মোহিনী

মোহিনী
মোহিতকারী দেবী
A picture of a sculpture of a eight-armed god dancing
আট বাহু সমৃদ্ধ মোহিনী নৃত্যরত হালেবিদুর হয়সালেসোয়ারা মন্দিরে
দেবনাগরীमोहिनी
সংস্কৃত লিপ্যন্তরMohinī (বাংলা: মনোহারিণী)
অন্তর্ভুক্তিবিষ্ণুর, অবতার, দেবী
অস্ত্রমোহিনী অস্ত্র (মনভোলানোর ক্ষমতা), সুদর্শন চক্র
ব্যক্তিগত তথ্য
সঙ্গীশিব আঞ্চলিক: ইরাবান
সন্তানশাস্তা অঞ্চলভেদে: আইয়াপ্পা

মোহিনী (সংস্কৃত: मोहिनी, আইএএসটি: Mohinī) হচ্ছে হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর একমাত্র নারী অবতার। মোহিনীকে প্রলভনসঙ্কুল ও মনোমুগ্ধকর নারী হিসেবে পুরাণে চিত্রায়িত করা হয়েছে যে তার প্রেমিকদেরকে পাগল করে দেয়, এবং কখনও কখনও এর মাধ্যমে তাদেরকে মৃত্যুমুখে নিয়ে যায়। মোহিনীকে হিন্দু পুরাণে মহাভারত নামক মহাকাব্যের মাধ্যমে পরিচয় করানো হয়। মহাভারত অনুসারে বিষ্ণুর একটি রূপ হিসেবে আবির্ভূত হন, এবং অমৃতের (অমর করে এমন একটি রস) পাত্র চুরি করা অসুরদের থেকে অমৃত নিয়ে এসে তিনি দেবতাদের দান করেন, যার ফলে দেবতারা অমরত্ব লাভ করেন।

মোহিনীর কার্য নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে শিবের সাথে মিলন একটি। এই গল্পগুলো দেবতা শাস্তার জন্ম, ভষ্মাসুরের বধের মত বিভিন্ন ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। মোহিনীর প্রধান কার্যপ্রণালী হচ্ছে যাদের সাথে তিনি লড়াই করবেন তাদেরকে ছলনার মাধ্যমে হারানো। সমগ্র ভারতীয় সংস্কৃতি জুড়েই মোহিনীর পূজা করা হয়, তবে পশ্চিম ভারতেই তার পূজা বেশি হয়, যেখানে তাকে শিবের একটি স্থানীয় অবতার খাণ্ডব এর সঙ্গিনী হিসেবে মহালাসা রূপে পূজা করা হয়।

ব্যুৎপত্তি

[সম্পাদনা]

মোহিনী নামটি ক্রিয়া প্রকৃতি মোহ্‌ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ছলনা করা বা মোনমুগ্ধ করা।[][] আক্ষরিক অর্থে একে বিভ্রমের মানবরূপকে বোঝায়। মধ্য ভারতের বৈগা সংস্কৃতিতে মোহিনী শব্দের অর্থ হচ্ছে "কামলালসাপূর্ণ যাদু"।[] এই নামটি "নারীর সৌন্দর্য ও আকর্ষণ এর ভাব" এরও অর্থ প্রকাশ করে।[]

কিংবদন্তি এবং ইতিহাস

[সম্পাদনা]
মোহিনী দেবতাদেরকে (বাম) অমৃত বণ্টন করে দিচ্ছেন, অসুরগণ তা তাকিয়ে দেখছেন

মোহিনী এর মত দেবীর প্রথম সূত্র পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের সমুদ্রমন্থন পর্বে।[] অমৃত হচ্ছে অমরত্বের রস যা ক্ষীরসাগর (দুধের সাগর) এর মন্থনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এই অমৃত লাভ করার জন্য দেবতাঅসুরগণ যুদ্ধ করেন।[] অসুরগণ অমৃত তাদের কাছে রাখার মতলব আঁটেন। বিষ্ণু তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তিনি একজন আকর্ষণীয় কুমারীর আকার ধারণ করেন, এবং অসুরদের সাথে ছলনা করেন যার ফলে অসুরগণ তাকে অমৃত দান করে দেয়। এরপর তিনি দেবতাদেরকে অমৃত বণ্টন করে দেন। এরপর রাহু নামের একজন অসুর একজন দেবতার ছদ্মবেশে কিছু অমৃত পান করতে গেলে, সূর্যদেব এবং চন্দ্রদেব দ্রুত বিষ্ণুকে সেসম্পর্কে অবহিত করেন। অবগত হবার পর বিষ্ণু সুদর্শন চক্র ব্যবহার করে রাহুর শিরশ্ছেদ করেন। কিন্তু গলা পর্যন্ত অমৃত যাবার ফলে রাহুর মস্তক অমর হয়ে যায়।[] আরেকটি বিখ্যাত হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত) বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড অধ্যায়ে সংক্ষেপে মোহিনীর এই গল্প লেখা হয়েছে।[] একই গল্প চার শতকপ পরে লিখিত বিষ্ণু পুরাণেও লেখা হয়।[]

মূল রচনায় মোহিনীকে সরলভাবে বিষ্ণুর আকর্ষণীয় নারী রূপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সংস্করণে মোহিনীকে বিষ্ণু এর মায়া (বিভ্রম) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর মোহিনী শব্দটির অর্থ অনুযায়ী বিষ্ণুর অবতারের নাম মোহিনী দেয়া হয় যার দ্বারা বিষ্ণুর ইচ্ছাকৃত মিথ্যা আবির্ভাবকে বর্ণনা করা হয় (mayam ashito mohinim)।[১০] মোহিনীর কিংবদন্তি জনপ্রিয় হয়ে গেলে এটি বারবার বলা হয়, এর পুনরাবৃত্তি হয় এবং আরও অনেক গ্রন্থে এর গল্প বিস্তৃত হয়। মোহিনী-বিষ্ণু এর গল্পগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের ভক্তিমূলক চক্রগুলোতেও বৃধি পায়।[১১][১২] মহাভারতে যে গল্পটি উল্লিখিত হয়েছিল একই গল্প ১০ম শতকের ভগবত পুরাণেও উঠে আসে।[১৩][১৪][১৫] এখানে মোহিনী বিষ্ণুর একটি আনুষ্ঠানিক অবতারে পরিণত হন।[১৬]

এই কিংবদন্তিটি পদ্মপুরাণেব্রহ্মাণ্ডপুরাণে আবার উঠে আসে।[১৬] ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে বিষ্ণু-মোহিনী দেবী মহেশ্বরীর ধ্যান করেন, এবং কূটকৌশলী অসুরদের সাথে ছলনা করার জন্য মোহিনী আকারের বর লাভ করেন।[১২]

দানব বধকারিনী

[সম্পাদনা]
রাজা রবি বর্মা এর আঁকা ভষ্মাসুর-মোহিনী। এখানে ভষ্মাসুর (বাম) মোহিনীর (মাঝখানে) নাচ দেখে তার হাত নিজের মাথায় রাখতে যাচ্ছে, এবং শিব (ডানে) গাছের পেছন থেকে এটা দেখছেন।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে মোহিনীর দানবদের ধ্বংস করার কথা লেখা আছে। বিষ্ণু পুরাণে মোহিনী ভষ্মাসুরকে ("ভষ্ম" এর অর্থ "ছাই") পরাজিত করে।[১৭] ভষ্মাসুর শিবের কঠোর তপস্যা করেন, যার কারণে শিব তাকে একটি বর দান করেন। বরটি ছিল, ভষ্মাসুর যার মাথাই স্পর্শ করবে সেই ছাই হয়ে যাবে। ভষ্মাসুর শিবের উপরেই তার এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়।শিব একই স্থানে বসে থাকেন কিন্তু ব্রহ্মা দ্বারা সময়চক্র দাড় করানোর ফলে অনেক চেষ্টা করেও শিবের নাগাল পাননি ভষ্মাসুর। বিষ্ণু এই অহংকারী ভক্তের অসৌজন্যমূলক ঘটনাটির সাক্ষী হন। তিনি মোহিনী রূপ ধারণ করেন এবং ভষ্মাসুরকে তার নিজের প্রতি আকৃষ্ট করেন। ভষ্মাসুর মোহিনীর প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হন যে তিনি মোহিনীকে বিবাহ করবার জন্য অনুরোধ করেন। মোহিনী রাজি হন, কিন্তু মোহিনী তার জন্য ভষ্মাসুরকে একটি শর্ত দান করেন। তিনি বলেন ভষ্মাসুরকে তার নাচের মুদ্রা অনুসরণ করে নাচতে হবে। ভষ্মাসুর রাজি হন, এবং নৃত্যের একটি পর্যায়ে মোহিনী তার হাত নিজের মাথায় রাখলে ভষ্মাসুরও মোহিনীর নকল করে নিজের মাথায় তার হাত রাখেন। এর ফলে ভষ্মাসুর নিজেই ছাইয়ে পরিণত হন এবং ধ্বংস হন।[১৮] ভষ্মাসুরের এই কিংবদন্তিটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সাতারা দিওয়ালা দেবি পুভাতা-তে কিছুটা ভিন্নতার সাথে পুনরুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে, বিষ্ণু নারী সেজে (এখানে "মোহিনী" নামটি নেয়া হয়নি) নিয়ে ভষ্মাসুরকে মুগ্ধ করে। নারী বিষ্ণু ভষ্মাসুরকে মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করতে বলেন যে তিনি কখনই তাকে ছেড়ে যাবেন না, যেহেতু মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করাই প্রতিজ্ঞা করার সাধারণ চর্চা। এরফলে মাথায় হাত রাখায় ভষ্মাসুর ছাইয়ে পরিণত হন।[১৯]

একই কিংবদন্তি অয়াপ্পান এর জন্মের সাথেও সম্পর্কিত। দানবী সুর্পনক তার তপস্যার সাহায্যে যে কাউকে ছাইয়ে পরিণত করার ক্ষমতা অর্জন করেন। এই গল্পটিও ভষ্মাসুরের গল্পের বৌদ্ধ সংস্করণের মত, যেখানে মোহিনী সুর্পনককে তার মাথায় হাত রাখতে বাধ্য করে, এবং তার ফলে সুর্পনক পুড়ে ছাই হয়ে যান।[২০]

রামায়ণের থাই (থাইল্যান্ড) সংস্করণ রামাকিয়েন -এ দানব নণ্টক মোহিনী-বিষ্ণুর দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হন এবং এর দ্বারা মোহিনী-বিষ্ণু নন্টককে হত্যা করেন। নণ্টক শিবের দ্বারা প্রাপ্ত একটি স্বর্গীয় অস্ত্রের অপব্যবহার করেছিল। চতুর্ভূজ (চারটি হাত বিশিষ্ট) মোহিনী-বিষ্ণু নণ্টককে মন্ত্রমুগ্ধ করেন এবং এরপর তাকে আক্রমণ করেন। শেষে দানব নণ্টক এই প্রতারণার কারণে দোষী সাব্যস্ত করে বলেন, বিষ্ণু প্রথমে তাকে কামপ্রলোভনে বশবর্তী করে আক্রমণ করেছেন। বিষ্ণু ঘোষণা করেন যে, পরজন্ম নণ্টক দশানন (দশটি মাথা) রাবণ হয়ে জন্মাবেন এবং বিষ্ণু তার সামনে মরণশীল রাম হয়ে সামনে আসবেন। এরপর বিষ্ণু মরণশীল রাম হয়ে এই রাবণের সাথে যুদ্ধ করবেন এবং তাকে পরাজিত করবেন।[২১]

গণেশ পুরাণে (৯০০ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ) একটি স্বল্পপরিচিত গল্প রয়েছে যেখানে জ্ঞানী অসুররাজ বীরোচন সূর্যদেবের দ্বারা একটি জাদুর মুকুট পুরস্কার লাভ করেন। এই মুকুটটি তাকে যেকোন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এরপর বিষ্ণু মোহিনী রূপে বীরোচনকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন এবং সেই মুকুটতি চুরি করেন। এরপর সেই দানব অরক্ষিত হয়ে যান এবং বিষ্ণু তাকে বধ করেন।[২২]

দানব আরককে নিয়ে মোহিনীর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি গল্প রয়েছে যা বিষ্ণু নয়, বরং কৃষ্ণের (বিষ্ণুর একজন অবতার) সাথে সম্পর্কিত। দানব আরক কখনও কোন নারীর দিকে তাকান নি, এর ফলে তিনি চরম শুদ্ধতার কারণে অপরাজেয় হয়ে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণ সুন্দরী মোহিনী এর রূপ গ্রহণ করেন এবং আরককে বিয়াহ করেন। বিবাহের তিন দিন পর আরকের শুদ্ধতার বন্ধন ভেঙ্গে যায়, এবং এর ফলে কৃষ্ণ আরককে যুদ্ধে পরাজিত করেন।[২৩] রূপান্তরিত লিঙ্গ হিজড়ারা কৃষ্ণ-মোহিনীকে রূপান্তরকামী দেবতা হিসেবে পূজা করে থাকেন।[২৪]

শিবের সাথে সম্পর্ক

[সম্পাদনা]
মত্তনচেরি প্রাসাদের একটি দেয়ালচিত্রে দেখা যাচ্ছে শিব ও মোহিনী একে অপরকে আলিঙ্গন করছেন, এদিকে পার্বতি একটি সাদা ষাঁড়ের উপর বসে তাদেরকে দেখছেন এবং এর প্রতি বিরাগ প্রকাশ করছেন।[২৫]

দক্ষিণ ভারতের ধর্মগ্রন্থগুলোতে মোহিনী ও শিব নিয়ে গল্পগুলো জনপ্রিয়।[২৬] ভাগবত পুরাণ এর দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ অনুসারে, বিষ্ণু তার নারী রূপ নিয়ে অসুরদের সাথে ছলনা করার পর শিব মোহিনীকে দেখেন।[২৬] তিনি মোহিনীকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। পুরাণের গল্পের এই সংস্করণে শিব কামে পরাভূত হন। শিবের বীর্য মাটিতে পড়ে সোনা ও রূপার আকরিক তৈরি করে। এরপর বিষ্ণু বলেন, আবেগকে জয় করা কঠিন, শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপের অর্ধেক হবে এই মায়া। এরপর শিব বিষ্ণুর গুণগান করেন।[১৩][২৬]

এক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে শিব পার্বতি ছাড়া অন্য কারও সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হন নি। উমা নিজেই বিষ্ণুর একটি প্রকাশ। দুর্গা (উমা) এর কিংবদন্তি অনুসারে ত্রিদেব (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব) এর দ্বারা দুর্গার সৃষ্টি। কিছু কিছু গ্রন্থে উমাকে বিষ্ণুর নারী রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মনে করা হয়, বিষ্ণু শ্রী ললিত মহাত্রিপুরসুন্দরীর (তিন জগতের সবচেয়ে সুন্দরী নারী) ধ্যান করেন, যিনি "বিষ্ণু এরই একটি রূপ ছিলেন"। মোহিনী রুপ লাভের জন্য তিনি এই ধ্যান করেন। আবার একথারও উল্লেখ আছে যে, ত্রিপুরসুন্দরী পার্বতী ছাড়া আর কেউ নন, মোহিনী ত্রিপুরসুন্দরীরই একটি আকারে নিজেকে রূপান্তরিত করেন যেখানে পার্বতী হলেন এই ত্রিপুরসুন্দরী।

একটি দক্ষিণ ভারতীয় শাক্ত ধর্মগ্রন্থ ত্রিপুরারহস্যতে এই গল্পটি পুনরায় বলা হয়। সেখানে এই দেবীকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। শিব বিষ্ণুর মোহিনী রূপ পুনরায় দেখতে চাইলে বিষ্ণু যোগী শিবের দ্বারা কামদেবের মত ভষ্ম হয়ে যাবার ভয় পান। তাই বিষ্ণু দেবী ত্রিপুরসুন্দরীরের কাছে প্রার্থনা করেন। ত্রিপুরা তার অর্ধেক রূপ বিষ্ণুকে দান করেন, যার ফলে মোহিনী রূপের জন্ম হয়। এরপর শিব মোহিনীকে স্পর্শ করলে তার বীর্যপাত হয়। এর অর্থ এই যে, এই পর্যন্ত তপস্যার দ্বারা শিব যতটুকু পুণ্য অর্জন করেছিলেন তা তিনি হারান।[২৭]

ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে দেবর্ষি নারদ শিবকে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ সম্পর্কে বলেন যার দ্বারা তিনি অসুরদের সাথে ছলনা করেছেন। শিব এই কথা অবিশ্বাস করেন। শিব এবং তার স্ত্রী পার্বতী বিষ্ণুলোকে গমন করেন। শিব বিষ্ণুকে পুনরায় তার মোহিনী রূপ গ্রহণ করতে বলেন, যাতে শিব নিজে বিষ্ণুর এই রূপান্তরকে দেখতে পারেন। বিষ্ণু হাসেন, এবং তিনি পুনরায় ধ্যান করে মনোমুগ্ধকর মোহিনীরূপ লাভ করেন। কামে অবর্তীর্ণ হয়ে শিব মোহিনীর দিকে ধ্বাবিত হন, এটা দেখে লজ্জায় ও ঈর্ষায় পার্বতী তার মাথা নিচু করেন। শিব মোহিনীর হাত ধরেন এবং তাকে জড়িয়ে ধরেন, কিন্তু মোহিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নেন এবং আরও দূরে সরে যান। শেষ পর্যন্ত শিব মোহিনীর হাত ধরেন, এবং তাদের মধ্যে "হিংস্র যৌন সঙ্গম" এর ফলে শিবের বীর্য মাটিতে পতিত হয় এবং দেবতা মহা-শাস্তা এর জন্ম হয়। মোহিনী অদৃশ্য হয়ে যান, এবং শিব পার্বতীকে নিয়ে নিজ বাসভূম কৈলাসে ফিরে আসেন।[২৮][২৯] এই ঘটনার অনেক রকম ব্যাখ্যা দেয়া হয়। অনেকে একে "লীলা" হিসেবে দেখেন এবং বলেন যে মহিষাসুরীকে বধ করার নিমিত্তে এই প্রক্রিয়ায় শাস্তা এর জন্ম দেয়া হয়।

শাস্তাকে প্রাথমিকভাবে দুজন আঞ্চলিক দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়: কেরল এর অয়াপ্পা এবং তামিল দেবতা আইয়ানার। চিরায়ত হিন্দু দেবতা স্কন্দহনুমান হিসেবেও তাকে চিহ্নিত করা হয়।[৩০] অয়াপ্পার জন্ম সম্পর্কিত পরবর্তী গল্পগুলো অনুসারে, শিব মোহিনীকে গর্ভবতী করেন, এবং এর ফলে মোহিনী অয়াপ্পার জন্ম দেম। অন্য একটি সংস্করণ অনুসারে অয়াপ্পার জন্ম স্বাভাবিক জীববিজ্ঞানগত প্রক্রিয়ায় হয়নি, বরং মোহিনীর সাথে আলিঙ্গন করার সময় শিবের বীর্যপাত হলে সেই বীর্য থেকে অয়াপ্পার জন্ম।[৩১] অয়াপ্পাকে হরিহরপুত্র বলা হয়, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে হরি (বিষ্ণু) ও হরের (শিব) পুত্র। একই সাথে এও বলা হয় যে অয়াপ্পা একজন মহান বীর হিসেবে বড় হন।[৩২] আরেকটি গল্প অনুসারে সুপর্ণকের ধ্বংস হবার পর শিব মোহিনীকে দেখতে চান এবং মোহিনীকে দেখে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। এর ফলে শিব ও মোহিনীর মধ্যে মিলন হয় এবং এর ফলে অয়াপ্পার জন্ম হয়।[২০]

তামিল ধর্মগ্রন্থ কন্দ পুরাণমে শাস্তার জন্ম নিয়ে বলা হয়েছে যেখানে তাকে আইয়ানার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইয়ানারের জন্মবৃত্তান্তের পূর্বে এই গ্রন্থে বলা হয়, বিষ্ণু হচ্ছে শিবের শক্তি (স্ত্রী ও শক্তি বা ক্ষমতা) পার্বতির পুরুষাকার। এই গল্পটি শুরু হয় শিবের অনুরোধে বিষ্ণুর মোহিনীরূপ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে, যা বিষ্ণু অমৃত বণ্টনের জন্য গ্রহণ করেছিলেন। শিব মোহিনীর প্রেমে পড়ে যায় এবং তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতে চান। মোহিনী-বিষ্ণু এতে সম্মত হন না, এবং তিনি বলেন যে দুজন সমলিঙ্গের মিলনে কোন পরিণতি নেই। তখন শিব মোহিনী-বিষ্ণুকে জানান যে বিষ্ণু শিবেরই শক্তির একটি রূপ। এতে বিষ্ণু সঙ্গমে সম্মত হন এবং বিষ্ণু ও শিবের মিলনের ফলে লাল চুল ও কাল বর্ণের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যার নাম হয় হরিহরপুত্র। এছাড়াও এই পুত্রসন্তান শাস্ত এবং আইয়ানার নামেও পরিচিত হয়।[৩৩][৩৪]

শিব "দোলনায় মোহিনীকে" দেখেন (রাজা রবি বর্মার ১৮৯৪ সালে আঁকা চিত্রকর্ম)। চিত্রে মোহিনীর শাড়ির ভেতর থেকে তার ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখা যাচ্ছে। এর দ্বারা চিত্রকর মোহিনীর প্রলুব্ধকর প্রকৃতি নির্দেশ করছেন।

অগ্নি পুরাণ অনুসারে, অভিভূত শিব মোহিনীকে অনুসরণ করেন, এবং তার বীর্য মাটিতে পতিত হয়ে শিবলিঙ্গ তৈরি করে, যা শিবের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। তার এই বীর্য হনুমানের জন্ম দেয়, যিনি রামায়ণে বিষ্ণুর অবতার রামকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেন।[৩৫] শিব পুরাণ অনুসারে, শিব মোহিনীকে এক ঝলক দেখে তার বীর্য ছুড়ে দেন। এই বীর্য অঞ্জনির কানে পতিত হয়, আর তার ফলে হনুমানের জন্ম হয়। এই হনুমান হচ্ছেন শিবেরই অবতার।[৩৩] পরবর্তীতে প্রণিত রামায়ণের শ্যামদেশীয় (থাইল্যান্ড) ও মালয় অঞ্চলের (মালয়েশিয়া) সংস্করণ অনুসারে,[৩৬] হনুমান শিবের বীর্য থেকে জন্ম হলেও তাকে শিব ও বিষ্ণু উভয়েরই যৌথ পুত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[১৭]

ভষ্মাসুরের গল্পের বৌদ্ধ সংস্করণ অনুসারে শিব (ঈশ্বর) দোলনায় অধিষ্ঠিত নারী-বিষ্ণুকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। নারী-বিষ্ণু শিবকে বলেন তাকে তার ঘরে তুলতে তার স্ত্রী উমায়াঙ্গনার অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। শিব উমায়াঙ্গনার অনুমতি নিয়ে আসার পর দেখতে পান নারী-বিষ্ণু গর্ভবতি হয়েছেন। এরপর নারী-বিষ্ণু শিবকে আবার তার স্ত্রী উমায়াঙ্গনার কাছে অনুমতি নিয়ে আসতে বলেন যে তিনি একজন গর্ভবতী নারীকে তার বাসায় নিয়ে আসতে পারবেন কিনা। শিব এই অনুমতি নিয়ে আসার পর দেখেন নারী-বিষ্ণুর একটি সন্তান হয়েছে, এবং সেই সাথে তিনি আবার গর্ভবতী হয়েছেন। এবারে নারী-বিষ্ণু শিবকে তার স্ত্রীর কাছে অনুমতি নিয়ে আসতে বলেন যে, তিনি একজন সন্তান সহ গর্ভবতী নারীকে ঘরে নিয়ে আসতে পারবেন কিনা। এভাবে আরও ছয়বার অনুমতি নিয়ে আসবার পর শিব তার সাথে এই অলৌকিক নারীকে দেখাবার জন্য তার স্ত্রী উমায়াঙ্গনাকে সাথে নিয়ে আসেন। এরপর বিষ্ণু তার পুরুষ রূপ গ্রহণ করেন। উমায়াঙ্গনা এই ছয়জন শিশুপুত্রকে আলিঙ্গন করে তাদেরকে একজন ষড়ানন স্কন্দে পরিণত করেন, যেখানে জ্যেষ্ঠ পুত্র ("আইয়ানায়ক") পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ছিলেন এবং অন্যদের কেবল মস্তক ছিল।[১৯] আইয়ানায়ক আইয়ানার নামে পরিচিত হন।

মোহিনী ঋষিদেরকে প্রলুব্ধ করছেন। মূর্তিতে মোহিনীকে নগ্ন ও মাল্য ও অলঙ্কারে সজ্জিত দেখানো হয়েছে। তিনি হাতে একটি পদ্মফুল ও একটি তোতা পাখি ধরে আছেন, ও একটি লাঠিতে হেলান দিয়ে আছেন। ঋষিরা তার কাছে প্রার্থনা করছেন, এবং তাদের পুরুষাঙ্গ মোহিনীর দিকে উত্থিত হয়ে আছে।

এই প্রসঙ্গে "পুরুষ সমকামী ঘটনার পরিষ্কার ঘটনার" বিরল কাহিনীও পাওয়া গেছে একটি তেলুগু ধর্মগ্রন্থে। এখানে শিব মোহিনী-বিষ্ণুর সাথে সঙ্গমরত ছিলেন। মোহিনী-বিষ্ণু তার পুরুষ রূপে ফিরে আসবার পরও এই সঙ্গম চলতে থাকে।[২৪]

মোহিনী শিবের কিংবদন্তি স্কন্দপুরাণেও একটি স্বল্প ভূমিকা পালন করেন। এখানে তিনি অহংকারী ঋষিদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য শিবের সাথে যোগ দেন। ঋষিদের একটি দল বনে অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করছিলেন, এবং তারা নিজেদেরকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেন। তাদেরকে নত করবার জন্য শিব একজন সুদর্শন ও আকর্ষণীয় তরুণ ভিখারির ছদ্মবেশ ধারণ করেন (ভিক্ষাতন) এবং বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে তার স্ত্রী এর বেশ ধারণ করেন। ঋষিগণ মোহিনীর রূপে বিমুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে যান, আর ঋষিপত্নীগণ শিবের ভিক্ষাতন রূপের প্রেমে পড়ে তাকে বন্যভাবে ধাওয়া করে। তারা তাদের সম্বিত ফিরে পেলে, একটি কালোযাদুবিদ্যার বলে একটি সাপ, একটি সিংহ, একটি হাতি (বা বাঘ) এবং একটি বামনকে তৈরি করে শিবের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। শিব এদেরকে পরাস্ত করেন ও তারপর তিনি নটরাজ রূপ ধারণ করে নাচতে শুরু করেন।[৩৭] তামিল কভিল পুরাণাম ও কান্ধা পুরাণামে এই কিংবন্দন্তীটি কিছু পরিবর্তন এর সাথে পুনরায় বলা হয়েছে।[২৭][৩৩][৩৪] এই কিংবদন্তিটি স্থল পুরাণেও বলা হয়েছে যা চিদাম্বরম মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে এই মন্দিরটি শিব-নটরাজের প্রতি উৎসর্গীকৃত।[৩৮]

লিঙ্গ পুরাণে আরেকটি কিংবদন্তি পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, প্রেমে বিহ্বল মোহিনী ও শিবের আলিঙ্গনের ফলে তারা একটি শরীরে পরিণত হন। এই অবস্থায় মোহিনী তার বিষ্ণুরূপে ফিরে আসেন, এবং এরফলে হরিহর নামে একটি যুগ্ম দেবতার আবির্ভাব ঘটে, যার ডান অংশ শিবের এবং বাম অংশ বিষ্ণুর পুরুষ রূপের।[৩৯][৪০] কালুগুমালাই এর নিকটে শংকরন্যায়িনারকোভিল মন্দিরে হরিহর (শঙ্কর-নারায়ণ) এর বিরল মূর্তিশিল্পগুলোর মধ্যে একটি আছে। এই দেবতাটি শিব ও পার্বতীর যুগ্ম আকার অর্ধনারী এর সদৃশ, যেখানে অর্ধনারীর ডান দিকে পুরুষ শিব ও বাম দিকে নারী পার্বতী। এই মূর্তির নারী অংশটি মোহিনীকে নির্দেশ করে, এবং সম্পূর্ণভাবে এটি শিব ও মোহিনীর মিলনকে চিহ্নিত করে।[৪১] শিবের উপর শাক্তধর্মের প্রভাবের ফলে হরিহরের মত যুগ্ম দেবতার ধারণা তৈরি হয়ে থাকতে পারে, যেখানে বিষ্ণুকে শিবের সঙ্গী বা মোহিনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[৪২] কাণ্ড পুরাণের ব্যাখ্যার মত, শৈব সাধু আপ্পারও বিষ্ণুকে পার্বতী (উমা) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যিনি শিবের নারী প্রতিরূপ।[৪৩]

আরাবনিগণ, দেবতা আরাবনের রূপান্তরিত লিঙ্গের কনে। তারা মোহিনী-কৃষ্ণের ভূমিকা পালন করছে এবং আরাবনের মৃত্যু উপলক্ষে বিপাল করছে।

অন্যান্য কিংবদন্তিসমূহ

[সম্পাদনা]

মহাভারতের নায়ক আরাবনকে (তামিল দেবতা কুত্তান্তাভারে পরিণত হন) নিয়ে আরেকটি লোককথা প্রচলিত আছে যিনি আত্মোৎসর্গের পূর্বে মোহিনীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আরাবন পাণ্ডবদের (আরাবনের পিতা ও পিতৃব্যগণ) বিজয় নিশ্চিত করতে যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মোৎসর্গের ("কালাপ্পালি") জন্য রাজি হন। দেবী কালীর কাছে আত্মোৎসর্গের পূর্বে আরাবন পাণ্ডবদের পথপ্রদর্শক কৃষ্ণের কাছে তিনটি বর প্রার্থনা করেন। এর মধ্যে তৃতীয় বরটি হচ্ছে আত্মোৎসর্গের পূর্বে আরাবন বিবাহ করতে চান, কেননা বিবাহিতরাই অগ্নিসৎকার ও অন্তেষ্টিক্রিয়ার অর্ঘের অধিকার পান, অবিবাহিতদের সমাধিস্থ করা হয়। যাইহোক, এই তৃতীয় বরের ব্যাপারটি কেবল লোক-ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, কোন ধর্মগ্রন্থে এটি পাওয়া যায় না। কুত্তান্তাভার ধর্মবিশ্বাস পুরাণ অনুযায়ী, আরাবনের ইচ্ছাপুরণের জন্য কৃষ্ণ মোহিনীতে পরিণত হন, আরাবনকে বিবাহ করেন, এবং তার সাথে রাত্রিযাপন করেন। এরপর আরাবনের আত্মোৎসর্গের পর মোহিনী বিলাপ করেন, তার শাঁখা ভেঙ্গে ফেলেন, বুক চাপড়ান ও বিবাহের অলঙ্কার পরিত্যাগ করেন। এরপর মোহিনী কৃষ্ণের আসল রূপে ফিরে যান।[৪৪] আরাবন ও কৃষ্ণের নারী রূপ মোহিনীর বিবাহ, আরাবনের আত্মোৎসর্গের কারণে মোহিনী-কৃষ্ণের বৈধব্যই কুভাগামে তামিল মাস চিত্তিরাই (এপ্রিল-মে) এর আঠারো দিনব্যাপী বাৎসরিক উৎসবের প্রধান বিষয়বস্তু। এই বৈবাহিক অনুষ্ঠানটি হিজড়াগণ পুনরায় সম্পাদিত করেন, যারা মোহিনী-কৃষ্ণের ভূমিকা পালন করেন।[৪৫]

সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা

[সম্পাদনা]
বেলুরুতে মোহিনী

পুরাণবিদ পট্টনায়িকের মতে, মোহিনী বিষ্ণুর কোন লৈঙ্গিক রূপান্তর নয়, বরং এটি ভষ্মাসুরকে হত্যা প্রতারিত করার জন্য কেবলই এক প্রকার ছদ্মবেশ। মোহিনী কেবলই বিষ্ণুর মায়া[২১]

যেসব গল্পে শিব মোহিনীর সত্যিকারের প্রকৃতি জানতেন সেগুলোকে "যৌন আকর্ষনে লিঙ্গের তারল্যকে নির্দেশ করছে"।[৪৬] পট্টনায়িক লেখেন, পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণ শিব-মোহিনীর মিলনকে সমকামিতা হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু পরম্পরাগত হিন্দুগণ এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নন।[৪৭] তিনি এও লেখেন, যারা কেবল সমপ্রেমেই মনোযোগ দিচ্ছেন তারা এখানকার গভীর অধিবিদ্যীয় তাৎপর্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। সেটা হল, মোহিনীর নারীত্ব বাস্তবতার বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে।, এবং মোহিনীর প্রলুব্ধকরণ ছিল তপস্বী শিবকে পার্থিব বিষয়াবলির প্রতি আগ্রহী করার একটি প্রয়াস। কেবল বিষ্ণুরই শিবকে মোহিত করার ক্ষমতা ছিল। একটি অসুর শিবকে মোহিত ও আহত করবার চেষ্টা করে নিহত হয়েছিল।[২৫]

আরেকটি ব্যাখ্যা অনুসারে, মোহিনীর গল্প নির্দেশ করছে যে বিষ্ণুর মায়া অতিপ্রাকৃত সত্তাকেও অন্ধ করে দিতে পারে। মোহিনী হচ্ছে "মায়ার মানবায়ন যা সকল সত্তাকে জন্ম-মৃত্যুর বাঁধায় বেঁধে রাখে এবং জীবনের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়।"[] মোহিনীর কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, তার অস্তিত্ব কেবল অস্থায়ী মায়া হিসেবেই। মায়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বিষ্ণু পুনরায় সেই মায়াকে ফিরিয়ে নেন।[৩০]

মোহিনী-বিষ্ণু ও শিবের মিলনের কিংবদন্তি হিন্দুধর্মের এই দুই মহাজাগতিক পিতৃতান্ত্রিকের থেকে প্রসূত সন্তানের অভিলাষ থেকেও লিখিত হতে পারে।[৪৮]

ব্রাহ্মোৎসবম এর পঞ্চম দিনে বেঙ্কটেশ্বরকে মোহিনীরূপে সাজানো হয়, এবং মহা মিছিলে তাকে যাত্রা করানো হয়।[৪৯]

গোয়াতে, মোহিনী মহালাসা, মহালাস নারায়নী নামে পূজিত হন। তিনি গৌড় স্বারস্বত ব্রাহ্মণ,[৫০] কারহাদ ব্রাহ্মণ, দৈবজ্ঞ এবং ভান্ডারী সহ পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের অনেক হিন্দু ঘরে কুলদেবী (পরিবারের দেবী) হিসেবে পূজিত হন। প্রধান মহালাসা নারায়ণী মন্দির গোয়ার মারদোলে অবস্থিত। যদিও তার মন্দির কর্ণাটক, কেরালা, মহারাষ্ট্র, এবং গুজরাটেও অবস্থিত।[৫১] চারহাত বিশিষ্ট মহালাশার একহাতে ত্রিশুল, এক হাতে তলোয়ার, একহাতে ছিন্ন মস্তক এবং এক হাতে পানপাত্র। তিনি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা এক অসুরের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, তার হাতে থাকা ছিন্ন মস্তক থেকে বাঘ অথবা সিংহ রক্তপান করছে। দক্ষিণ ক্যানারা এবং গোয়ার বৈষ্ণব এবং গোদ সরস্বত ব্রাক্ষ্মণ তাকে মোহিনী অথবা নারায়ণী এবং রাহু হন্তারক হিসেবে পূজা করেন। বিষ্ণু পুরানে রাহু হত্যার বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[৫২]

শিবের স্থানীয় অবতার খাণ্ডবের সঙ্গী মহালাসকে মলাসাও বলা হয়, তার মন্দির নেভাসাতে মোহিনীরাজ মন্দির হিসেবে অবস্থিত। তিনি সে মন্দিরে চার হাত বিশিষ্ট দেবী হিসেবে পূজিত হন। প্রায়সই মহলাসা দুই বাহু বিশিষ্ট দেবী হিসেবে খাণ্ডব দেবের সঙ্গী হিসেবে ঘোড়ায় করে যাচ্ছেন বা শিবের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, এরুপেও চিত্রায়িত হন। [৫৩]

১১ শতকে রাজা কর্তৃক মাটির নিচে পুতে ফেলা জগন্মোহিনী-কেসব স্বামী মন্দির র‍্যালীতে আবিষ্কৃত হয়। এই মন্দিরের কেন্দ্রীয় বিগ্রহের সম্মুখভাগ বিষ্ণু দেবতার প্রতিনিধিত্ব করলেও পিছনের অংশ নারীর শরীর ও কেশবিন্যাস সমৃদ্ধ জগন্মোহিনী (তিনি; যে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করে) বা মোহিনীকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্থল পুরান মতে শিব মোহিনীকে তাড়া করার পর, মোহিনীর চুল থেকে ফুল র‍্যালিতে এসে পরে।[৫৪]

প্রথা এবং সংস্কৃতি

[সম্পাদনা]
ভষ্মাসুর এবং মোহিনীকে বর্ণনা করা হচ্ছে ইয়াকসাগায়ানায়

দক্ষিণ ভারতের নাট্যমঞ্চে মোহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পের বর্ণায়নে। ইয়াকাসাগানাকথাকলিতে মোহিনীকে বর্ণনা করা হয়। কেরালায় মোহিনীর পুত্র আইয়াপ্পা জনপ্রিয় এবং সেখানে মোহিনী নৃত্য নাচের একটি বিশেষ ধরন হিসেবে স্বীকৃত।[৫৫] দেবীর নামে নামাঙ্কিত এই নৃত্য শুধুমাত্র নারীদের জন্য এবং কামমূলক নাচের একটি আদর্শ উদাহরণ। যদিও কোথা থেকে এই নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে তা অজানা তবে ১৮৫০ সালে এই নৃত্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কিন্তু এই নৃত্য দর্শকদের কাছে টানার জন্য নারীকে ছোট করা হচ্ছে এই মর্মে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এই নাচের নৃত্যশৈলীতে পরিবর্তন আনার পর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।[][৫৫]

আধুনিক কত্থক নৃত্যেও মোহিনীকে বর্ণনা করা হয়।[] চাম্বা জেলার সাহো এলাকায়, হিমাচল প্রদেশে, মোহিনী ভষ্মাসুরের গল্প বলা হয়। এটি নৃত্য চন্দ্রশেখর মন্দিরের পাশে বৈশাখে সাহো মেলায় আয়োজন করা হয় [৫৬]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Pattanaik (2001), p. 70
  2. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০২০ তারিখে Monier Williams, Sanskrit-English Dictionary. (1899).
  3. Goudriaan p. 44
  4. Reginald Massey (২০০৪-০১-০১)। India's dances: their history, technique, and repertoire। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 131–2, 152। আইএসবিএন 978-81-7017-434-9 
  5. Goudriaan, p. 44, Adi Parva (chapter 17, stanzas 38–40)
  6. Mahabharata, Adi Parva, Astika Parva, Section 18.
  7. Mahabharata, Adi Parva, Section 19.
  8. Robert P. Goldman (২০০৭)। The Ramayana of Valmiki Balakanda 'An Epic of Ancient India। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 366। আইএসবিএন 978-81-208-3162-9 
  9. Vishnu Purana, Book 1, Chap. 9.
  10. Goudriaan p. 41
  11. Goudriaan p. 42
  12. Doniger (1999) p. 263
  13. Jarow, Rick (মার্চ ২০০৩)। Tales for the dying: the death narrative of the Bhāgavata-Purāṇa। SUNY Press। পৃষ্ঠা 78–80। আইএসবিএন 978-0-7914-5609-5 
  14. Pattanaik (2001), p. 65
  15. Anand Aadhar translation of Bhagavata Purana, Canto 8, chapter 9
  16. Daniélou, Alain (১৯৯১-১২-০১)। The myths and gods of India। Inner Traditions / Bear & Company। পৃষ্ঠা 165, 186–87। আইএসবিএন 978-0-89281-354-4 
  17. Pattanaik, Devdutt (২০০৬-০১-০১)। Shiva to Shankara: decoding the phallic symbol। Indus Source। পৃষ্ঠা 125, 129। আইএসবিএন 978-81-88569-04-5 
  18. Pattanaik (2001), pp. 66–67
  19. John Clifford Holt (২০০৮-০১-০১)। The Buddhist Visnu : 'Religious Transformation, Politics, and Culture। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 146–48। আইএসবিএন 978-81-208-3269-5 
  20. Smith, B.L., p. 5, Religion and Legitimation of Power in South Asia [২][স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  21. Pattanaik (2001), p. 67
  22. Pattanaik (2001), pp. 70–71
  23. Pattanaik (2001), p. 83
  24. Doniger (1999) p. 265
  25. Pattanaik (2001), p. 73
  26. Goudriaan pp. 42–43
  27. Goudriaan p. 43
  28. Doniger (1999) pp. 263–65
  29. Vanita & Kidwai (2001), p. 69
  30. Doniger (1999) p. 264
  31. Pattanaik (2001), p. 76
  32. Vanita & Kidwai (2001), p. 94
  33. Daniélou, Alain (১৯৯২)। Gods of love and ecstasy: the traditions of Shiva and Dionysus। Inner Traditions / Bear & Company। পৃষ্ঠা 68–70। আইএসবিএন 978-0-89281-374-2  (originally published in French in 1979 and first translated into English in 1984
  34. Dr.akila sivaraman (২০০৬)। sri kandha puranam (english)। GIRI Trading Agency Private। পৃষ্ঠা 170–2, 366–7। আইএসবিএন 978-81-7950-397-3 
  35. Pattanaik (2001), p. 74
  36. Kodaganallur Ramaswami Srinivasa Iyengar। Asian variations in RamayanaSahitya Akademi। পৃষ্ঠা 268। 
  37. Pattanaik (2001), p. 71
  38. Swami Parmeshwaranand pp. 150–51
  39. Patricia Turner, Charles Russell Coulter (২০০১)। Dictionary of ancient deities। Oxford University Press US.। পৃষ্ঠা 204, 327, 498। আইএসবিএন 978-0-19-514504-5 
  40. Swami P. Anand, Swami Parmeshwaranand p. 287
  41. Monika Böck, Aparna Rao (২০০০)। Culture, creation, and procreation: concepts of kinship in South Asian practice। Berghahn Books.। পৃষ্ঠা 331–32। আইএসবিএন 978-1-57181-912-3 
  42. Swami Parmeshwaranand p. 295
  43. Swami Parmeshwaranand p. 46
  44. Hiltebeitel (1988) pp. 322-4
  45. Hiltebeitel (1988) p. 325
  46. Vanita & Kidwai (2001), p. 70
  47. Pattanaik (2001), pp. 16-17
  48. Dongier p. 273
  49. Pattanaik (2001). p. 65.
  50. Pattanaik (2001), p. 72
  51. NT Network (১১ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। "Music concert to be held at Mardol"Navhind Times। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০১০  [অকার্যকর সংযোগ]
  52. V. P. Chavan (১৯৯১)। Vaishnavism of the Gowd Saraswat Brahmins and a few Konkani folklore tales। Asian Educational Services.। পৃষ্ঠা 26–7। আইএসবিএন 978-81-206-0645-6 
  53. Dhere, R C। "Chapter 2: MHAALSA"Summary of Book "FOLK GOD OF THE SOUTH: KHANDOBA"। R C Dhere। ১৭ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১০ 
  54. "Ryali"Official Government site of East Godavari district। National Informatics Centre(East Godavari District Centre)। ১৯ জুন ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১০ 
  55. Ragini Devi (২০০২)। "The Dance of Mohini"। Dance dialects of India। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 116–9, 96। আইএসবিএন 978-81-208-0674-0 
  56. "Folk Dances of Himachal Pradesh"Official Government site of Chamba district। NIC, Chamba district। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মার্চ ২০১০