ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত একটি আখ্যানকাব্য। ১৫৯২-৯৩ সালে রচিত এই কাব্যটির উপাখ্যানভাগ গৃহীত হয়েছে ওভিডের মেটামরফোসিস গ্রন্থের একটি পঙ্ক্তি থেকে। কাব্যটি অত্যন্ত জটিল এবং বিচিত্রদৃক। প্রেমের প্রকৃতির পরস্পরবিরোধী দিকগুলি ফুটিয়ে তোলার জন্য মুহুর্মুহু এই কাব্যের সুর ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে।
১৫৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস কাব্যটি স্টেশনার্স’ রেজিস্টারে নথিভুক্ত হয়। সেই বছরেরই শেষ দিকে বইটির একটি কোয়ার্টো সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশক ও মুদ্রক ছিলেন শেকসপিয়রের এক ঘনিষ্ঠ সমসাময়িক স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভন নিবাসী রিচার্ড ফিল্ড। ১৫৯৪ সালে ফিল্ড একটি দ্বিতীয় কোয়ার্টো সংস্করণও প্রকাশ করেন। তারপর গ্রন্থসত্ত্ব তুলে দেন স্টেশনার জন হ্যারিসন ("দ্য এল্ডার")-এর হাতে। উল্লেখ্য, হ্যারিসন ১৮৯৪ সালে দ্য রেপ অফ লুক্রেশি কবিতার প্রথম সংস্করণও প্রকাশ করেছিলেন। ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস কাব্যের পরবর্তী সংস্করণগুলি অক্টেভো ফরম্যাটে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত ১৫৯৫ সালে হ্যারিসন এর তৃতীয় সংস্করণটি (অ১) প্রকাশ করেন। চতুর্থ সংস্করণটি (অ২) প্রকাশিত হয় ১৫৯৬ সালে। হ্যারিসনের দুটি সংস্করণেরই মুদ্রক ছিলেন ফিল্ড। এরপর কাব্যটির গ্রন্থসত্ত্ব চলে যায় উইলিয়াম লিকের হাতে। ১৫৯৯ সালে লিক নিজেই কাব্যটির দুটি সংস্করণ (অ৩, অ৪) প্রকাশ করেন। এছাড়া ১৬০২ সালে কাব্যের চারটি সংস্করণও (অ৫, অ৬, অ৭ ও অ৮) তিনিই প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ১৬১৭ এই কাব্যের গ্রন্থসত্ত্ব চলে যায় উইলিয়াম বারেটের হাতে। এই বছরই তিনি আর একটি সংস্করণ (অ৯) প্রকাশ করেন। ১৬৪০ সালের মধ্যে কাব্যটির আরও পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এইভাবে ৪৭ বছরে ষোলোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল এই কাব্যের। সমসাময়িক যুগে তা ছিল এক বিরাট সাফল্যের নিদর্শন।[১]
অ্যাডোনিস শিকারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এমন সময় ভেনাস তার "স্বেদাক্ত করতল নিজহস্তে বন্দী করলেন" এবং "তাঁকে ঠেলে দিলেন পশ্চাতে, যাতে স্বয়ং মিলিত হতে পারেন" (যৌনসংগমের উদ্দেশ্যে)। এরপর দেখা যায় অ্যাডোনিস "শয্যায় শুয়ে হাঁপাচ্ছেন, নিঃশ্বাস ফেলছেন ভেনাসের মুখে"। ভেনাস তাকে বলছেন, "লীলায় সাহসী হও, আমাদের ক্রীড়া তো কেউ দেখছে না”। এইভাবে অনিচ্ছুক অ্যাডোনিসকে নিজের প্রতি আসক্ত করতে সমর্থ হন ভেনাস। সূত্রপাত হয় তাদের প্রণয়সম্পর্কের। কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই শিকারে একটি দুর্ঘটনায় নিহত হলেন অ্যাডোনিস।
এই কবিতায় শেকসপিয়র বিধৃত করেছেন তার সর্বাপেক্ষা চিত্ররূপময় যৌন উত্তেজনার বর্ণনা।
১৫৯৩ সালে লন্ডন শহরে প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটলে নগর কর্তৃপক্ষ সমস্ত গণনাট্যশালাগুলি বন্ধ করে দেন। ইতোমধ্যে শেকসপিয়র মাত্র ৫-৬টি নাটকই রচনা করেছিলেন। অর্জন করেছিলেন কিছু খ্যাতিও। এবং লিখতে শুরু করেছিলেন সেই লেখাটি যা তিনি "the first heire [sic] of my invention"[২] রূপে প্রকাশ করেন। এটি ছিল তার "মিউজ"-এর "প্রথম আইনসঙ্গত সন্তান"।[৩] রচনাটি তিনি উৎসর্গ করেন সাউদাম্পটনের তৃতীয় আর্ল হেনরি রিওথিসলিকে।
১৫৯৪ সালে ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস কাব্যের উৎসর্গপত্রের প্রতিজ্ঞামতো 'graver labour' হিসেবে শেকসপিয়র লুক্রেশি উৎসর্গ করেন সাউদাম্পটনকে। সাউদাম্পটন এই সময় আর্থিক সংকটাবস্থায় ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত এই সকল শংসার স্বীকৃতিস্বরূপ শেকসপিয়র তার পৃষ্ঠপোষকের কাছ থেকে যথেষ্ট আর্থিক পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কোনো এক সূত্র শেকসপিয়র কিছু পুঁজি উপার্জন করেন যার ফলে তিনি তার থিয়েটার কোম্পানির অভিনয় থেকে লভ্যাংশের এক দ্বাদশাংশের শেয়ার ক্রয় করেন। এর পর দীর্ঘকবিতার বদলে নাট্যরচনা থেকেই তার অর্জিত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।[৪]
১৫৬৭ সালে আর্থার গোল্ডিং ওভিডের মেটামরফোসিস, দশম পুস্তক অনুবাদ করলে ভেনাস ও অ্যাডোনিসের কাহিনি পরিচিতি লাভ করেন। ওভিড বর্ণনা করেছেন, কেমন করে ভেনাস তার প্রথম নশ্বর প্রেমিক রূপে অ্যাডোনিসকে গ্রহণ করেন। তারা ছিলেন দীর্ঘদিনের সঙ্গী। দেবী ভেনাস অ্যাডোনিসের সঙ্গেই শিকার করে বেড়াতেন। তিনি আটলান্টা ও হিপোমেনাসের গল্প বলে অ্যাডোনিসকে সতর্ক করেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন বন্য জন্তুর শিকারে যাওয়া থেকে তাকে নিরস্ত করতে। কিন্তু অ্যাডোনিস তার কথা শোনেননি। শেষে বন্য শূকরের দ্বারা নিহত হন তিনি।
এই মূল আখ্যানটি অবলম্বনে শেকসপিয়র ১১৯৪ পঙ্ক্তির একটি কাব্য রচনা করেন। তার কাব্যের মূল উপজীব্য ছিল অ্যাডোনিস কর্তৃক ভেনাসের প্রেম প্রত্যাখ্যান। আরউইন প্যানোফস্কির মতে, শেকসপিয়র টিটিয়ানের 'ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস' ছবিটির একটি প্রতিচিত্র দেখেছিলেন। এই চিত্রে বিধৃত হয় অ্যাডোনিস কর্তৃক ভেনাসের বাহুবন্ধন প্রত্যাখ্যানের দৃশ্য। কিন্তু শেকসপিয়র ততদিকে তৎপর নায়িকা চিত্রণে তার আগ্রহের কিছু সাক্ষর রেখেছিলেন, যাঁরা অনিচ্ছুক পুরুষদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখতেন (দেখুন: দ্য টু জেন্টলমেন অফ ভেরোনা)।
অন্য উপজীব্যটি ছিল একপ্রকার ‘অ্যারিস্টটলীয়’ ঐক্যের প্রকাশ: সমগ্র আখ্যানের পটভূমি একই; এটি শোক থেকে শোক পর্যন্তই বিধৃত এবং দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রই এখানে সর্বেসর্বা।