ম্যাগনেটার (ইংরেজি ভাষায়: Magnetar) এক ধরনের নিউট্রন তারা যাদের চৌম্বক ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। ম্যাগনেটারের ক্ষয়ের কারণে মহাবিশ্বে অতি উচ্চ শক্তির তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের উৎপত্তি ঘটে। মূলত এক্স রশ্মি এবং গামা রশ্মির বিকিরণ ঘটে। ১৯৯২ সালে রবার্ট ডানকান এবং ক্রিস্টোফার টমসন সর্বপ্রথম এই বস্তুগুলোর উৎপত্তি ও বিবর্তন বিষয়ক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। কিন্তু ম্যাগনেটার থেকে আসা উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি বিস্ফোরণ প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ৫ই মার্চ।গামা রশ্মি চুম্বক দ্বারা সনাক্ত করা যায়। অবশ্য তখন কেউ বুঝতে পারেননি যে সেটা ম্যাগনেটার থেকে এসেছে। এর পরের কয়েক দশক জুড়ে স্বয়ংক্রিয় কোমল গামা নিক্ষেপক এবং ব্যতিক্রমী এক্স রশ্মি পালসারের কারণ হিসেবে ম্যাগনেটার প্রকল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ২০০৪ সালের ২৭শে ডিসেম্বর বিজ্ঞানীরা প্রথম ম্যাগনেটার থেকে আসা গামা রশ্মি বিকিরণ শনাক্ত করেন। এবার তারা জানতেন বিকিরণ কোথা থেকে আসছে।
অন্যান্য নিউট্রন তারার মতোই, ম্যাগনেটারের ব্যাস প্রায় ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) এবং এর ভর সূর্যের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি হয়ে থাকে। এর ঘনত্ব এত বেশি যে এর এক চামচ পদার্থের ভর ১০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি হয়ে থাকে। ম্যাগনেটারগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র সম্পন্ন এবং তুলনামূলকভাবে আরও দ্রুত ঘোরার কারণে অন্যান্য নিউট্রন তারা থেকে ভিন্ন হয়। বেশিরভাগ নিউট্রন তারা প্রতি এক থেকে দশ সেকেন্ডে একবারে ঘোরে, যেখানে ম্যাগনেটারগুলি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একবার ঘোরে। একটি ম্যাগনেটারের চৌম্বক ক্ষেত্র খুবই শক্তিশালী যা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক্স-রে এবং গামা-রশ্মির বিস্ফোরণ উৎপন্ন করে। একটি ম্যাগনেটারের সক্রিয় জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। তাদের শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি প্রায় ১০,০০০ বছর পরে ক্ষয় হয়। এর পরে, এদের ক্রিয়াকলাপ এবং শক্তিশালী এক্স-রে নির্গমন বন্ধ হয়ে যায়। মিল্কিওয়েতে অনুমানকৃত নিষ্ক্রিয় ম্যাগনেটারের সংখ্যা প্রয় ৩০ মিলিয়ন বা তারও বেশি। ম্যাগনেটারগুলির পৃষ্ঠের উপরে ঘিরে থাকা স্টারকুয়াক (ইংরেজি: Starquakes) গুলি চৌম্বক ক্ষেত্রকে বিঘ্নিত করে এবং প্রায়শই অত্যন্ত শক্তিশালী গামা রশ্মির নির্গমন ঘটায় যা ১৯৭৯, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালে পৃথিবীতে রেকর্ড করা হয়েছিল .
ম্যাগনেটারগুলিকে তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র, প্রায় থেকে T দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি যে কোনও মানবসৃষ্ট চুম্বকের চেয়ে শত মিলিয়ন গুণ এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে গুণ বেশি শক্তিশালী। পৃথিবীর ৩০-৬০ মাইক্রোটেসলার এবং একটি নিওডিমিয়াম-ভিত্তিক, রেয়ার-আর্থ ম্যাগনেটের প্রায় ১.২৫ টেসলার চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। এর চৌম্বক শক্তি ঘনত্ব 4.0× । অন্য দিকে, একটি ম্যাগনেটারের টেসলার চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। এর শক্তি ঘনত্ব 4.0× । এর ভরের ঘনত্ব সীসার চেয়ে ১০,০০০ গুণ বেশি। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী এই বিশাল চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির প্রভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্থান-কাল বেঁকে যায়। আবার, কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী, শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো কোন পদার্থের পরমাণুগুলির ইলেকট্রন মেঘকে বিকৃত করে তোলে, এবং জীবনকে রসায়নিক ভাবে অসম্ভব করে তোলে। তাই ম্যাগনেটারের চৌম্বক ক্ষেত্রটি থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরত্বে ও পরিস্থিতি মারাত্মক হবে। পৃথিবী থেকে চাঁদের অর্ধেক দূরত্বের, একটি ম্যাগনেটার পৃথিবীর সমস্ত ক্রেডিট কার্ডের চৌম্বকীয় স্ট্রিপগুলি থেকে তথ্য ছিনিয়ে নিতে পারে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী , এগুলি পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে সনাক্ত করা সবচেয়ে শক্তিশালী চৌম্বকীয় বস্তু।
ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে, "সাইন্টিফিক আমেরিকান" কভার স্টোরিতে বর্ণিত হয় যে, ম্যাগনেটারের চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ক্রিয়া ঘটে। "এক্স-রে ফোটনগুলি সহজেই একটি থেকে দুটিতে বিভক্ত হয়ে যায় বা একত্রিত হয়।ভ্যাকুয়াম নিজেই পোলারাইজড এবং ক্যালসাইট স্ফটিকের মতো দৃড় বায়ারফ্রিঞ্জেন্ট হয়ে ওঠে । পরমাণুগুলি ইলেক্ট্রনের কোয়ান্টাম-রিলেটিভিস্টিক দ্য ব্রোয়ি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়েও পাতলা এবং দীর্ঘ সিলিন্ডারে পরিণত হয়।" প্রায় টেসলার ক্ষেত্রতে পারমাণবিক কক্ষপথ রডের আকার পায়। টেসলায়, একটি হাইড্রোজেন পরমাণু তার সাধারণ ব্যাসের চেয়ে ২০০ গুণ বেশি সংকীর্ণ হয়ে যায়।
শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযগ্য তত্ত্বটি হ'ল,এটি নিউট্রন তারা সুস্থিত হওয়ার পূর্বে উপস্থিত একটি অত্যন্ত ঘন এবং পরিবাহী তরল পদার্থের আলোড়ন থেকে ম্যাগ্নেটোহায়ড্রোডায়নামিক-ডয়নামো ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়। এই ক্ষেত্রগুলি নিউট্রন তারার গভীরে বিদ্যমান পদার্থে (যেখানে নিউট্রনগুলির ভর প্রাধান্য পায়) প্রোটন-সুপারকন্ডাক্টর অবস্থায় বিদ্যমান স্থায়ী তড়িৎতের কারণে স্থায়ী হয়ে যায়। দুইটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষের সময় একটি অনুরূপ ম্যাগ্নেটোহায়ড্রোডায়নামিক-ডয়নামো ক্রিয়ার ফলে আরও তীব্র এবং ক্ষণস্থায়ী ক্ষেত্র তৈরী হয়। তবে অন্য তত্ত্ব মতে, এগুলি কেবল অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ চৌম্বক ক্ষেত্রসম্পন্ন তারার সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়।
কোনও নক্ষত্র সুপারনোভায় পতিত হয়ে যখন একটি নিউট্রন তারায় পরিনত হয় তখন এর চৌম্বক ক্ষেত্রটি নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী হয়ে যায়। রৈখিক মাত্রা অর্ধেক হলে চৌম্বক ক্ষেত্রটি চারগুণ বৃদ্ধি পায়। ডানকান এবং থম্পসন গণনা করেছিলেন যে যখন নতুন গঠিত নিউট্রন তারার ঘূর্ণন, তাপমাত্রা এবং চৌম্বক ক্ষেত্র সব কিছুর পরিমাণ অনুকূল থাকে তখন একটি ডায়নামো প্রক্রিয়া কাজ করে যা তাপ ও ঘূর্ণনশক্তিকে চৌম্বক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।ফলে, চৌম্বক ক্ষেত্র বৃদ্ধি পায়। সাধারণত টেসলার ক্ষেত্র থেকে টেসলার ক্ষেত্র উৎপন্ন হতে পারে। অনুমান করা হয় যে, প্রতি দশটি সুপারনোভার মধ্যে একটিতে সাধারণ নিউট্রন তারার পরিবর্তে ম্যাগনেটার উৎপন্ন হয়।
শুক্রের বায়ুমণ্ডলে স্যাটেলাইট স্থাপনের কয়েক মাস পরে, ৫ ই মার্চ, ১৯৭৯ সালে দুটি মানুষ বিহীন সোভিয়েত স্পেসপ্রোব, ভেনেরা ১১ এবং ১২, সৌরজগতের মধ্য দিয়ে চলার সময় আনুমানিক ১০:৫১ EST এ, একটি গামা বিকিরণের বিস্ফোরণ সনাক্ত করে। এই বিকিরণ উভয় প্রোবে রেডিয়েশন রিডিংগুলিকে প্রতি সেকেন্ডে সাধারণ ১০০ থেকে মুহূর্তের মধ্যে ২০০,০০০ এরও বেশি বাড়িয়ে তোলে।
গামা রশ্মির এই বিস্ফোরণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এগারো সেকেন্ড পরে, হ্যালিওস 2 নামে সূর্যকে প্রদক্ষিণরত একটি নাসা প্রোব এই বিকিরণের মুখে পরে। শিগগিরই এটি শুক্রকে আঘাত করে এবং পাইওনিয়ার ভেনাস অরবিটারের ডিটেক্টরকে অতিক্রম করে। এর কয়েক সেকেন্ড পরে পৃথিবীতে বিকিরণটি সনাক্ত করা হয়। শক্তিশালী গামা রশ্মিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্যাটেলাইট ভেলা, সোভিয়েত স্যাটেলাইট প্রোগনোজ এবং আইনস্টাইন অবজারভেটরির ডিটেক্টরকে ধাক্কা দেয়। সৌরজগৎ থেকে বের হওয়ার ঠিক আগে বিস্ফোরণটি ইন্টারন্যাসনাল সান–আর্থ এক্সপ্লোরারকেও আঘাত করেছিল। গামা বিকিরণের এই বিস্ফোরণটি এক্সট্রা-সোলার গামা রশ্মির মধ্যে সনাক্তকৃত সবচেয়ে শক্তিশালী; এটি পূর্ববর্তী সনাক্তকৃত যেকোনো এক্সট্রা-সোলার বিস্ফোরণের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি তীব্র ছিল। যেহেতু গামা রশ্মি আলোর গতিতে ভ্রমণ করে এবং এটি বহু দূরবর্তী মহাকাশযানের পাশাপাশি পৃথিবী থেকেও রেকর্ড করা হয়েছিল তাই এটি নির্ভুলভাবেই গণনা করা হয় যে, গামা বিকিরণের উৎসটির দূরত্ব প্রায় ২ আরকসেকেন্ড। সনাক্ত কৃত উৎসটি ছিলো একটি নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ যা প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বে একটি সুপারনোভায় পতিত হয়। এটি ছিল বৃহৎ ম্যাগেলানিক মেঘে এবং উৎসটির নাম দেওয়া হয়েছিল SGR 0525-66। ঘটনাটিকে GRB 790305b নামে নামকরণ করা হয়। এটিই সর্ব প্রথম পর্যবেক্ষণকৃত SGR মেগাফ্লেয়ার।
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ এ ঘোষণা করা হয় যে, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাসার গবেষকরা একটি রেডিও পালসারের বৈশিষ্ট্য সম্পন নিউট্রন তারা আবিষ্কার করেছিলেন যা ম্যাগনেটারের মতো চৌম্বক চালিত বিস্ফোরণ সৃষ্টি করছিল। এটি সূচিত করে যে ম্যাগনেটারগুলি কেবল বিরল ধরনের পালসার নয় বরং পালসার জীবনের একটি দ্বশা (সম্ভবত প্রতিবর্তনযোগ্য)। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে ESO ঘোষণা করে যে তারা তাদের ভেরী লার্জ টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রথম কোন দৃশ্যমান সক্রিয় ম্যাগনেটার আবিষ্কার করেছে। নতুন আবিষ্কৃত বস্তুটির নাম দাওয়া হয় SWIT J195509+261406। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা সুপারনোভা Kesteven 79 এর ধ্বংস্তুপ এর কাছাকাছি অবস্থানরত একটি ম্যাগনেটার থাকার খবর প্রকাশ করে। ইউরোপ এবং চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে তোলা ছবিগুলি দেখে ২০১৩ সালে 3XMM J185246.6+003317 নামক ম্যাগনেটারটি আবিষ্কার করেন। ২০১৩ সালে PSR J1745-2900 নামক ধনু এ* ব্ল্যাকহোলকে প্রদক্ষিণরত একটি ম্যাগনেটার আবিষ্কৃত হয়। এই বস্তুটি গ্যালাকটিক সেন্টারের কাছাকাছি বিদ্যমান আয়নিক মহাজাগতিক পদার্থ সম্পর্কে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। 2018 সালে দুটি নিউট্রন তারার সংযুক্তির ফলাফল হিসাবে একটি হাইপারম্যাসিভ ম্যাগনেটারকে ধারণা হয়েছিল।
মার্চ ২০১৬ অবধি, ২৩ টি ম্যাগনেটার সম্পর্কে জানা গেছে এবং আরও ছয় টি নিশ্চিতকরণের অপেক্ষায় রয়েছে। ম্যাকগিল SGR/AXP অনলাইন ক্যাটালগে একটি সম্পূর্ণ তালিকা রয়েছে। পরিচিত ম্যাগনেটারগুলির মধ্যে রয়েছে:
অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল সুপারনোভা খুব বড় তারার মৃত্যুর ফলে পেয়ার-ইন্সটিবিলিটি সুপারনোভা (বা পালসেশনাল পেয়ার-ইন্সটিবিলিটি সুপারনোভা) হিসাবে দেখা দেয়। তবে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে যানা যায় যে সদ্য গঠিত ম্যাগনেটার থেকে আশেপাশের সুপারনোভা ধ্বংসাবশেষে বিমুক্ত শক্তি SN 2005ap এবং SN ২০০es এর মতো কিছু উজ্জ্বল সুপারনোভার জন্য দায়ী হতে পারে।