রাজনীতি |
---|
সম্পর্কিত ধারাবাহিকের অংশ |
রাজনীতি প্রবেশদ্বার |
প্রয়োগবাদী রাজনীতি বলতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে স্পষ্ট ভাবাদর্শ বা নৈতিকতার সাথে কঠোরভাবে আবদ্ধ না থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা-পরিস্থিতি ও নিয়ামকসমূহকে প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে সেগুলির সাথে সাযুজ্য রেখে কোনও নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করা হয়।[১] অন্য কথায় বললে রাজনৈতিক অবস্থা বাস্তবে কীরকম সেটিই এখানে বিবেচ্য, একজন আদর্শবাদী কীভাবে সেটিকে দেখতে চান, তা মুখ্য নয়।[২] একে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে প্রায়ই রেয়ালপোলিটিক (জার্মান: Realpolitik; আ-ধ্ব-ব: [ʁeˈaːlpoliˌtiːk]) নামক জার্মান ভাষা থেকে উদ্ভূত পরিভাষাটি দিয়ে নির্দেশ করা হয়। রাজনৈতিক বাস্তববাদের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষেত্রে আলোচিত বাস্তববাদ ও দার্শনিক প্রয়োগবাদের মিল আছে। প্রয়োগবাদী রাজনীতির কিছু কাছাকাছি ধারণা হল মাকিয়াভেল্লিবাদ ও শক্তির রাজনীতি (জার্মান মাখটপোলিটিক Machtpolitik)।[২] আধুনিক কূটনীতিতে প্রয়োগবাদী রাজনীতি বলতে জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অবিরাম কিন্তু বাস্তববাদী উপায়ে লক্ষ্য নির্ধারণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাকে বোঝায়।
"প্রয়োগবাদী রাজনীতি" কথাটিকে প্রায়শই একটি ইতিবাচক কিংবা নিরপেক্ষ পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হলেও কখনও কখনও এটিকে নেতিবাচক অর্থেও ব্যবহার করা হতে পারে, যার রাজনৈতিক নীতিগুলিকে দমনমূলক, নৈতিকতাহীন বা মাকিয়াভেল্লীয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[৩] বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে বাস্তববাদী রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবক্তা হলেন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার, জর্জ এফ. কেনান, জবিগ্নিউ ব্রজেজেনস্কি ও হান্স-ডিট্রিখ গেনশার ও রাজনীতিবিদ শার্ল দ্য গোল ও লি কুয়ান ইউ[৪]
১৯৬০-এর দশকে, পোলীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কূটনীতিবিদ জবিগনিউ ব্রজেজিনস্কির প্রভাবে (যিনি পরবর্তীতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস্তববাদী রাজনীতি বা রেয়ালপোলিটিকের সূচনা হয়। এর আগে ম্যাকার্থিবাদ যুগে সোভিয়েতে ইউনিয়নের সাথে যে আদর্শগত বৈরিতা ছিল ও আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালিস সোভিয়েত প্রভাবাধীন পূর্ব ব্লককে সামরিক উপায়ে "মুক্ত" করার যে কথা বলতেন, তার বিপরীতে ব্রজেজিনস্কি মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি ও লিন্ডন বি জনসনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে "শান্তিপূর্ণ সম্পৃক্ততা"র (peaceful engagement) পক্ষে প্রস্তাব করেন। ব্রজেজিনস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক সোভিয়েত-বিরোধী উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি অনুভব করেন যে সাম্যবাদী রাষ্ট্র ও তাদের জনগণের সাথে ঘন ঘন আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও সফল হতে পারে। ব্রজেজিনস্কি পূর্ব ব্লকের অধিবাসীদের কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে, , বিশেষ করে পণ্যসমূহের স্থায়ী ঘাটতির ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন যে ঐ দেশগুলি ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আবদ্ধ, কোনও সাধারণ মতাদর্শের ভিত্তিতে নয়। ব্রজেজিনস্কি এই দেশগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে আকর্ষণ করার ব্যাপারে সুপারিশ করেন। এরপরে তিনি যেসব সরকার উদারীকরণের পক্ষে বা মস্কো-র উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের নিদর্শন প্রদর্শন করে, সেগুলিকে আনুকূল্য প্রদর্শনের পক্ষে মত দেন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্রজেজিনস্কি "ফাঁকা রাজনৈতিক বুলির একটি বাস্তববাদী, বিবর্তনমূলক বিকল্প প্রস্তাব করেন।"[৫]
মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউজে বাস্তববাদী রাজনীতির প্রবর্তক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[৬] সেই প্রেক্ষাপটে বাস্তববাদী রাজনীতি বলতে অন্যান্য ক্ষমতাধর জাতির সাথে কোনও রাজনৈতিক মতবাদ বা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং প্রায়োগিক বাস্তবমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে কর্মকাণ্ড চালানোর নীতিকে বোঝায়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদের বিরোধী হলেও মাও সে তুংয়ের অধীন সাম্যবাদী চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। আরেকটি উদাহরণ হল ১৯৭৩-এর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরে কিসিঞ্জারের খেয়াতরী কূটনীতি (shuttle diplomacy), যেখানে তিনি ইসরায়েলিদেরকে আংশিকভাবে সিনাই উপদ্বীপ থেকে প্রত্যাহার করতে রাজি করান, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন তেল সংকটের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি নত হতে বাধ্য হয়।
কিসিঞ্জার নিজে কখনও রেয়ালপোলিটিক পরিভাষাটি ব্যবহার করেননি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন যে পরিভাষাটি উদারপন্থী ও বাস্তববাদী উভয় ধরনের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক চিন্তাবিদেরা সমালোচনা করা ও তকমা এঁটে দেবার জন্য ব্যবহার করেন।[৭] কিসিঞ্জার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে তার কাজগুলিকে মান নীতি হিসেবে বাস্তববাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে না দেখে একজন রাষ্ট্রপরিচালনাবিদের কাজ হিসেবে দেখেন। কিসিঞ্জারের মতে একজন রাষ্ট্রপরিচালনাবিদের ভূমিকা হল "শক্তিসমূহের মধ্যকার প্রকৃত সম্পর্কগুলি শনাক্ত করার ক্ষমতা ও এই জ্ঞানকে তার নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগানো।"[৮][৯]
এ দিক থেকে দেখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মান নীতি না হলেও বাস্তববাদী রাজনীতি কীভাবে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করতে পারে, তা দেখতে পাওয়া যায়। জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ও বারাক ওবামার প্রশাসন এই ধরনের বাস্তববাদী বা প্রয়োগবাদী রাজনীতিভিত্তিক নীতি গ্রহণ করে। ওবামা প্রশাসনের হোয়াইট হাউসের প্রধান কর্মকর্তা রাম এমানুয়েলের মতে তারা "নিজ জাতির স্বার্থের ব্যাপারে ঠাণ্ডা মাথায়" কাজ করেন।[১০]
প্রয়োগবাদী রাজনীতির সাথে ভাবাদর্শবাদী রাজনীতির পার্থক্য হল এই যে এটি কোনও পূর্বনিধারিত নিয়মসমষ্টি দ্বারা শাসিত হয় না, বরং এটি লক্ষ্যভিত্তিক হয়ে থাকে এবং কেবলমাত্র ব্যবহারিক জরুরি অবস্থাই একে সীমায়িত করে। যেহেতু প্রয়োগবাদী রাজনীতি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার সবচেয়ে প্রায়োগিক পদ্ধতিগুলির প্রতি পরিচালিত হয়, তাই এটির কারণে আদর্শবাদী নীতির সাথে আপোস করতে হতে পারে। যেমন স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই মানবাধিকার লংঘনকারী সরকারদের সমর্থন দেয়, কেননা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য তাত্ত্বিকভাবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[১১][১২][১৩][১৪] স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরেও এই রেওয়াজ অব্যাহত থাকে।[১৫][১৬][১৭][১৮]