ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন | |
---|---|
![]() সোভিয়েত সময়ের মূল পোস্টার | |
মূল শিরোনাম | Бронено́сец «Потёмкин» |
পরিচালক | সের্গেই আইজেনস্টাইন |
প্রযোজক | জেকব ব্লিয়খ |
রচয়িতা |
|
শ্রেষ্ঠাংশে |
|
সুরকার |
|
চিত্রগ্রাহক |
|
সম্পাদক |
|
প্রযোজনা কোম্পানি | |
পরিবেশক | গসকিনো |
মুক্তি |
|
স্থিতিকাল | ৭৫ মিনিট |
দেশ | সোভিয়েত ইউনিয়ন |
ভাষা |
|
ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন (রুশ: Бронено́сец «Потёмкин», [রণতরী পটিয়োমকিন] ত্রুটি: {{Lang-xx}}: text has italic markup (সাহায্য)) হল ১৯২৫ সালের সোভিয়েত নির্বাক চলচ্চিত্র। এটি পরিচালনা করেছেন সের্গেই আইজেনস্টাইন এবং প্রযোজনা করেছে মসফিল্ম। এতে ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের চিত্র তোলে ধরা হয়েছে, যেখানে রুশ রণপোত পটিয়োমকিনের নাবিকেরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে। কিন্তু সেই সময়ে অদেসায় কোন হত্যাকাণ্ড হয় নি এবং বিপ্লবের ফলে পটিয়োমকিনের আরও খারাপ পরিণতি হয়েছিল।[১]
ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন চলচ্চিত্রটিকে ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলস বিশ্ব মেলায় সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।[২][৩][৪] এটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র।[৫] এছাড়া ছবিটি ১৯৬৪ সালে সুইডিশ চলচ্চিত্র সাময়িকী চ্যাপলিনের করা ৫০ জন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের ভোটে ৩২ ভোট পেয়ে সেরা নির্বাক চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি লাভ করে।[৬]
চলচ্চিত্রটি ১৯০৫ সালের জুন মাসের প্রেক্ষাপটে গৃহীত, চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রাবলী হল সাম্রাজ্যবাদী রুশ নৌবাহিনীর ব্ল্যাক সি ফ্লিটে পটিয়োমকিন রণতরীর সদস্যবৃন্দ। আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের কাহিনীকে পাঁচটি দৃশ্যপটে ভাগ করেন, এবং প্রতিটি ভাগের পৃথক নাম দেন।
প্রথম দৃশ্যে দুজন নাবিক মাতুশেঙ্কো ও ভাকুলিঞ্চুক রাশিয়ায় সংগঠিত বিপ্লব রুখতে পটিয়োমকিনে আরও সদস্যের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা করেন। পটিয়োমকিন তেন্দ্রা দ্বীপে নোঙ্গর ফেলে এবং কর্তব্য থেকে ছুটিরত নাবিকগণ তাদের শয্যায় ঘুমাচ্ছে। একজন কর্মকর্তা পরিদর্শন করতে এসে একজন নাবিকের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। এতে ভাকুলিঞ্চুকের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং সে অন্যদের উদ্দ্যেশে বলে, "কমরেডগণ! সময় এসেছে আমাদেরও কথা বলতে হবে। কেন অপেক্ষা করব? সমগ্র রাশিয়া জেগে ওঠেছে! আমরাই কি সর্বশেষ?" পরের দৃশ্যে ডেকে নাবিকগণ জাহাজের সদস্যদের জন্য নিম্নমানের মাংসের ব্যাপারে অভিযোগ জানান। মাংস পঁচে গেছে ও পোকায় পরিপূর্ণ হয়েছে, এবং নাবিকেরা বলে "কুকুরও এই মাংস খাবে না!" জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজের ডাক্তার স্মির্নভকে ডাকেন মাংস পরীক্ষার জন্য। পোকার পরিবর্তে ডাক্তার জানান এগুলো পোকার ডিম, এবং রান্নার পূর্বে ধৌত করলে তা চলে যাবে। নাবিকেরা পরে নিম্নমানের রসদের জন্য অভিযোগ জানান, কিন্তু ডাক্তার বলেন এই মাংস খাবার যোগ্য এবং আলোচনা শেষ করে চলে যান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিলিয়ারভ্স্কি যেসব নাবিক তখনও পঁচা মাংসের দিকে তাকিয়ে ছিল তাদের সেই স্থান ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন এবং পাচক বর্শ্চত রান্না শুরু করেন, যদিও সেও মাংসের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জাহাজের সদস্যগণ সেই বর্শ্চত খাওয়া পরিহার করে রুটি ও পানি এবং ক্যানের ভিতরের খাদ্য গ্রহণ করেন। থালা পরিষ্কার করার সময় একজন নাবিক একটি থালায় খোদাই করে লেখা দেখতে পান, যেখানে লেখা আছে "আমাদের প্রতিদিনের খাবার দাও, প্রতিদিনের রুটি।" এই লেখার অর্থ বুঝতে পেরে নাবিকটি থালাটি ভেঙ্গে ফেলে এবং প্রথম দৃশ্যপট শেষ হয়।
যারা মাংস পরিহার করেছে তাদের অবাধ্য হওয়ার অপরাধে দোষী সাবস্ত্য করা হয়েছে এবং তাদের ডেকে ডাকা হয় যেখানে তাদের শেষ ধর্মীয় আচার প্রদান করা হয়। নাবিকদের হাটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয় এবং বন্দুকবাজ দল ডেকে আসলে তাদের একটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্রথম কর্মকর্তা গুলি করার নির্দেশ দেয়, কিন্তু ভাকুলিঞ্চুকের আত্মসমর্পণের জবাবে বন্দুকবাজ দল তাদের রাইফেল নিচু করে এবং বিদ্রোহ শুরু হয়। নাবিকেরা অল্পসংখ্যক কর্মকর্তাদের বিপর্যস্ত করে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। কর্মকর্তাদের বাইরে ফেলে দেওয়া হয় এবং জাহাজের পূজারী লুকানো অবস্থায় ছুরিবিদ্ধ হয়, এবং ডাক্তারকে সাগরে "মাছের খাদ্য" হিসেবে ছুড়ে ফেলে হয়।
বিদ্রোহ সফল হয়, কিন্তু বিদ্রোহের নেতা ভাকুলিঞ্চুককে হত্যা করা হয়। পটিয়োমকিন ওদেসা বন্দরে পৌঁছায়। ভাকুলিঞ্চুকের মৃতদেহ সৈকতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার সঙ্গীরা একটি তাবুতে তার দেহ জনগণকে প্রদর্শন করে। তার বুকে লেখা ছিল "এক চামচ সুপের জন্য।" নাবিকেরা ভাকুলিঞ্চুকের শেষকৃত্যের জন্য এবং তাকে তাদের বীর হিসেবে প্রশংসা করার জমায়েত হয়। ওদেসার জনগণ নাবিকদের স্বাগত জানান, কিন্তু তারা পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বিচ্ছিন কোসাকদের একটি দল ওদেসার সোপানের উপরে সারিবদ্ধ হয় এবং নারী ও শিশুসহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ভীড়ের দিকে এগিয়ে আসে। সেনারা ভীড়ের মধ্যে গুলিবর্ষণের জন্য থামে এবং পুনরায় মেশিনের মত অগ্রসর হতে থাকে। সল্পস্থায়ী এই দৃশ্যে মানুষজনকে পালিয়ে যেতে ও পদদলিত হতে, একটি শিশুর খেলনা সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে, এক নারীর মুখে গুলি লাগতে, ভাঙ্গা চশমা এবং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সৈন্যদের জুতা দেখা যায়।
প্রতিশোধস্বরূপ পটিয়োমকিনের নাবিকেরা রণতরীর গোলা দিয়ে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে গোলা বর্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে, খবর আসে পটিয়োমকিনের বিপ্লব দমন করতে রাজভক্ত রনপোতের অশ্বারোহী সৈন্যদল আসছে।
পটিয়োমকিনের নাবিকেরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা সকলে মিলে ওদেসা বন্দর থেকে রণতরীর নেতৃত্ব দিবে এবং জারের জাহাজের বহরের মোকাবেলা করবে। যখন যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পরে, অবিশ্বাস্যভাবে রাজভক্ত জাহাজের প্রাক্তন নাবিকেরা তাদের কমরেডের উপর গোলা বর্ষণ করতে অস্বীকার করে।
১৯২৫ সালে রুশ বিপ্লবের ২০তম বছর। কমিশন অব দ্য সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় ১৯০৫ সালের বিপ্লবের উপর কয়েকটি কাজ মঞ্চস্থ করবে। পাশাপাশি একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে একটি বিশাল চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হবে, যাতে মৌখিক ভূমিকা, সঙ্গীত (একক ও ঐকতান বাদক দল) বিশেষ লিখিত বর্ণনাসহ নাট্যধর্মী উপস্থাপনা থাকবে, এবং চলচ্চিত্রটির নির্মাণ সেই বছরের মধ্যে শেষ হতে হবে।[৭] ফলে চলচ্চিত্রটির প্রস্তুতির সময় ছিল খুবই অল্প, মাত্র নয় মাসের মধ্যে চলচ্চিত্রের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। নিনা আগাদঝানোভাকে পাণ্ডুলিপি রচনার জন্য এবং ২৭ বছর বয়সী সের্গেই আইজেনস্টাইনকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করা হয়।[৮] শুটিং শুরুর পূর্বেও চিত্রনাট্য রচনা শেষ হয় নি। আগাদঝানোভা শুটিং শুরুর পরও চিত্রনাট্য উন্নয়নে কাজ করে যান। আগাদঝানোভা ও আইজেনস্টাইন ছাড়াও আইজেনস্টাইনের অন্যান্য সহকর্মীরা ছবিটির চিত্রনাট্যে সহযোগিতা করেন। আইজেনস্টাইনের সহকারী গ্রিগরি আলেক্সান্দ্রভ শুটিং ও সম্পাদনায় সাহায্য করেন।[৯]
মূল পাণ্ডুলিপিতে ১৯০৫ সালের বিপ্লবের বেশ কিছু ঘটনা ওঠে এসেছে। যেমন রুশ-জাপান যুদ্ধ, আর্মেনীয়-তাতার হত্যাকাণ্ড, সেন্ট পিটার্সবার্গে বিপ্লবী ঘটনাবলী, মস্কো গণঅভ্যুত্থান। চলচ্চিত্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি শহরে চিত্রায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।[১০]
আধুনিক সমালোচকেরা ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন চলচ্চিত্রটির প্রশংসা করেন। পর্যালোচনা ভিত্তিক ওয়েবসাইট রটেন টম্যাটোস-এ ৪৪টি পর্যালোচনার ভিত্তিতে ৯.১/১০ গড়ে ছবিটির রেটিং স্কোর ১০০, যা দ্বারা মূলত "সতেজ ছাড়পত্র" লাভ বোঝায়। ওয়েবসাইটির পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, "একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠকর্ম, ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন সুন্দরতম সোভিয়েত চলচ্চিত্র, এবং এর মনতাজের সম্পাদনা কৌশল এখনকার সময় পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে রয়ে গেছে।"[১১] মুক্তির পর থেকে ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন চলচ্চিত্রটিকে এখন পর্যন্ত নির্মিত সুন্দরতম প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র হিসেবে উদ্ধৃত করা হয় এবং সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবেও বিবেচিত হয়।[২][১২] চলচ্চিত্রটি ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলস বিশ্ব মেলায় ২৬টি দেশের ১১৭ জন বিশেষজ্ঞের ভোটে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ঘোষিত হয়।[৩][১৩] ১৯৫২ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনে চলচ্চিত্রটি সেরা দশ চলচ্চিত্র তালিকার চতুর্থ স্থানে অবস্থান করে, প্রতি দশক পরে করা ভোটে পাঁচ দশক সেরা দশে অবস্থানের পর ২০১২ সালের ভোটে ১১তম স্থানে নেমে আসে।[১৪]
২০১০ সালে এম্পায়ার সাময়িকীর "বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেরা ১০০ চলচ্চিত্র" তালিকায় চলচ্চিত্রটি তৃতীয় স্থান অধিকার করে।[১৫] ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে চলচ্চিত্রটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিবেশনায় যুক্তরাজ্যের প্রেক্ষাগৃহে পুনঃমুক্তি দেওয়া হয়। পুনঃমুক্তিতে টোটাল ফিল্ম সাময়িকী চলচ্চিত্রটিকে পাঁচ তারকা প্রদান করে, এবং লেখে, "প্রায় ৯০ বছর হয়ে গেছে, আইজেনস্টাইনের এই শ্রেষ্ঠকর্ম এখনো গ্যারান্টিসহ নাড়ির স্পন্দন ত্বরান্বিত করবে।"[১৬] ১৯৭৯ সালে ৩০ জন ফিনীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও বিশেষজ্ঞের করা সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রের তালিকায় ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন চলচ্চিত্রটি ২৩তম স্থান অধিকার করে।[১৭]
পরিচালক অরসন ওয়েলস,[১৮] মাইকেল মান[১৯] এবং পল গ্রিনগ্রাস[২০] ব্রনিয়েনোসেৎস পটিয়োমকিন চলচ্চিত্রটিকে তাদের প্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় রেখেছেন।
২০০৭ সালে এই চলচ্চিত্রের দুই ডিস্ক ওয়ালা সংরক্ষিত সংস্করণের ডিভিডি প্রকাশ করে। টাইম ম্যাগাজিনের রিচার্ড করলিস এই ডিভিডিকে সেই বছরের সেরা দশ ডিভিডির পঞ্চম সেরা বলে উল্লেখ করেন।[২১]