শাতিল আরব আরভান্দ রুদ | |
---|---|
স্থানীয় নাম | |
অবস্থান | |
দেশ | ইরান, ইরাক |
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য | |
উৎস | |
• অবস্থান | আল-কুরনায় টাইগ্রিস–ইউফ্রেটিস সঙ্গমস্থল এবং ইরান-এর কারুণ নদী[১] |
• উচ্চতা | ৪ মি (১৩ ফু) |
মোহনা | |
• অবস্থান | পারস্য উপসাগর |
• উচ্চতা | ০ মি (০ ফু) |
দৈর্ঘ্য | ২০০ কিমি (১২০ মা) |
অববাহিকার আকার | ৮,৮৪,০০০ কিমি২ (৩,৪১,০০০ মা২) |
নিষ্কাশন | |
• গড় | ১,৭৫০ মি৩/সে (৬২,০০০ ঘনফুট/সে) |
শাতিল আরব (আরবি: شط العرب, আরবদের নদী),[২] আরভান্দ রুদ (ফার্সি: اروندرود, দ্রুত নদী) নামেও পরিচিত এই নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২০ মাইল)। দক্ষিণ ইরাক-এর বাসরা গভর্নরেট এর আল-কুরনা শহরে ফোরাত এবং দজলা-এর সঙ্গমে এই নদীটি গঠিত হয়েছে। নদীর দক্ষিণ প্রান্তটি ইরাক ও ইরান-এর মাঝে সীমানা গঠন ক'রে পারস্য উপসাগর-এ গিয়ে মিশেছে। বসরায় এর প্রস্থ প্রায় ২৩২ মিটার (৭৬১ ফু) এবং মুখের দিকে তা বেড়ে হয়েছে ৮০০ মিটার (২,৬০০ ফু) পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, এর জলধারাটি তুলনায় সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক সময়ে তৈরি হয়েছিল। সে সময়, মূলত পশ্চিমে আরও একটি চ্যানেল তৈরী হয়েছিল এবং তার মাধ্যমেই টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের জলধারা, পারস্য উপসাগরে মুক্ত হত।
এই নদীর একটি শাখা হ'ল কারুণ নদী। সেই শাখা নদীটি ইরানের দিকের জলপথের সাথে মিলিত হয়ে এসে, এই নদীটিতে প্রচুর পরিমাণে পলি জমা করে। সেই কারণে, নদীটিতে চলাচল সচল রাখতে অবিরত ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হয়।[৩]
এই অঞ্চলটিতে বিশ্বের বৃহত্তম খেজুর বন রয়েছে ব'লে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, এই অঞ্চলে খেজুর গাছ ছিল ১৭ থেকে ১৮ লক্ষ, বিশ্বের ৯০ লক্ষ গাছের এক-পঞ্চমাংশ। কিন্তু ২০০২ সালের মধ্যে, যুদ্ধ, লবণ এবং কীটপতঙ্গের কারণে ইরাক-এ প্রায় ৯ লক্ষ এবং ইরান-এ ৫ লক্ষ, মোট প্রায় ১৪ লক্ষরও বেশি খেজুর গাছ নষ্ট হয়ে যায়। বাকি ৩ থেকে ৪ লক্ষ গাছের মধ্যে অনেকের অবস্থা খুব খারাপ[৪]
মধ্য পারসিয়ান সাহিত্য এবং শাহনামে-তে (আনুমানিক ৯৭৭ এবং ১০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত), আরভান্দ (اروند) নামটি ব্যবহৃত হয়েছে টাইগ্রিসের জন্য, যার মিলিত ধারা শাতিল আরব।[৫] ইরানীরাও এই নামটি বিশেষত পরের পহ্লভি আমল-এ শাতিল আরবকে ব্যবহারের জন্য মনোনীত করেছিল এবং ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব-এর পরেও তা অব্যাহত ছিল।[৫]
শাতিল আরব নদীটি আল-কুরনাতে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মিলিত ধারায় সৃষ্টি হয়েছে এবং আল-ফাও শহরের দক্ষিণে পারস্য উপসাগর অবধি প্রবাহিত হয়েছে। একটি সমীক্ষা অনুসারে, পূর্ববর্তী গবেষণার লিথোয়াসিস এবং বায়োফেসিস তুলনা করে, সাম্প্রতিক পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক সময়-মাপকাঠিতে নদীটি গঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নদীটি সম্ভবত ২০০০ থেকে ১৬০০ বছর আগে গঠিত হয়ে থাকতে পারে।[৬]
বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন ইরাক প্রতিষ্ঠার পটভূমি জানতে আমাদের মূলত অটোম্যান-সাফাভিড যুগের দিকে পিছিয়ে যেতে হবে। ১৬ শতকের গোড়ার দিকে, বর্তমান ইরাকের বেশিরভাগ অংশ ইরানি সাফাভিদ-এর অধিকারে ছিল। কিন্তু পরে পিস অফ আমাস্য (১৫৫৫) অটোম্যানদের কাছে হেরে যান। [৭] ১৭ শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাফাভিদ শাসক (শাহ) আব্বাস প্রথম (১৫৮৮-১৬২৯) অটোম্যানদের কাছ থেকে এটি আবার দখলে আনতে (অস্থায়ীভাবে, জলপথ নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে) পারলেও, জুহাব চুক্তির (১৬৩৯) মাধ্যমে এটি চিরদিনের জন্য তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়।[৮] এই চুক্তির ফলে, ১৫৫৫ সালে যেভাবে অটোম্যান এবং সাফাভিদ সাম্রাজ্যের সাধারণ সীমানা ছিল, মোটামুটি সেটিই পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দক্ষিণ দিকের সীমান্ত সম্পর্কে কখনই একটি সুনির্দিষ্ট এবং স্থির সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। নাদির শাহ (১৭৩৬-১৭৪৮) নৌপথে ইরানি নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু কের্দে চুক্তি (১৭৪৬) বলে জুহাব সীমানা পুনরুদ্ধার হলেও তা তুর্কিদের হাতে তুলে দিতে হয়। [৯][১০] এরজুরুমের প্রথম চুক্তি (১৮২৩) ) অটোম্যান তুরস্ক এবং কোয়াজার ইরানের মধ্যে সাধিত হয়, এবং পরিণতি সেই একই থেকে যায়।[১১][১২]
দীর্ঘ আলোচনার পর ১৮৪৭ সালে এরজুরুমের দ্বিতীয় চুক্তি অটোম্যান তুরস্ক এবং কোয়াজার ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে ব্রিটিশ ও রাশিয়ান প্রতিনিধিরাও ছিলেন। এরপরেও, তাদের মধ্যে অস্বীকার ও মতবিরোধ চলতেই থাকে। ইতিমধ্যে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রসচিব লর্ড পামারস্টোন ১৮৫১ সালে মন্তব্য করেন "গ্রেট ব্রিটেন এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি অবাধ সিদ্ধান্ত ছাড়া তুরস্ক ও পারস্য-এর মধ্যে সীমানা রেখার কখনও নিষ্পত্তি হতে পারে না"। ১৯১৩ সালে ইস্তাম্বুল-এ অটোম্যান ও পার্সিয়ানদের মধ্যে একটি খসড়া স্বাক্ষরিত হয়। এতে ঘোষণা করা হয়, অটোম্যান-পার্সিয়ান সীমান্ত থালওয়েজ বরাবর চলবে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমস্ত পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেয়।
ইরাক ম্যান্ডেট (আজ্ঞা)-এর সময় (১৯২০-৩২), ইরাকের ব্রিটিশ উপদেষ্টারা ইউরোপে থালওয়েজ নীতির অধীনে জলপথ দ্বৈতভাবে চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন: বিভাজক রেখা টানা হয়েছিল, প্রবাহ তল এবং গভীরতর বিন্দুর মধ্যে। ১৯৩৭ সালে ইরান ও ইরাক, একটি চুক্তি স্বাক্ষর ক'রে, শাতিল আরব নিয়ন্ত্রণ বিরোধের নিষ্পত্তি করেছিল।[১৩] ১৯৩৭ সালের চুক্তিতে ইরান-ইরাকি সীমান্ত বরাবর শাতিল আরবের পূর্ব দিকের নিম্ন-জল রেখাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম ছিল আবাদান ও খোররমশহর। সেখানে সীমান্তটি থালওয়েজ (গভীর জল রেখা) বরাবর চালিত ছিল এবং তা ইরাককে প্রায় পুরো জলপথের নিয়ন্ত্রণ অধিকার দিয়েছিল। যেমন, সেখানে শাতিল আরব ব্যবহারকারী সমস্ত জাহাজে ইরাকি পতাকা ওড়াতে হবে এবং একজন ইরাকি পাইলট থাকতে হবে এবং যখনই ইরাণের জাহাজ শাতিল আরব ব্যবহার করবে, তখনই তাদেরকে ইরাকের কাছে টোল প্রদান করার দরকার পড়বে। [১৪] ১৯৩৭ সালের চুক্তিটি অনেকটা, ভারত উপমহাদেশ এবং অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশিক বা প্রভাবিত অঞ্চলে নিয়মিতভাবে প্রয়োগ করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি পরিচিত ধরন বিভাজন ও শাসন-এর মতো। ১৯২০-১৯৩২ সময়কালে "থালওয়েজ" নীতিটি ব্যবহারের বিপরীতে বলা যায়, তা না হ'লে দুটি দেশের মধ্যে নদীর সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমিত করত অথবা তার ইতি টেনে দিতে পারত।
১৯৩২-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইরাক সাম্রাজ্য-এর অস্ত্রের কোটের মাঝে, শাতিল আরব এবং অরণ্যকে চিত্রিত করা হয়েছিল।
৬০ এর দশকের শেষদিকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীনে ইরানে একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটেছিল এবং নিকট প্রাচ্যে আরও দৃঢ়তাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিল। [১৩] ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে ইরান শাতিল আরবকে কেন্দ্র করে ১৯৩৭ সালের চুক্তি বাতিল করে দেয় এবং শাতিল আরব ব্যবহার করার সময় ইরাকের কাছে ইরানি জাহাজের টোল প্রদান বন্ধ করে দেয়। [১৫] শাহ যুক্তি দিয়েছিলেন যে ১৯৩৭ সালের চুক্তি ইরানের পক্ষে অন্যায্য ছিল, কারণ বিশ্বের প্রায় সমস্ত নদীর সীমানা থালওয়েজ ধরে চলে, এবং শাতিল আরব ব্যবহারকারী বেশিরভাগ জাহাজ ছিল ইরানী।[১৬] ইরাকের এই পদক্ষেপে ইরাক যুদ্ধের হুমকি দেয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৪ শে এপ্রিল ইরানি যুদ্ধজাহাজ (জয়েন্ট অপারেশন আরভান্দ)-এর পাহারায় একটি ইরানি ট্যাঙ্কারকে শাতিল আরবে সামিল করে দেয়। সামরিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্র ইরাক কিছুই করতে পারে নি। [১৪] ১৯৩৭ সালের চুক্তিটি ইরানের বাতিল করার কারণে এক তীব্র ইরাক-ইরান উত্তেজনার সূচনা করে, যা ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স অ্যাকর্ড পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। [১৪]
এই বিরোধের নিস্পত্তি এবং মধ্যস্থতার জন্য রাষ্ট্রসংঘ-এর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাদ্দাম হুসেন-এর অধীনে বাথিস্ট ইরাক, ইরানের তীর পর্যন্ত পুরো জলপথটিকে তার অঞ্চল হিসাবে দাবি করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে, ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে, ইরাক থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ইরাকি কুর্দি গোষ্ঠীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে, ইরান। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে ইরাক আলজিয়ার্স অ্যাকর্ড-এ স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে স্থির হয়, জলপথের থালওয়েজ (গভীরতম চ্যানেল)-এর কাছাকাছি সোজা সোজা রেখার একটি শ্রেণীকে সরকারী সীমানা ব'লে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে ইরান, ইরাকি কুর্দিদের সমর্থন বন্ধ করে দেয়। [১৭]
১৯৮০ সালে, হুসেন ১৯৭৫ সালের চুক্তি বাতিল করার দাবি করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন এবং ইরান আক্রমণ করেন। যদিও আন্তর্জাতিক আইনে আছে, সমস্ত ক্ষেত্রেই কোনও এক পক্ষ, দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তিই বাতিল করতে পারে না। দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে স্থলভাগে সামরিক আগ্রাসনের মূল জোর থাকে, জলপথ পেরিয়ে এগোনোর উপর এবং সেটিই দুই বাহিনীর মধ্যে বেশিরভাগ সামরিক লড়াইয়ের মঞ্চ। ইরাকের একমাত্র বর্হিগমন পথ ছিল, পারস্য উপসাগর। ফলে তাদের নৌপথগুলি ক্রমাগত ইরানের আক্রমণের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।[১৭]
১৯৮৬ সালে যখন আল-ফাও উপদ্বীপটি ইরানীরা দখল করে নেয়, তখন ইরাকের জাহাজী কাজকর্ম কার্যত বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্যান্য আরব বন্দরগুলিতে, যেমন কুয়েতে সে সবের অভিমুখ পাল্টে দিতে বাধ্য হয়। এমনকি আকাবা, জর্ডন-এর মতো বন্দরের দিকেও তারা পথ পাল্টে যেতে বাধ্য হয়েছিল।