবস্থিত পাণ্ডব প্রাসাদ থেকে বের হবার সময় কৌরবদের নেতা দুর্যোধনের হাসির পাত্র হন। প্রত্যেক পাণ্ডবের পাঁচ পুত্রসন্তানের জননী হন ও প্রত্যেক বছর শেষে তার সতীত্ব অক্ষুণ্ণ রাখেন।[১৭] পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় পরাজিত করে ও শর্ত মোতাবেক তাকে গ্রহণ করে প্রতিশোধ নেয়। দুঃশাসন রাজ দরবারে তার বস্ত্রহরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে আবৃত কাপড়কে অসীমতায় দিকে নিয়ে যাবার ফলে তার মর্যাদা রক্ষা পায়।[১৬] দুঃশাসনের রক্তে চুল ধৌত করার পূর্ব পর্যন্ত দ্রৌপদী তার চুল খোলা রাখার অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় ও দরবারে সকলের উপস্থিতিতে তার স্বামীদের ভর্ৎসনা করেন। খেলায় পরাজিত হবার পর পাণ্ডবগণসহ দ্রৌপদী অবশেষে ১৩-বছরের নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ করেন। বনে নির্বাসনকালে দ্বিতীয় স্বামী ভীম বিভিন্ন দৈত্য ও তাকে অপহরণকারী জয়দ্রথের হাত থেকে রক্ষা করেন।[১৬] এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সত্যভামার কাছ থেকে স্ত্রী-ধর্ম সম্পর্কে অবগত হন। ১৩ বছর নির্বাসন শেষে দ্রৌপদী ও তার স্বামীরা ছদ্মবেশ ধারণ করে বিরাটের দরবারে কাজ করতে থাকেন। তিনি রাণীর দাসী হিসেবে কাজ করতে থাকেন ও রাণীর ভ্রাতা কীচকের হাতে লাঞ্ছিত হন। পরবর্তীতে অবশ্য ভীমের হাতে কীচক নিহত হন।[১৩] নির্বাসিত জীবন শেষে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কৌরবদের বিনাশ হয় ও তার অপমানের প্রতিশোধ নেয়া হয়। কিন্তু দ্রৌপদী তার পিতা, ভ্রাতৃদ্বয় ও পুত্রদের হারান। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সম্রাট ও দ্রৌপদী প্রধান সম্রাজ্ঞী হন।[১৬] তাদের জীবনের শেষদিকে দ্রৌপদী তার স্বামীদের নিয়ে পদযাত্রা করে হিমালয়ের দিকে স্বর্গ অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু, অন্যান্য স্বামীর তুলনায় মধ্যম পাণ্ডব অর্জুনের দিকে অধিক ভালোবাসার মোহ থাকার ফলে দ্রৌপদী মাঝখানে মৃত্যুমুখে পতিত হন।[১৬] তিনি গ্রাম্য দেবী হিসেবে পূজিতা হন ও সময়বিশেষে অগ্নিশর্মা দেবী কালী বা ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অবতাররূপে চিত্রিত হয়ে থাকেন।[৫][১৭]
কুন্তী হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডু’র রাণী ও তিন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের মাতা ছিলেন। যাদব রাজা শূরসেনের কন্যা ছিলেন ও কুন্তী রাজ্যের নিঃসন্তান রাজা কুন্তীভোজের দত্তক কন্যা ছিলেন কুন্তী।[১৮] প্রার্থনাবলে তিনি ঋষি দূর্বাশার কাছ থেকে মন্ত্র পান। এ মন্ত্র উচ্চারণে তিনি এক দেবতার কাছ থেকে সন্তান লাভের অধিকার রাখেন। তিনি উদাসী চিত্তে এ বর পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সূর্য দেবতাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি কর্ণ নামে এক পুত্রসন্তানের নামকরণ করে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। পরে কর্ণকে ত্যাগ করেন তিনি।[১৮] ঐ সময়ে কুন্তী তার স্বয়ংবরে পাণ্ডুকে মনোনীত করেন।[১৯] পাণ্ডু এক ঋষি কর্তৃক অভিশপ্ত হন যে, কোন নারীর সাথে সহবাস করলেই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। পাণ্ডুর আদেশে কুন্তী দুর্বাশার বরের সাহায্যে দেবতা যমের কাছ থকে যুধিষ্ঠির, তারপর দেবতা বায়ুর কাছ থেকে ভীম ও দেবতা ইন্দ্রের কাছ থকে তৃতীয় সন্তান অর্জুনের মাতা হন।[১৮] তার উপ-পত্নী মাদ্রীকে অশ্বিনের কাছ থেকে নকুল ও সহদেব নামে যমজ দুই সন্তান পান। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মাদ্রি পাণ্ডুর মৃত্যুকালীন সতী হিসেবে একই চিতায় আরোহণের কথা থাকলেও কুন্তী হস্তিনাপুরে ফিরে যান ও পাঁচ পাণ্ডবের যত্ন নেন।[১৮] পাণ্ডুর সৎভাই ও রাজার পরামর্শদাতা বিদুরের বন্ধু ছিলেন। হস্তিনাপুরের রাজকুমার ও পাণ্ডবদের কাকাতো ভাই কৌরবেরা কুন্তী ও তার পুত্রদের হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্ত তারা এযাত্রা রক্ষা পায়। তিনি দৈত্য হিড়িম্বের কাছ থেকে ভীমকে রক্ষা করেন ও তার পরামর্শক্রমে হিড়িম্বার সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন ভীম। তাদের ঘটোৎকচ নামের এক পুত্র জন্ম নেয়।[১৯] তিনি তার সন্তানদেরকে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষার পরামর্শ দেন ও ভীমকে দৈত্য বকাসুরকে হত্যার আদেশ দেন।[১৮] অর্জুন দ্রৌপদীকে জয় করে আনলে কুন্তী এ পুরস্কার সকল ভাইদের মাঝে বণ্টনের নির্দেশনা দেন।[১৮] কুন্তী ও পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। কৌরবদের সাথে পাশা খেলায় পরাজিত হলে পাণ্ডবেরা ১২ বছরের নির্বাসনে যায়। এ সময় কুন্তী বিদূরের আশ্রয়ে ছিলেন।[১৮] পাণ্ডব ও কৌরবদের মাঝে মহাযুদ্ধ নিশ্চিত হলে কুন্তী কৌরবদের সেনাপতি কর্ণের কাছে আত্মপ্রকাশ করেন। কর্ণ তার মার পরিচয় পেয়ে অর্জুন ছাড়া কোন পাণ্ডবকে হত্যা না করার প্রতিশ্রুতি দেন।[১৮] কৌরব ও কর্ণকে বধের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হলে কুন্তী কৌরবদের পিতা-মাতাকে নিয়ে বনে গমন করেন ও প্রার্থনার মাধ্যমে শেষজীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। দাবানলে তার দেহাবসান ঘটে ও স্বর্গ গমনে যান।[৫][১৮]
সকল কন্যাই তাদের জীবনে মায়ের অভাব অনুভব করেছেন। অহল্যা, তারা, মন্দোদরী, সীতা ও দ্রৌপদীর জন্ম হয়েছে অতিপ্রাকৃত ঘটনার মাধ্যমে। অন্যদিকে কুন্তী জন্মকালে দত্তক সন্তানে পরিণত হন ও মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যদিও কুন্তী ছাড়া সকল কন্যাকেই মাতারূপে চিত্রিত করলেও কোন কন্যাকেই তাদের মাতৃত্ববোধ কাহিনীতে জোড়ালো হয়নি। অন্য সাধারণ উপাদান হচ্ছে তাদের কীর্তিগাঁথার মূলভাব নষ্ট হয়েছে। অহল্যা অভিশপ্ত হয়েছেন ও তার পরিবার কর্তৃক পরিত্যক্তা ঘোষিত হন। তারা তার স্বামীকে, দ্রৌপদী তার সন্তানদেরকে এবং মন্দোদরী তার স্বামী, সন্তান ও আত্মীয়বর্গকে যুদ্ধে হারান। তারা প্রত্যেকেই বিয়োগগাঁথায় জড়িয়ে পড়েন ও পুরুষ কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছেন। কিন্তু তারা জীবন ও সমাজের যুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। প্রদীপ ভট্টাচার্য তাদেরকে পিতৃতান্ত্রিক উপাখ্যান তৈরিতে শিকারে পরিণত করার কথা বলেন। কিন্তু গোঁড়া হিন্দুরা সচরাচর তার বিরোধিতা হিসেবে তাত্ত্বিক মতবাদ ও বিকৃত বার্তার ন্যায় মতবাদরূপে আখ্যায়িত করে গেছেন। মুক্ত-আধ্যাত্মিকতার অধিকারী অহল্যা তার ব্যভিচারের জন্য শাস্তি পেয়েছেন। দ্রৌপদী তার স্বামীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিদ্রুপ করেছেন। তা সত্ত্বেও তার মর্যাদা পুরুষ কর্তৃক বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে।[২০]
মহরি নাচের ঐতিহ্যগাঁথায় পঞ্চকন্যাকে সমভাবে পাঁচটি উপাদানে বিভক্ত করা হয়েছে। অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীকে যথাক্রমে জল, অগ্নি, পৃথিবী, বায়ুর ও আকাশের প্রতিনিধিত্বকারীরূপে বলা হয়। একই উপমাস্বরূপ বিশিষ্ট লেখিকা বিমলা পাতিল অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীকে যথাক্রমে বায়ু, অগ্নি, পৃথিবী, আকাশ ও জলের সাথে তুলনা করেছেন।[২০]
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পঞ্চকন্যাদের উপখ্যানকে ঘিরে পর্বের মূলভাববস্তু নিয়ে ‘পঞ্চকন্যা’ শীর্ষক কবিতাসংগ্রহ রচনা করেন।[২১] পঞ্চকন্যাদের কাহিনী অদ্যাবধি ওড়িশ্যার ঐতিহ্যবাহী মহরি নৃত্যে জনপ্রিয় অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে।[২২]
এক দৃষ্টিকোণে পঞ্চকন্যাকে আদর্শ নারীরূপে গণ্য করা হয়। জর্জ এম. উইলিয়ামস মন্তব্য করেন যে, তারা নিখুঁত নন কিন্তু তাদের মা, বোন, পত্নী ও মাঝেমধ্যে স্বীয়গুণে নেতৃত্ব লাভের ন্যায় কর্তব্য বা ধর্মপালন করে গেছেন।[৪] অন্য দৃষ্টিকোণে মহরি নৃত্যকলায় তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক সতী-সাধ্বী নারী বা মহাসতী[২২] এবং কিছু অসামান্য গুণাবলীর অধিকারী মহামূল্যবান আদর্শস্থানীয়রূপে বিবেচনা করা হয়।[২]
অন্য দৃষ্টিকোণে পঞ্চকন্যাকে আদর্শ নারী সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।[২৩] ‘পঞ্চকন্যা: দ্য ফাইভ ভার্জিনস অব ইন্ডিয়ান এপিকসের’ লেখক ভট্টাচার্য তালিকাভুক্ত পাঁচ সতীর বিপরীতক্রমে আরেকটি ঐতিহ্যগত প্রার্থনা: সতী, সীতা, সাবিত্রী, দাময়ন্তী ও অরুন্ধতীরূপে তুলে ধরেন। তিনি অলঙ্কারবিদদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, ‘অহল্যা, দ্রৌপদী, তারা, কুন্তী ও মন্দোদরী সতী-সাধ্বী স্ত্রী নন কারণ তাঁরা তাঁদের স্বামীদের চেয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন না কি?’[১]
এসকল নারীরা তাদের জীবনের অধিকাংশ সময় দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন এবং নারীদের জন্য বিবেচিত নির্দেশনামা ও প্রবিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করে গেছেন। তাদেরকে মনুস্মৃতি, রামায়ণ ও মহাভারতের ন্যায় মহাকাব্যে সকল বিবাহিতা পাঁচ আদর্শ নারীরূপে বিবেচনা করা হয়েছে।[২৪]